এ আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন... কর্মময় জীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়ে দিলাম ঠিকানায়, তাই ঠিকানার চেয়ে আর বেশি আপন কে হতে পারে!
ঠিকানায় কাটিয়ে দিলাম ২৫টি বছর। জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ। আমার কর্মজীবন সংবাদপত্রে শেষ হবে, ভাবিনি কখনো। কোনো ধারণাও ছিল না যে, সংবাদপত্রে কাজই আমার পেশা হবে। এ জন্যই বুঝি বলা হয়, ‘ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস।’ মানুষ যা ভাবে- হয় তার ঠিক উল্টো। আজ এ পেশায় ২৫ বছর কাটিয়ে দিয়ে যখন পেছনে তাকাই, তখন মনে পড়ে কত কথা। যখন দেশ ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর ছাড়ি, ঠিক সে মুহূর্তে আমার শাশুড়ি মা আমায় বললেন, ‘দেখো বাবা ফজলু, সকল অনিশ্চয়তা নিয়ে যাচ্ছ। তবে আমি দোয়া এবং আশা দুটোই করব, তুমি ও দেশেও সাংবাদিকতা করো।’ আমি যখন এ দেশে আসি, তখন আমার একমাত্র জীবিত মুরব্বি আমার শাশুড়ি।
আমি এ দেশে আসি ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে শীতের কোনো এক অপরাহ্ণে। লস অ্যাঞ্জেলেসে শীত নেই। সেখানেই থেকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই যে বলে ললাট লিখন, যা কিনা মানুষ কখনো খণ্ডাতে পারে না। আমিও ফিরে এলাম লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক সিটি পাঁচটি বরো নিয়ে। ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড, কুইন্স ও ব্রঙ্কস। নিউইয়র্কের সর্বত্রই প্রায় বাঙালিদের ভিড়। আমার প্রথম বসত কুইন্সের ফ্লাশিংয়ের স্যানফোর্ডে। শহর চিনতে বেশ কদিন যায়। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসে পরদিনই জিজ্ঞেস করে করে লং আইল্যান্ড সিটির ঠিকানার কার্যালয়ে চলে যাই। এত বড় সিটিতে আমার পরিচিতজনের মধ্যে আছেন মাত্র একজন, ঢাকা থেকেই আমার পরিচিতÑআব্দুল মালেক। মতিঝিলে বাংলাদেশ বিমানের অফিসে পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন বিএসএসের সাংবাদিক হামিদুজ্জামান। আমাদের বন্ধু মানুষ। তিনি বিএসএস থেকে লিয়েন নিয়ে বিমানে যোগ দেন। ওর ওখানে গেলে দেখা হতো। দেশে থাকতেই জানতাম, মালেক ঠিকানার উচ্চপদে কাজ করছেন। প্রথম দিনেই মালেক ঠিকানা থেকে নিয়ে গেলেন ব্রুকলিনে একজন লেখকের বাসায়। এ যেন আমার বোনাস প্রাপ্তি। সেখানে লেখকের সদ্য প্রকাশিত একটি বই নিয়ে আলোচনা হলো। স্থানীয় লেখক-লেখিকাও কয়েকজন ছিলেন। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো সেই সমাবেশে। আমাকে কিছু বলতেও হলো। বেশ ভালোও লাগল। এভাবেই নিউইয়র্কে প্রথম দিনগুলো কাটতে থাকে।
তখন একা একা অনেক জায়গাতেই যাওয়া হয়। কখনো কখনো নিজের থেকেই যাই, কখনো কেউ নিয়েও যান। এ সময়ের মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটে। একদিন আব্দুল মালেক, ঠিকানার নির্বাহী সম্পাদক, আকস্মিক আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি লেখালেখি করতে পারি কি না।’ আমি কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকি মালেকের মুখের দিকে। টুকটাক কিছুটা তো করতেই হয়, এ পেশায় আছি যখন। একদিন হঠাৎ সাঈদ-উর-রব আমাকে ডেকে বসলেন। বললেন, ঠিকানার ক্ষতি করার অভিপ্রায় নিয়ে একসঙ্গে তিনজন ঠিকানা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
কিন্তু রব ভাইয়ের মনোবল দেখে আমি সত্যি বিস্মিত হলাম। সেই মুহূর্তে তিনি কারও ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা না ভেবে প্রথমে ঠিকানার ড্যামেজ ঠেকানোর কথা বেশি করে ভাবছিলেন। গত কদিনে আমি তাকে সামান্য যেটুকু চিনেছি, তাতে তিনি ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না। আমাকে প্রতিদিন শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ঠিকানার জন্ম ইতিহাস, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, চারপাশের বিশ্বাসহীনতা, আবার ঠিকানা মানুষকে কতটা ভালোবাসেÑতা নিয়ে আলোচনা করতেন। যেহেতু আমি একেবারেই ক’দিনের ঠিকানায়, তাই তিনি আমাকে ঠিকানার জন্ম ইতিহাসসহ ঠিকানার ঐতিহ্য, ঠিকানার মর্যাদা এবং ঠিকানার পরিকল্পনা কী হতে যাচ্ছেÑসেসব নিয়ে আমাকে কী রকম দায়িত্ব পালন করতে হবেÑতার একটা চিত্র আমি যাতে অনুভব করতে পারি, সেটাই তার লক্ষ্য ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমি যেটা বুঝতে পারি, তা হলো ঠিকানাকে ঠিকানা কর্তৃপক্ষ একটি পাঠক ও জনবান্ধব মুখবন্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এবং এ বিষয়ে শুধু সাংবাদিক নয়, কর্মরত সবাইকে কর্তৃপক্ষ সচেতন রাখতে চান।
তাদের আরেকটা অহংকারের জায়গা হচ্ছে, ঠিকানা একুশের জাতক। আমরা সবাই জানি, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস নিয়ে আমাদের অহংকার ও শ্রদ্ধার শেষ নেই। সেই একুশের জাতক ঠিকানা এবং তারা শুধু বোধে একুশের চেতনাকে জায়গা দিয়ে রাখে না, বাস্তবের চর্চায় এবং কর্মেও তার বহিঃপ্রকাশ। বাঙালিদের জন্য ঠিকানা এক ভালোবাসার নাম। একুশের শিক্ষা ‘অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা’ -এ শুধু ঠিকানার স্লোগান নয়, কর্মে-চলনে-বলনে এবং প্রকাশ ঘটে ঠিকানার সকল বিষয়ে। এ জন্য ঠিকানার যে সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা, তার জন্য অনেক সময়েই অনেকের পরশ্রীকাতরতার শিকার হয়।
যেহেতু এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান স্বত্বাধিকারী এম এম শাহীন রাজনীতি করেন, তাই রাজনীতির নোংরা ঠিকানার গায়ে ছিটানোর চেষ্টাও কম হয়নি। কিন্তু কোনো পরিবেশ, কারও রক্তচক্ষু, সমালোচনা, লোকনিন্দা কোনো কিছুর কাছেই মাথানত না করে সব সময় তার আদর্শকে কখনো পদানত হতে দেননি। আমি থাকি না থাকি, ঠিকানার এই আদর্শ সমুন্নত থাকবে।
ঠিকানার সর্বস্তরে আমার সহকর্মীদের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন, ভালোবাসা। সকল পরিবেশে তাদের সহযোগিতা, সৎ পরামর্শের জন্য তাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। আগামী দিনেও আমার প্রতি তাদের জন্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবেÑসেটাই আমার অতল প্রত্যাশা। দেশে-প্রবাসে ঠিকানার অগণিত পাঠক, লেখক, সহযোগীসহ সব শুভানুধ্যায়ীকে অঢেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ঠিকানা সব শুভাকাক্সক্ষীর শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাক।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা