ফেব্রুয়ারি মাস জাগরণের মাস। ফেব্রুয়ারি মাস অনুভূতির প্রকোষ্ঠে নাড়া দেবার মাস। ফেব্রুয়ারি আমাদের স্বাধীনতার আঁতুরঘর। বাঙালির রচিত ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়। ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মপরিচয়ের বীজ বপণের মাস, আমাদের অধিকার অর্জনের মাস। ফেব্রুয়ারি আমাদের জানান দেয় জনগণের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে প্রতিক্রিয়ার সমস্ত ষড়যন্ত্র পরাভূত হবেই। নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা আর অস্তিত্ব রক্ষার মহিমায়, বিশ্ব মানবের উজ্জীবিত হয়ে ওঠার মাসÑ ফেব্রুয়ারি।
প্রকৃতির নিয়মে আবার ফিরে এসেছে অনুভূতির গভীরতায় জীবনকে বিচিত্রভাবে উপলব্ধীর অনন্য শিখা- ফেব্রুয়ারি মাস। এই দীপ শিখায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে আনন্দ-বেদনামাখা শত ঘটনাপঞ্জি, যার অনুপ্রেরণায় আমরা সামনে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ হইÑ অনুপ্রাণিত হই। আর গৌরবের চূড়ান্ত শিখরে উপনীত হই বীরের জাতি হিসেবে। আমরা বারবার ফিরে যাই ফেলে আসা স্মৃতির অমূল্য কথামালায়। ‘আমরা তোমাদের উত্তরসূরী’- এই অহংবোধে সংকল্পবদ্ধ হই। স্মরণ করি সংগ্রামী বীর ভাষাসৈনিক শহীদ রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ তাদের অনুসারীদের।
মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কত স্মৃতিময় অমূল্য কথামালা। আজ এমন দিনে একজন মানবতাবাদী বীরের কথা গর্বের সাথে উচ্চারণ করতে চাই, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাদের ন্যায়ের এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি আমাদের প্রিয় শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, মানবতার ধারক-বাহক, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার আদর্শের অনুসারী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে।
১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আমরা পূর্ববঙ্গের মানুষেরা হতে থাকি নিষ্পেষিত। আর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে সর্বত্র বলতে থাকে নিষ্পেষণ। দেশ বিভাগের পর থেকে ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৯-এর ধারাবাহিক আন্দোলন চলতে থাকে। আর এই ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলশ্রুতি হচ্ছে আমাদের স্বধীনতা। ১৯৬৬-তে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা আদায়ের আন্দোলন। এই ৬ দফার সাথে যোগ হয় ১১ দফা। এই ১১ দফার কর্মসূচি গ্রহণ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। এই ১১ দফা ঘোষণার পর ছাত্র আন্দোলন সারাদেশব্যাপী এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
আর এসব থেকে মানুষ দেখতে পায় এক নতুন দিক নির্দেশনা দেয়ায় মুক্তির পথের সন্ধান।
প্রত্যাশিত মুক্তি অনিবার্য এমনই তাড়নায় পূর্ববঙ্গের মানুষ দৃঢ় প্রত্যয়ে কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। একুশের বাইরে দুঃখের এবং গৌরবের এমন একটি দিন ‘১৮ ফেব্রুয়ারি’। এই ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বচক্ষে দেখা কিছু ঘটনা। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে কারাগারে হত্যা করা হয়। ফলে পাক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র-জনতা এক হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে সেই ঘটনার ধারাবাহিকতায় আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ৬দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিবাদ ও সমাবেশের ডাক দেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কাজলা গেট হয়ে মিছিল ছুটে যায় রাজশাহী শহরের দিকে। আর ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের হতেই ছাত্রদের সাথে পুলিশের চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সাধ্য কার অপ্রতিরোধ্য এই মিছিলের গতিরোধ করে!
মিছিল এগিয়ে যায় মুসলিম লীগ নেতা আয়েন উদ্দিনের বাড়ির সামনে। ছাত্র-জনতার ক্রোধে আয়েন উদ্দিনের বাড়িতে জ্বলে ওঠে আগুন। পুলিশ, সামারিক, আধা সামরিক বাহিনী ছাত্র মিছিল ঠেকাতে প্রস্তুত। মারপিট, ধাওয়া, গ্রেফতারের পরও আন্দোলনমুখি ছাত্রদের স্তব্ধ করা অসম্ভব। আহত হয় অনেক ছাত্র, গ্রেফতারও হয় অনেকে। ওই অবস্থায় আমাদের ছাত্রীদের সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের মিছিলে অংশগ্রহণকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহা স্যার আহত ছাত্রদের সঙ্গে রয়ে গেলেন। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে জোহা স্যারের দাবি- ‘ন্যায্য সংগ্রামে আমাদের ছাত্ররা পথে নেমেছে। ওদের বিনা শর্তে ছেড়ে দিতে হবে।’
আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। ওইদিনই অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্র নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ মতিহারের আমতলায় জরুরি সমাবেশ হয়।
আজও স্পষ্ট চোখে পড়ে জোহা স্যারের গায়ে সাদা শার্টে আহত ছাত্রের রক্ত। এইতো দেখতে- পাচ্ছি জোহা স্যার সেই রক্ত স্পর্শ করে আমাদের সামনে প্রতিজ্ঞা করলেনÑ ‘আর একটি ছাত্রের দেহ থেকে রক্ত ঝরার আগে আমার দেহ থেকে ঝরবে।’
ওই সমাবেশ থেকে পরদিন, অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। সেদিন সকাল থেকেই মতিহারের সবুজ চত্বরে কী যেন এক বিষাদ-করুণ বাতাস সেদিনের সকালের সূর্যটাকে ঢেকে দিতে চাচ্ছিলো।
মিছিল নিয়ন্ত্রণ করতে ১৪৪ ধারা জারির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিড বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে দু’জন-দু’জন করে ছাত্র-ছাত্রী মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে উদ্যত হয় শহরের দিকে। আমাদের সেই সময়ের প্রথাগত মিছিলের শুরুতে ছাত্রী এবং তারপরে ছাত্ররা থাকবে।
মিছিল একটু এগোতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকে রেডিও ট্রান্সমিটার সেন্টারের বিশাল এলাকায় গাদা করে রাখা শুকনো খড়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে অতর্কিত গুলি চালানো হয়। আচমকা এমন ঘটনায় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। জোহা স্যার অতর্কিতে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর আক্রমণকারীদের হাত থেকে প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করতে কঠিনভাবে বলতে থাকেন- ‘আর একটিও গুলি নয়Ñ সাবধান আমার ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে না। ওদের দাবি ন্যায্য। ওদের আগে তোমরা আমাকে গুলি করো’।
জোহা স্যারকে পশ্চিমা শকুনেরা সেখানেই মাটিতে ফেলে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আধমরা অবস্থায় ওদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সব বাঙালি ডাক্তারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। বিষণ্ন বিকালে খবর আসে আমাদের জোহা স্যার নেই!
জোহা স্যার তার কথা রাখেন। আর আমাদের অভিভাবকহীন করে চিরবিদায় নেন।
জোহা স্যার তার প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রী, একমাত্র শিশুকন্যা, মা-বাবা-স্ত্রী আর দেশমাতৃকার জন্য নিজের বর্ণাঢ্য জীবন উৎসর্গ করেন। যা আজ কেবলই স্মৃতি আর ইতিহাস।
জোহা স্যার মনেপ্রাণে ছিলেন একুশের চেতনায় অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার আদর্শে বিশ্বাসী। যার প্রমাণ ছাত্রজীবনে তার ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশমাতৃকার প্রতি কৃতজ্ঞতার জন্যই তিনি অকাতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
আজ আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় জোহা স্যার ও তার রেখে যাওয়া আদর্শকে বড় বেশি করে মনে পড়ে। জোহা স্যারের রক্ত-সিঁড়ি বেয়ে গণ-অভ্যত্থান নিয়েছিলো এক নতুন রূপে। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো ত্বরান্বিত। আর সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন জাহার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমরা গর্বিত- স্মরণ করি সব সূর্য সন্তানকে। ফেব্রুয়ারি মাস আদর্শের প্রতীক। এ মাসে আমাদের আরেক অর্জনÑ নির্ভরতার প্রতীক, মহাসাগরের পাড়ে গড়ে ওঠা নিজস্ব ঠিকানা- বিশ্ব বাঙালির ঠিকানা। এই মর্যাদার মুকুট শিরে ধারণ করে উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলতে চাইÑ স্বার্থক জনম আমার।
ঠিকানা বেঁচে থাকবে- ফেব্রুয়ারির আদর্শে- পাঠকের ভালোবাসায়। একুশের ফসল ঠিকানা- ঠিকানার প্রতিষ্ঠাতা, ঠিকানার সাথে সম্পৃক্ত সাংবাদিক, নিবেদিত, প্রত্যয়ী এবং সমাজ দর্পণের মুখপত্র ও সকল পাঠকের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। ঠিকানা মানুষের ঠিকানা হয়ে দীর্ঘায়ু লাভ করুক। ২১, ডা. জোহা ও ঠিকানার প্রতি অবিমিশ্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।
ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪