Thikana News
১৮ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪


 

রবার্ট বার্নসের সৃষ্টিশীলতা  সমাজ ও সময়ের

রবার্ট বার্নসের সৃষ্টিশীলতা  সমাজ ও সময়ের



রবার্ট বার্নসের প্রয়াণের প্রায় সোয়া দুইশ বছর পার হলেও আজও তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গবেষণা চলছে সারা বিশ্বে। কবিতা ও গানে তিনি যে সৃষ্টিশীলতা দেখিয়েছেন দুই শতাব্দী আগের সমাজে, তা সাহিত্য ও শিল্পের মাপকাঠিতে কালোত্তীর্ণ হয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বসেরাদের কাতারে।
রবি বার্নসের জন্ম স্কটল্যান্ডের আইরশায়ার কাউন্টির অ্যালোওয়েতে ১৭৫৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। তাঁর বাবা উইলিয়াম বার্নস ছিলেন একজন কৃষক, যিনি বিভিন্ন ফার্ম লিজ নিয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করতেন। সে সময়ে এডিনবরা শহরে কৃষিপণ্যের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। সে কারণেই তিনি মোটামুটি বড় ফার্ম লিজ বা বর্গায় নিয়ে চাষাবাদ করতেন।
তবে যথেষ্ট চেষ্টা সত্ত্বেও রবার্ট বার্নসের বাবা উইলিয়ামের ভাগ্য যথেষ্ট প্রসন্ন ছিল না। তিনি আর্থিক সাফল্য তেমন পাননি। উল্টো সে সময়ে তিনি কিছুটা নিগৃহীত হয়েছিলেন সমাজপতি ও ধর্মীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা। ছেলের সামনে বাবাকে শারীরিক অত্যাচারের ভয়াবহ দৃশ্য মেনে নিতে পারেননি রবি বার্নস।
বড় হয়ে সে জন্য তিনি প্রথাবিরোধী ও কিছুটা বিপ্লবী হয়ে ওঠেন আচরণে। সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি তিনি তেমন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। কিছুটা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অনুসারী ছিলেন। তাঁর অনেক গান কিংবা কবিতায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথা ফুটে উঠেছে। তিনি স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন পল্লিতে ঘুরে অসংখ্য পল্লিগীতি সংগ্রহ করেন। যেসব গান তিনি লিখেছেন, তাতে নিজেই সুর বসাতেন।
রবার্ট বার্নস তার ধনাঢ্য প্রেমিকা ক্ল্যারিন্ডাকে যে প্রেমের চিঠিগুলো লিখেছিলেন, তা আজও স্কটল্যান্ডের সাহিত্যের অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ল্যারিন্ডা ছিলেন গ্লাসগো শহরের একজন আইনজীবীর স্ত্রী। তবে তাঁর স্বামী ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্র‍াজ্যের অংশ জ্যামাইকায় নিজের জমিদারির তদারকিতে ব্যস্ত। স্বামীবিরহে ক্ল্যারিন্ডার সময় কাটছিল বই-পুস্তক পড়ে। তরুণ কবি রবার্ট বার্নসের কবিতার সঙ্গেও পরিচিত হন তিনি।
এডিনবরার একটি পানশালায় রবার্ট বার্নসের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ক্ল্যারিন্ডার। এরপর তাদের মধ্যে প্রেমের একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রবি বার্নস প্রেমের চিঠি লেখেন ক্ল্যারিন্ডাকে। সেই চিঠিগুলো থেকে এখনো বিভিন্ন সময়ে উদ্ধৃতি দেন কবি-সাহিত্যিকেরা।
রবার্ট বার্নসের সঙ্গে ঠিক অনেক জায়গায় মিল দেখা যায় কাজী নজরুল ইসলামের। ছোটবেলায় প্রচণ্ড দারিদ্রে‍্যর মধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে স্থান পেয়েছে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের মর্মবেদনা। বঞ্চিতের পক্ষে কথা বলেছেন জীবনভর। কাজী নজরুল ইসলামও নিজেই গান লিখেছেন, নিজেই সুরারোপ করেছেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগত প্রণয়-সংক্রান্ত অসংখ্য কবিতা-গানও তিনি লিখেছেন।
রবার্ট বার্নস মারা যান ৩৭ বছর বয়সে। আর কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলেও জীবন্মৃত হয়ে যান ৪০ পার হতেই! কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের আর রবার্ট বার্নস স্কটল্যান্ডের জাতীয় কবি। তবে রবার্ট বার্নসের সাহিত্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে এসেছিলেন রবি বার্নস মারা যাওয়ার ৮২ বছর পরে, ১৮৭৮ সালে। রবার্ট বার্নসের দুটি বিখ্যাত গানের বাংলা তরজমা কিংবা ভাবানুবাদ সংগীত হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়’ কিংবা ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কী রে হায়’ -এই দুটি গান দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়। এর মধ্যে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়’ গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন মাত্র চারটি বাক্যে। যদিও মূল কবিতা ‘Ye Banks and Braes’ রবার্ট বার্নস লিখেছেন ১৬টি বাক্যে। কবিতার নাম বনি দুন বা সুন্দর দুন। মূল কবিতার বাংলা অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো :

এই অপূর্ব দুন নদীর ঢালু তটে,
এত উজ্জ্বল সতেজ পুষ্প কীভাবে ফোটে?
কীভাবে বিহঙ্গম অপূর্ব গান গায়?
লালিত্যে যেন তার, জীবন ক্লান্তিময়!
হৃদয় চূর্ণ হয় মোর, ওই পাখির কূজনে,
ফুলের কাঁটার মাঝে ওদের বিচরণে :
স্মরিয়া দিতেছে মোরে বিগত প্রণয়
চলে গেছেÑকভু আর ফিরবে না, হায়!

অপরূপ দুন এর পাশে নিত্য আমি আসি,
দেখি লতানো বুনোফুল গোলাপের পাশাপাশি;
প্রতিটি পাখি গায় ভালোবাসার গান তার,
অনুরক্ত হই আমি নিজেই আমার।

উদ্বেল হৃদয়ে আমি গোলাপের কাছে যাই,
কাঁটাভরা গাছ থেকে মধুর পূর্ণতা পাই!
আমার মিথ্যা প্রণয়িনী গোলাপটা নিয়ে গেছে,
আহা! আমার জন্য শুধু কণ্টক রেখেছে!
(মূল স্কটিশ থেকে ভাবানুবাদ করেছেন অরূপ ব্যানার্জী।)

আবার রবার্ট বার্নসের ‘অল্ড ল্যাং সিং’ গানটি স্কটল্যান্ডে খুবই জনপ্রিয়। স্কটিশদের অন্যতম বড় উৎসব হলো হগম্যানি বা নববর্ষ উৎসব। এই উৎসব জাতীয়ভাবে এখানে উদ্্যাপন করা হয় এই ‘অল্ড ল্যাং সিং’ গানটি গেয়ে।
এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় যে কেবল স্কটিশ-ভাষীরা নন, বরং ইংরেজি-ভাষী দেশগুলোর নাগরিকেরা মৃত্যুতে কিংবা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কিংবা যেকোনো বিদায়ে গানটি গেয়ে থাকেন। নস্টালজিয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই গান বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিতও হয়েছে বটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটির ভাবানুবাদে যে গান লিখেছেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কী রে হায়। ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়’ তাও সমানভাবে জনপ্রিয় বাঙালিদের কাছে।
এই দুটি গান ছাড়াও বিশ্বকবি রবি ঠাকুর স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসের সাহিত্যের কতটুকু অনুরাগী ছিলেন, তা বোঝা যায় তাঁর ‘বিদায় চুম্বন’ কবিতাটির অনুবাদে। এ কবিতাটি অনুবাদ হলেও মূল কবিতার প্রকৃত ভাবার্থ এখানে পাওয়া যায়। কয়েকটি ছত্র এখানে উল্লেখ করছি :

একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার
জনমের মতো দেখা হবে না কো আর।
মর্মভেদী অশ্রু দিয়ে, পূজিব তোমারে প্রিয়ে
দুখের নিশ্বাস আমি দিব উপহার।
সে তো তবু আছে ভালো, একটু আশার আলো
জ্বলিতেছে অদৃষ্টের আকাশে যাহার।
কিন্তু মোর আশা নাই, যেদিকে ফিরিয়া চাই
সেই দিকে নিরাশার দারুণ আঁধার!
ভালো যে বেসেছি তারে দোষ কী আমার?
(বিদায় চুম্বন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ)

‘সত্য বলতে কুণ্ঠিত হয়ো না, পরিশ্রম করতে লজ্জা পেয়ো না’ এ ধরনের অনেক আপ্তবাক্য স্কটিশরা নিয়মিত ব্যবহার করেন রবার্ট বার্নসের উক্তি থেকে। বার্নসের অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতা ও গানে তিনি স্কটল্যান্ডে কিংবদন্তির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
রবার্ট বার্নসের মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ রয়েছে। সাধারণ কারণ হিসেবে বক্ষব্যাধির কথা বলা হলেও তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন -এমনটিই মনে করেন কয়েকজন স্কটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী। সে সময়ে অনেকেই মনে করতেন, অত্যধিক মদ্যপান থেকে বিভিন্ন রোগে কাবু হয়ে পড়েন তিনি।
মৃত্যুর সময়ে আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল ছিলেন রবার্ট বার্নস। যদিও কবিখ্যাতি ও যশ যথেষ্টই জুটেছিল তাঁর, বই বিক্রি থেকে কিছুটা আয়ও ছিল। তবে মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল সে সময়ের হিসাবে এক পাউন্ড।
রবার্ট বার্নসের প্রয়াণের পর তাঁর জন্মদিনে কবির বন্ধুবান্ধব তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় যে সাপারের আয়োজন করতেন, তা আজ বিশাল ব্যাপ্তি লাভ করেছে। স্কটল্যান্ডে এই অনুষ্ঠানটি বড় কয়েকটি জাতীয় আয়োজনের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
রবি বার্নসের প্রিয় খাবার ছিল হ্যাগিস। এটা ভেড়ার কলিজা ও যব দিয়ে তৈরি শিঙাড়ার মতো একটি খাবার। এটা তাঁর এতই প্রিয় ছিল যে হ্যাগিস নিয়ে একটি বিখ্যাত কবিতাও লেখেন এই কবি।
তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতিবছর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে শুরু করেন হ্যাগিস পার্টি। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত স্কটিশরা সেটা অনুসরণ করলে কালক্রমে তা রূপ নেয় বার্নস নাইট উদ্্যাপনের উপলক্ষ হিসেবে। আর হ্যাগিস স্বীকৃতি পেয়েছে স্কটল্যান্ডের জাতীয় খাবারের।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত স্কটিশরা এই দিনে স্মরণ করেন তাদের প্রিয় কবিকে। যার বদৌলতে রবি বার্নস উদ্্যাপনটা আজ এক আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে।
রবার্ট বার্নস বেঁচে আছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে। মৃত্যুর নয় সিকি বছর পরও আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। এই ধারা চলতে থাকবে অনাদিকাল।
লেখক : ফ্রিল্যান্স লেখক ও গবেষক। যুক্তরাজ্যের এডিনবরায় বসবাসরত।
তথ্যসূত্র :
Link: (1) https://www.bindumag.com/2022/02/Robert-Burns.html
(2) https://bit.ly/3HvwoWt
(3) https://bit.ly/3OejTCw
কমেন্ট বক্স