সময়টা ১৯৭৩। মুক্তিযুদ্ধ শেষÑআমরা পেয়েছি স্বাধীন একটি দেশ। সদ্য স্বাধীন জন্মভূমির মুক্ত বায়ুতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার আগেই পাড়ি দিলাম কাফেলায়। অর্থাৎ দেশ ছেড়ে চলে এলাম আমেরিকায়। সে আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা। কেমন ছিল সেই দিনটিÑআজ আর মনে নেই। শুধু জানি -এসেছি এক ভিন্ন জলবায়ুর দেশে। এখানে পা রাখলে কাদামাটির প্রাণ পায়ে লাগে না। এখানে শালিক বা ময়না-টিয়া ডাকে না। নেই কোনো কোকিলের গান। শুধু শুনেছি, এই দেশে উঁচু উঁচু অট্টালিকা আর ঝলমলে পসরার আড়ালে লুকিয়ে আছে সোনার খনি! সেই অমৃত কুম্ভের সন্ধানে দিলাম পাড়ি এই অজানা দেশে। অবশ্য অজানা বললে ভুল হবে। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আর শিল্পে উন্নত এই দেশ। এখানেই জন্ম নিয়েছেন ওয়াশিংটন, লিংকন আর কেনেডি। এই দেশেই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন মহান বিপ্লবী মার্টিন লুথার কিং।
নিঃসংকোচ বলব, এই দেশে আসার স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল মনে মনেÑআরও পড়ব, আরও জানব। আরও জ্ঞানার্জন করব। আর তার কিছু উপার্জন দিয়ে বাবা-মা, ভাইবোনের দুঃসময়ের সাথি হব। সেসব আশা-প্রত্যাশা এখন ‘সকলি গরল ভেল’। সমস্ত স্বপ্নের সমাধি হয়েছে। শাস্ত্রে বলেÑমানুষ বড় স্বার্থপর। প্রতিদান দেওয়ার কথা তারা ভাবে না। দেশ-মানুষ ও পরিবারের প্রতি কর্তব্যের কথা ভুলে যায়। কিন্তু অনেকেই ভুলে যান না। কেননা তাদের গায়ে লেগে আছে কলমির গন্ধ।
হয়তো অনেকেই বলবেনÑপ্রত্যাশা থেকে হতাশা? কথাটা সঠিক নয়। প্রাণের বাংলাদেশ ছেড়েছি আমরা স্বাধীনতার পর থেকেই। সেই কাফেলা এখনো অব্যাহত। উন্নত জীবনের প্রত্যাশাই এর মূল কারণ। সেই সঙ্গে রয়ে যায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। তবে আমাদের আগমনটা ছিল অনেকটা ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখবো এবার জগৎটাকে’-এই অ্যাডভেঞ্চারটি মাথায় রেখে। কোনো দিন ভাবিনি জীবনধারণের জন্য এই ভিন্ন ঘাটে নোঙর করতে হবে চিরকালের তরে।
দার্শনিকদের মতে, মানুষ কখনো তার শৈশবস্মৃতিকে ভুলতে পারে না। স্মৃতি প্রসঙ্গে তাঁদের মূল্যবান অভিমত, ‘যদিও আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত পায়ের তলায় পিঁপড়ের মতো মিশে যাচ্ছে, তবুও স্মৃতি জানিয়ে দেয় আমাদের আসল অস্তিত্বের ঠিকানা।’ বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী টম জোনসের একটা জনপ্রিয় গানের কয়েকটা লাইন পুনরুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি গাইছেন, ‘দীর্ঘদিন পর বাড়িতে এলাম। দেখলাম সব চেনা চেনা লাগছে। নিবিড় এক আনন্দ অনুভব করলাম। দেখলাম সব পরিবর্তনের মাঝেওÑমাটি এখনো সবুজ।’
এই সবুজের মায়া শুধু ফসলের আর ঘাসের প্রতীক নয়। এ হচ্ছে স্নেহ-মায়া-মমতার অফুরান সজীব প্রাণস্পন্দন। যার গন্ধ ও স্পর্শ দেশান্তরি মন-প্রাণকে আকুল করে দিয়ে যায়। মনে হয়, মন-পবনের নাও হয়ে ভেসে ভেসে এসে অবশেষে ভিড়াই তরণীÑফেলে আসা যমুনা, তিতাস আর ধলেশ্বরীর বাঁকে। তুলনা করতে পারি, ভালো জীবন যারা বেছে নিয়েছেন জীবনধারণের জন্য-তাঁদের কথা। বন্দর থেকে বন্দরে ভাসমান সেই সব নাবিক বাড়ি ফেরার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন। আর আনমনে বলেন :
‘ক্লান্ত চরণ, নিষ্পলক দৃষ্টি, বিবর্ণ মুখ কত বেলাভূমি পার হয়ে
কোথায় কোনখানে পড়বে তার দৃষ্টি
ঘরের কোণে গিয়ে হবে স্থির।’
(নাবিক-আবুল হোসেন)
কবির কাছে প্রবাস যেন এক ভিন্ন মানচিত্র। এ যেন এক পাথরের জগৎ। এ যেন এক রসহীন প্রান্তর। তাই অন্তর খোঁজে নিরন্তর রসধারা। তার কিছু মধুর সিঞ্চন দিয়ে জীবনে বয়ে যাবে স্নেহময়ী প্লাবন। বেঁচে থাকা সার্থক হয়ে উঠবে। কিন্তু এসবই কল্পনাপ্রসূত। ইচ্ছে করলেই শূন্যে পাখা মেলে দেওয়া যায় না। ইচ্ছে করলেই দুঃখগুলো দূর মেঘের দেশে পাঠানো যায় না। আমরা যে এক কঠিন বাস্তবের কাছে মাথা নত। তবু একটু পেছনের দিকে তাকাই। অতীতের সংগ্রামী দিনগুলোর কথা সম্মানিত পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করি।
সেদিন ছিল না সাগর বা আলাদিন বা ঘরোয়া রেস্তোরাঁ। ছিল না মেঘনা বা শাপলা বা কর্ণফুলী নামের পসরা। ছিল না ঠিকানা বা প্রবাসী বা পরিচয়ের মতো সংবাদপত্র। পথে-ঘাটে পাইনি কখনো বাংলার কোনো শ্যামল মানুষকে। জিজ্ঞেস করতে পারিনি, ‘ভাই সাহেব, কেমন আছেন? দেশের কী খবর... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা প্রতিদিন ছুটছি আর ছুটছি ‘সোনার খনি’র খোঁজে। তখন সাবওয়ে ভাড়া ছিল মাত্র ৩৫ সেন্ট। কিন্তু পকেট তো শূন্য। সকাল-বিকাল অনেকটা পায়ে হেঁটেই ঘুরে বেড়াতে হতো।
অনেক সাধ করে চট্টগ্রামের বিপণিবিতান থেকে কিনেছিলাম এক জোড়া বিদেশি পাদুকা। বরফের জলে পা পিছলে সবটাই গেল খোয়া। আর চাকরি দেওয়ার নাম করে একজন মিস্টার ফক্স সাহেব (দেখতে শিয়ালের মতোই) আমাদের পকেট খালি করলেন। তবে ধৈর্য হারাইনি। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। বলা হয়ে থাকে, কোনো একটি কাজে সফলতা পেতে হলে অদম্য ইচ্ছাশক্তির পাশাপাশি থাকতে হবে সাহস। যে সাহস এবং অদম্য মনোবল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একটি দেশ স্বাধীন করে দিয়েছেনÑআমরা সেই দেশেরই নাগরিক। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী বাঙালির আস্তানা। এর কিছুই সম্ভব হতো না, যদি না শহীদ ভাইয়েরা বুকের রক্ত ঢেলে এই স্বাধীনতা এনে দিতেন।
আর বীর শহীদদের কথা মনে হলেই ‘শহীদ স্মৃতি’ ভেসে আসে। মনে পড়ে, একুশের এই গৌরবোজ্জ্বল দিনে ভাষাশহীদদের কথা। ‘ভাষার জন্য যাঁরা দিলো প্রাণÑএই হৃদয়ে তাঁদের রক্তের ঘ্রাণ’। সেই রক্তের দাগ বাংলার পল্লি প্রান্তর থেকে আজও মুছে যায়নি। এখনো একজন জননী দরজার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন একজন বরকত বা সালাম বা জব্বার বা আসাদ-মতিউর-জোহার খোঁজে। সেই দিন ১৯৫২-তে যে আত্মপ্রত্যয় আর বিশ্বাসের মশাল জ্বলে উঠেছিলÑতারই সংগ্রামী ফসল বাংলার এই স্বাধীনতা। সুতরাং এই বিলাসবহুল প্রবাসজীবনে যতই আনন্দ-গানে মেতে উঠি না কেনÑস্বদেশের মাতৃময়ী ছায়া সেখানে থেকেই যায়। কবি বলেন, ‘যতো মহাসাগর, মরুভূমি, মহাদেশ তুমি পার হয়ে এসো না কেনÑস্বদেশ পার হয়ে আসা যায় না।’
তাই প্রয়োজন একাত্মতা। প্রয়োজন শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন। বিবাদ-বিভেদ, বিদ্বেষ-হিংসা পরিহার করে যদি এই প্রগতির পথটি উন্মোচন করে দিইÑতবেই শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।
আমরা যতই বলি, ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি’-ততই যেন আমরা আত্মার ধ্বনি শুনতে পাই : ‘ফিরে চল ফিরে চল মাটির টানেÑযে মাটি আঁচল বিছিয়েছে।’
জানি, হয়তো আর কোনো দিন ফিরে যাওয়া হবে নাÑতবু নিশ্চিত জানি, দেহটি হয়তো এই প্রবাসে থেকে যাবে, তবে আত্মাটি চলে যাবে তাল-তমাল আর আম-জামের দেশে। প্রবাসের দীর্ঘ ৫০টি বছর পর বারেবারেই ভেসে আসে সেই শাপলা আর কলমির গন্ধ।