আসিফের মনটা আজকে কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। কেন যেন অতীতের স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ইদানিং বেশ ঘুর ঘুর করছে। একটি এনজিও’র বড় কর্মকর্তা আসিফ। তিন দিন হলো খাগড়াছড়ি এসেছে জরুরী মিটিংয়ে। এখানকার স্থানীয় জনগণের সাথে সরাসরি কথা বলবে। তারপর এনজিও’র স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলবে। কিন্তু কিছুতেই তার মন বসছে না। তার চোখগুলো যেন কাউকে খুজছে।
সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। উচু পাহাড়ে কাঠের একটি সুন্দর বাড়ি। এটিই এনিজিও অফিস। চমৎকার একটি বারান্দা। আসিফ সেখানেই চেয়ারে বসে বিকেলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। এমন সময় ১০/১২ বছরের একটি মেয়ে বাটিতে কিছু খাবার নিয়ে আসিফের পাশে দাঁড়ালো। পোষাকে দারিদ্রের ছাপ থাকলেও তার চেহারা, সুন্দর হাসি মূহুর্তেই ভুলিয়ে দিবে সকল দুঃখ কষ্ট। এক অনাবিল স্বর্গীয় ভাব অনুভুত হবে। আসিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেসা করলো, কে তুমি?
মেয়েটি লজ্জা পেয়ে সেই ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে বললো, আমি কেউ না। এই খানে থাকি।
- এখানে এসেছো কেন? তোমার হাতে কি?
মেয়েটি মনে হয় একটু লজ্জা এবং ভয় পাচ্ছিল। সে আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু স্বলজ্জ হাসি দিয়ে হাতের বাটি টেবিলের উপর রেখে দৌড় দিল। আর যাবার সময় বলে গেল, “খাবারগুলো খাইয়েন কিন্তু।”
ছোট্ট মেয়েটি তার চপল পায়ে নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে পাহাড়ের আঁবাবাঁকা পথ বেয়ে দ্রুত চলে গেলো। তার চলার পথের দিকে আসিফ অপলক তাকিয়ে রইলো।
ছোট্ট মেয়েটির হাসি, কথা বলা, সব কিছুই তার কাছে কেমন যেন আপন মনে হলো। মনে হলো অনেক দিনের চেনা।
আসিফের হঠাৎ মনে হলো মেয়েটির নাম তো জিজ্ঞেস করা হলো না। ধ্যাত কি যে ভুল হয়। এমন সুন্দর একটি মেয়ে, তাও আবার নির্জন পাহাড়ে। আসিফের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। তারপর মনে হলো, খাবারের বাটি যখন নিতে আসবে তখন নামটি যেনে নেয়া যাবে। বাটি হাতে নিলো। কিছু মুড়ির নাড়ু, সাথে কিছু নারকেলের টুকরো আলাদা করে দেয়া আছে।
গুড়ের মুড়ির নাড়ু আসিফের খুব পছন্দের। তার আবার নাড়ুর সাথে আলাদা নারকেল পছন্দ। ছোট্ট মেয়েটি কিভাবে বুঝলো তার পছন্দের কথা? আবারও তার স্মৃতিগুলো তার সামনে নিয়ে আসছে।
“এই তো বেশী দিনের কথা নয়। মফস্বল শহরের একটি কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। ঢাকা শহরের আলোক ঝলমল শহরে নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে হয়েছিলো। একটা অজানা শংকা, আনন্দ সব কিছু মিলেমিশে কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই দিনগুলো কেটেছে। হলে এখনও সিট পায়নি। পরিচিত এক বন্ধুর সাথে শেযার করে হলে থাকে। প্রথম দিনের ক্লাসে কেমন যেন অস্বস্থি বোধ করছিল। ছেলেমেয়ে একসাথে পাশাপাশি বসা। অনেক স্মার্ট ছেলে মেয়ের ভীড়ে নিজেকে কেমন যেন আনস্মার্ট লাগছিলো। তার পাশে যে মেয়েটি বসেছিলো তার নাম হৈমন্তী ময়মং। খাতার উপর নামটি লেখা ছিলো। আড় চোখে দেখে নিয়েছে। তেমন কোন কথা হয়নি। পরের দিন আবারো একই সাথে পাশাপাশি। একদিন ক্লাস শেষে টিএসসিতে বসে চা খাচ্ছিল। এমন সময় সেই পাশে বসা মেয়েটির সাথে দেখা।
আসিফ - বসুন না, চা খান
মেয়েটি - ধন্যবাদ, আমি চা খাইনা। তবে বসতে পারি।
আসিফ - আমার নাম আসিফ
মেয়েটি - আমার নাম হৈমন্তী ময়মং, আদিবাসী, বাড়ি খাগড়াছড়ি।
আসিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। কতো দৃঢ়চেতা মেয়েটি।
হৈমন্তী - আমি হলে থাকি। আদিবাসী বলে এখানে লেখাপড়া করতে নানান ধরনের অসুবিধা মোকাবেলা করতে হয়। স্বপ্ন দেখতে তো অসুবিধা নেই।
আসিফ - তা তো অবশ্যই। স্বপ্ন ছাড়া কি মানুষ বাঁচে, আমরা না হয় একসাথেই সেই সব অসুবিধা মোকাবেলা করবো।
সেই থেকে দু’জনের একসাথে পথ চলা। ধর্ম, বর্ণ, জাতি সব কিছু আলাদা হলেও বন্ধুত্বে কোন অসুবধা হয়নি।
হৈমন্তী ময়মং থেকে কখন যে হৈমন্তী হয়ে গেছে তারা বুঝতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ছুটিতে ২/৩ বার গিয়েছিল হৈমন্তীদের বাড়িতে। খাগড়াছড়িতে উচু পাহাড়ে তাদের বাড়ি। প্রথমবার যখন তাদের বাড়িতে গিয়েছিল বেশ অবাক হয়ে তাকে দেখতে এসেছিলো পাড়া প্রতিবেশীরা। কতো রকমের পাহাড়ী খাবার। খুব যত্ন করে তাকে খাওয়াতো। আর বার বার জিজ্ঞেস করতো খাবার খেতে কোন অসুবিধা হচেছ কিনা। আহ মুড়ির নাড়ু, নারকেল আরো কতো কি!
“স্যার সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চলেন আপনাকে তাড়াতাড়ি হোটেলে পৌঁছাইয়া দেই” কেয়ারটেকার যাদব মং এর কথায় চমকে ওঠে আসিফ। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যাদবের সাথে রওনা দেয় হোটেল দিকে। পাহাড়ী রাস্তা। রাত নামলেই বিপদ চারদিকে। তাই যত দ্রুত সম্ভব হোটেলে যাওয়াই মঙ্গল। একটু দূরেই গাড়ি পার্ক করা ছিলো। হোটেলের দিকে রওনা দিল। যাদব সাথেই ছিলো। আজ রাতে যাদবও হোটেলে থেকে যাবে।
আকাশ মেঘলা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে রাতে। এমনই মেঘলা রাত ছিলো সেদিন। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেছে। হলে আর থাকা যাবে না। হৈমন্তীও গ্রামে চলে যাবে। যাওয়ার আগে দু’দিন ঘুরে বেড়ানো। পরিকল্পনা ছিলো বাংলা সিনেমা দেখবে। তাই হলো। সিনেমা শেষ হলে যখন বাইরে বের হলো তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো। কমার কোন সম্ভাবনা নেই। একটি রিকসায় চড়ে বসলো। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি দু’জনকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। সেদিনই তাদের দু’টি হাত প্রচন্ড শক্তিতে এক হয়ে গেলো। বৃষ্টিতে দু’জন এমনভাবে ভিজলো - তবুও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে হতে লাগলো এই চলার পথ যেন শেষ না হয়।
হলের সামনে এসে হৈমন্তীকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো আসিফ। লজ্জায় কেউ কিছু বলতে পারলো না। কতক্ষণ যে টিএসসিতে চায়ের দোকানে বসেছিলো ঠিক মনে নেই। একটু ভালো লাগার আবেশ তার সারা দেহ মনে বিচরণ করতে লাগলো। কিন্তু কালকে যে হৈমন্তী চলে যাবে, আবার কবে দেখা হবে?
“স্যার নামেন, আইসা পরছি। কেয়ারটেকার যাদবের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আসিফের। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে প্রবেশ করে। যাদব রুমের সবকিছু গোছগাছ করে দিয়ে বাড়ি চলে যাবার কথা বলে।
- স্যার, আমি বাড়ি চলে গেলাম। আকাশ মেঘলা। কখন বৃষ্টি আসে। ঘরে ছোট্ট মেয়ে আর বউ। ভয় পাইবো। কালকে সকালে আইসা আপনারে নিয়া যামু।
আসিফ - আচ্ছা সাবধানে যাও।
আসিফ জামা-কাপড় পরিবর্তন করে একটি ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেদিনের মতই ঝুম বৃষ্টি। আসিফ নিজেকে বেশ অপরাধীই ভাবছে।
জীবন থেকে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে একটি নির্মম সত্যতে আড়াল করতে গিয়ে।
হৈমন্তীর সাথে যা ঘটেছিল, এটাকে তো প্রতারণা বলা যায়। দু’জন দু’জনকে প্রচন্ড ভালবেসে ফেলেছিলো।
জাতি, ধর্ম, গোত্র কোন কিছুই তাদের কাছে বাধা মনে হয়নি। ভালোবাসা মনে হয় এমনই হয়। এটাকে কি প্রেম নাকি মোহ বলবে তাও তার কাছে পরিস্কার নয়।
দুই পরিবারই এই বিবাহে নারাজ। সামাজিক আচার - আচরণ সংস্কৃতি সবই ভিন্ন। কি করবে তারা এই চিন্তায় দিশেহারা। হৈমন্তী মনে করিয়ে দিলো, আসিফের প্রথম দিনের সেই কথা “সব সমস্যা আমরা একসাথেই মোকাবেলা করবো।”
দু’জনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল। মধ্যবিত্ত পরিবার। চাকুরি না হওয়া পর্যন্ত কিভাবে সংসার চলবে। এমন সময় আসিফের বিদেশে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা দেখা দিলো। ভালো ছাত্র ছিলো বিধায় একটি স্কলারশীপ পেয়ে গেলো। তিন মাসের মধ্যেই যেতে হবে। গ্রামে ফিরে গেলে হৈমন্তীর অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে, তাই তাকে ঢাকাতেই একটি বাসা ভাড়া করে দিল। আসিফ বিদেশে চলে গেলো। হৈমন্তী টিউশনী করে দিনগুলো পার করে দিতে লাগলো। বিদেশে যাওয়ার পূর্বে আসিফ - হৈমন্তী তিন মাসের সংসারও করেছিলো। বিয়ের খবর গোপন রাখতে বলেছিল আসিফ। কিন্তু তা আর হয়নি। ততদিনে হৈমন্তী তিন মাসের অন্তস্বত্তা।
আসিফ হৈমন্তীকে গর্ভপাত করার জন্য চাপ দিতে লাগলো। কিন্তু হৈমন্তী কিছুতেই রাজি নয়। এভাবেই অমিমাংসিত রেখে কোন রকমে পালিয়ে বিদেশে চলে গেলো আসিফ। হৈমন্তী বেশ কিছুদিন ঢাকায় থেকে নিরুপায় হয়ে একদিন তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেলো। হৈমন্তীর পরিবার এটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। সন্তান সম্ভাবা একটি মেয়ে, কে সন্তানের বাবা কিছুই জানেনা। তাকে সমাজ কোন ভাবেই মেনে নিবে না। ভিন্ন সমাজের একজনকে বিয়ে করেছে, তাও স্বামী বিদেশে চলে গেছে, তা তারা বিশ্বাস করতে পারেনি বা সমর্থনও করতে পারেনি।
এদিকে দীর্ঘ ১০ বছর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে আসিফ। এই দীর্ঘ সময় সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধছিলো। প্রথম প্রথম ৫/৬ মাস ফোনে কথা হতো। তারপর তাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। বিদেশে পড়াকালীন আইনের জটিলতায় ৭ বছর জেল খাটতে হয়েছিল তাকে। পরে মুচলেকা দিয়ে দেশে ফেরত আসে।
দেশে এসে হৈমন্তীর খোঁজ করেছিলো। কিন্তু তাদের খবর কেউ দিতে পারেনি। হৈমন্তীর বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। প্রতিবেশীর কাছথেকে জানা গেছে অনেক আগেই তারা এই ভিটে ছেড়ে চলে গেছে। আর কোন তথ্য সে পায়নি।
ইজি চেয়ারে কখন যে আসিফ ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করতে পারছেনা। রাত পার হয়ে এখন সকাল, যাদব এখনো আসলো না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেলো অফিসে। এখানেও যাদব নেই। পিয়ন দরজা খুলে দিলো। গতকালকের সেই ছোট্ট মেয়েটির দেয়া খাবার এখনো টেবিলে রয়ে গেছে। এখন হাত মুখ ধুয়ে খাবে। আহ্ সুন্দর মেয়েটি। সেই হাসি, চোখ, কথা বলার ধরণ, তার যেন অনেক দিনের চেনা। দেখে কিন্তু পাহাড়ি মনে হয়নি। উচু নাক, টানা টানা চোখ। হঠাৎ খবর এলো গতকাল মুষলধারে বৃষ্টির ফলে পাহাড় ধ্বসে যাদরসহ তার পরিবারের সকলেই মাটি চাপা পরেছে।
খবরটি শুনে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে দেখে যাদবের স্ত্রী হাউ মাউ করে কাঁদছে। যাদবের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। অবস্থা আশংকাজনক। একমাত্র শিশু সন্তানটি মারা গেছে। যাদবের স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে “আমি আবারও নিঃস্ব হয়ে গেলাম। কাকে নিয়ে বাঁচবো।”
বেডে শুয়ে আছে শিশুটি। এখন শুধুই লাশ। সাদা কাপড়ে পুরো শরীর ঢাকা। আসিফ ধীরে ধীরে শিশুটির মুখ থেকে সাদা কাপড়টি সরাতেই চমকে উঠলো। এযে গতকালের সেই চপল মেয়েটি। এখনও তার মুখে যেন সেই মায়াময় হাসিটি লেগে আছে। যেন বলছে “খাবারটা খাইয়েন কিন্তু”। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আসিফ। কিছু বলার আগেই এভাবে চলে গেলো মেয়েটি। যাদবের স্ত্রী বললো, তাদের কোন সন্তান হচ্ছিল না। তাই দু’বছর বয়সে এই মেয়েটিকে দত্তক এনেছিল। মেয়েটির মা মার নাকি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। স্তব্ধ হয়ে যায় আসিফ। হাটুগেড়ে মেয়েটির পাশে বসে। দু’হাত দিয়ে মেয়েটির গাল স্পর্শ করে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। চোখ থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পরছে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। আসিফের বুক ফেটে কান্না আসছে। শিশুটিকে কেন তার এতো আপন মনে হচ্ছে?
লেখক : সম্পাদক, ইউএস বাংলা নিউজ- নিউইয়র্ক।
প্রধান সম্বনয়কারী- বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, যুক্তরাষ্ট্র।