সাপ্তাহিক ঠিকানা বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিকট প্রিয় একটি সংবাদপত্রের নাম। ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে জনাব এম এম শাহীনের সম্পাদনায় নিউইয়র্ক থেকে যাত্রা শুরু করে ঠিকানা। তার পর থেকে সমান গুণগত মান ও বস্তুনিষ্ঠতা অটুট রেখে একেক করে ৩৪ বছর এই পত্রিকা তার প্রকাশনা অব্যাহত রেখে বাংলা সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রচার ও প্রসারে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সংবাদপত্র এখন ঝুঁকিপূর্ণ একটি শিল্প। দেশে যারা এই পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছেন, তারা যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন এই মাধ্যম নিয়ে, সেখানে দেশের বাহির থেকে একটি সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ করা সহজসাধ্য নয়। দেশে না হয় সরকারি বিজ্ঞাপন ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু এই বহির্বিশ্বে কেবল বাংলাদেশি পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর নির্ভর করে পত্রিকা প্রকাশ আমার নিকট নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোর মতো একটি দুরূহ কাজ বলে মনে হয়। নিউইয়র্কের জীবনমান এমনিতেই খুব ব্যয়সাপেক্ষ। প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য এখন আকাশচুম্বী। সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্ট প্রিন্টিং ও পেপাপের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বাড়াতে পারছে না বিজ্ঞাপনের মূল্য। তার ওপর কমিউনিটির সুবিধার্ধে বিতরণ করতে হচ্ছে ফ্রি পত্রিকা। এত সব সমস্যা ডিঙিয়ে যারা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সংবাদপত্রশিল্পের মতো অলাভজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন, হৃদয়ের গহিন থেকে আমি তাদেরকে জানাচ্ছি শ্রদ্ধা।
যতটুকু মনে পড়ে, ঠিকানা আমার প্রথম নজর কাড়ে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। আমি তখনো নিউইয়র্কে আসিনি। নিউইয়র্কে এসেছি তারও প্রায় ১০ বছর পরে ২০০১ সালে। আমি তখন দৈনিক সিলেট বাণীতে সাংবাদিকতা পেশায় সম্পৃক্ত ছিলাম। সংবাদপত্র দেখা ও সংগ্রহ করা আমার তখন একধরনের নেশা ছিল। নিউইয়র্ক প্রবাসী ভাই হুমায়ুন চৌধুরী দেশে যাওয়ার সময় বলেছিলাম, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা নিয়ে যেতে। তখন তিনি আমার জন্য ঠিকানার বেশ কয়েকটি সংখ্যা নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম দর্শনে ঠিকানা আমার নজর কেড়েছিল। বিশেষ করে, পত্রিকার আকার, গেটআপ ও মেকআপ দেখে মনে হয়েছিল, পত্রিকাটিতে নতুনত্ব রয়েছে। এর আগে এই সাইজের (দেশে এটাকে ট্যাবলয়েড সাইজ বলে) পত্রিকা খুব কম দেখেছি। যদিও পরবর্তী সময়ে ঢাকা থেকে জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী এই সাইজের পত্রিকা (দৈনিক মানবজমিন) বের করেছিলেন। প্রথম দিনই ঠিকানা পত্রিকাটি দেখে ও পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। কারণ তাতে ছিল যেমন দেশ ও প্রবাসের অনেক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, তেমনি বরেণ্য ব্যক্তিত্বের তথ্যবহুল কলাম ও ফিচার।
এ কথা সত্য যে এখন পত্রিকা বের করা যতটা সহজসাধ্য, ৩৪ বছর আগে যখন সাপ্তাহিক ঠিকানা প্রথম বের হয়, তখন ততটা সহজসাধ্য ছিল না। কারণ তখন প্রযুক্তি এখনকার মতো যেমন উন্নত ছিল না, তেমনি ছিল না উন্মুক্ত আকাশ। এখন প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গোটা পৃথিবী চলে এসেছে একই ছাদের নিচে। ফলে মুহূর্তে সবকিছু চলে আসে মানুষের দৃষ্টির সীমানায়। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টুইটার সমান্তরালে কাজ করছে গণমাধ্যম হিসেবে। কিন্তু ঠিকানা যে সময় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, তখন হাতের নাগালে ইন্টারনেট বা এ রকম অবারিত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ফলে দেশের খবরাখবর জানার জন্য প্রবাসীরা পুরো সপ্তাহ ঠিকানার অপেক্ষায় বসে থাকতেন। আবার ঠিকানা পত্রিকাকেও এসব নিউজ সরবরাহে প্রচুর কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। এই সময় শুধু নিউইয়র্ক নয়; টরেন্টো, মন্ট্রিয়েলসহ পুরো উত্তর আমেরিকার প্রবাসীরা ঠিকানার ওপর এতটা নির্ভরশীল ছিলেন যে, শুনেছি বুধবার দুপুর হলেই লোকজন বাংলাদেশি গ্রোসারিগুলোতে গিয়ে ভিড় জমাতেন ঠিকানা সংগ্রহ করতে।
নিউইয়র্ক থেকে এখন প্রতি সপ্তাহে অনেকগুলো পত্রিকা বের হলেও মানসম্পন্ন পত্রিকার সংখ্যা খুব বেশি নেই। গুণগত মান ও বস্তুনিষ্ঠতার মানদণ্ডে ঠিকানা এখনো পাঠক ও গ্রাহকদের নিকট ১ নম্বর পত্রিকা হিসেবে বিবেচিত হয়। একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ ও চৌকস সংবাদকর্মী হচ্ছেন এই পত্রিকার প্রাণ; যারা সততা, আস্থা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সদা জাগ্রত। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন কমিউনিটির সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব জনাব এম এম শাহীন। আছেন প্রধান সম্পাদক জনাব ফজলুর রহমান, যিনি পেশায় একজন প্রবীণ সাংবাদিক। নির্বাহী সম্পাদক জাবেদ খসরু ও সহযোগী সম্পাদক হিসেবে আছেন শামসুল হক। বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন সাহসী সাংবাদিক শহিদুল হক। যারা প্রত্যেকেই পেশাগতভাবে প্রতিশ্রুতিশীল ও দায়িত্বশীল। আবার নতুন করে এখন ঠিকানায় যুক্ত হয়েছেন সম্পাদক-কন্যা মুশরাত শাহীন। কমিউনিটির বহুল জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত সাপ্তাহিকী ঠিকানার ৩৫তম জন্মদিনে আমি এর অব্যাহত প্রকাশনা ও উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করি।
লেখক : কলাম লেখক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, নিউইয়র্ক।