দেশে থাকতে বাংলা কথায় কিংবা নিজ আঞ্চলিক ভাষায় বলা কথার মধে্য কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতাম। এ দেশে আসার পর সে গর্ব মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
চারপাশে আমেরিকানরা কিংবা আমার নিজের নাতি-নাতনিরা যখন তাদের ভাষায় (ইংরেজি) কথা বলে, আমি এক্সপ্রেস ৭ ট্রেনের ঝরঝরানি যাত্রার আওয়াজ শুনি আর হাঁ হয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ‘হআসআপ নানু’।
আমাদের স্কুল-কলেজে ইংরেজি শেখা মানে টানা মুখস্থ আর পরীক্ষায় ৩৩ বা তার ঊর্ধ্বে মার্কস পাওয়া। আমাদের শেখার চাইতে পরীক্ষা পাসের জন্য পড়া ছিল মুখ্য। (আমাদের সময়ের কথা)
Essay writing, Letter writing অথবা Application writing আর বাংলা থেকে ইংরেজি Translation ভালো করে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় হুবহু ঝেড়ে দিয়ে আসতে পারলেই মোটামুটি চিন্তাহীন, পরীক্ষার বৈতরণি পার হওয়া যেত।
A journey by boat
A journey by train
Aim in life
My school
My College
My village
Village market
Discipline &
The Cow is a four footed domestic animal ...
ইত্যাদি কয়েকটি মুখস্থ শিখলেই Essay-কে ইলাস্টিকের মতো হাইস্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যেত। আর Application এর তিন অংশের মধ্য সারমর্ম অদলবদল হলেও বাকি দুই অংশÑশুরু ও শেষ প্রায় একই।
যেমন শুরু
Dear sir
I beg most respectively to you that ...
শেষ-
Your most obedient pupil or student
বাংলা থেকে ইংরেজি Translation যেমন-
ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল, মানুষ মরণশীল, মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে... ইত্যাদি ধুমসে মুখস্থ করে আসা বিদ্যা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে লিখে দিতাম। স্টার মার্কস না হোক পাস মার্কস নিশ্চিত।
আমেরিকানদের ইংরেজি আর হাডসন, ইস্ট রিভারের কত গল্প পড়েছি, শুনেছি কিন্তু বলতে গেলেই তালগোল পাকিয়ে যায়। অগত্যা লাইব্রেরিতে ESL ক্লাসে ভর্তির পরীক্ষা দিই। আমার মুখস্থবিদ্যার বলিহারি দেখে কর্তৃপক্ষ আমাকে Higher secondary ক্লাসে দিয়ে দেন। প্রথম দিকে Lecture দেন Teacher, আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি। লিখতে পারি কিন্তু বলতে গিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ Tense একটার স্থলে আরেকটা বলে ফেলি। আর উচ্চারণ -লাজে মরি মরি গো!
সাবেক অর্থমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় সাইফুর রহমান সিলেটি উচ্চারণে ইংরেজি বলতেন, তাতে অনেকেই হাসত। এখানে Congressman Ruben Diaz তার নিজ অঞ্চলের উচ্চারণে ইংরেজি বলেন, তা নিয়ে কেউ ট্রল করে না বা হাসিঠাট্টা করে না।
আমার আব্বা টেলিভিশনকে বলতেন ট্যালিভিশন, ইলেকট্রিক উচ্চারণ আমাদের কাছে লাগত ল্যাথ্রিকের মতো। আমেরিকানরা জ এর উচ্চারণ করে না।
stop এখানে উচ্চারণ স্টাপ, ফিফটি ওয়ান এখানে ফিফটি ফার্স্ট-এমনই অনেক অনেক।
ইংরেজ আমলে ইংরেজি ভাষা রপ্তকারী বাঙালিদের নিয়ে মজার মজার কাহিনি পড়ি আর হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা ধরিয়ে ফেলি।
স্বল্প ইংরেজি জানা ঝানু উকিল ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে ‘গাভি’ বোঝাতে পাশের মাঠ থেকে একটি ষাঁড় ধরে এনে বলেছিলেন, ‘গাভি ইজ হিজ ওয়াইফ, স্যার।’
এক ফিরিঙ্গি সাহেব নাপিতের কাছে চুল কাটতে গেলে নাপিতের ক্ষুরের সামান্য আঘাতে ‘ড্যাম’ বলে ওঠে।
নাপিত খেপে গিয়ে জানাল, ‘ড্যামের’ অর্থ না বলা পর্যন্ত সে চুল কাটা বন্ধ রাখবে।
সেখানে উপস্থিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যাপারটি সামাল দিতে বুদ্ধি করে বললেন, ‘ড্যাম মানে খুব ভালো।’
নাপিতও সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। সে বলল, ‘ড্যাম যদি ভালো হয়, তবে আমি ড্যাম, আমার বাবা ড্যাম, আমার চৌদ্দ গুষ্টি ড্যাম আর যদি খারাপ হয়, ও ড্যাম, ওর বাবা ড্যাম, ওর চৌদ্দ গুষ্টি ড্যাম। ব্রিটিশদের দেশ ড্যাম শুধু ড্যামনাÑড্যামড্যামাড্যামড্যাম।’
ব্রিটিশ সময়ে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের স্থানীয় ভাষা শেখা ছিল বাধ্যতামূলক। পাস করলে চাকরিতে উন্নতি, বেতন-ভাতা বাড়ত। তখন কৃষ্ণনগর কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ‘ই লেথব্রিজ’ সাহেব নাকি বাংলায় পাস করে অনেক টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার বাংলা থেকে অনুবাদ করা একটি বাক্য ছিল বেশ রসালো। বাক্যটি ছিল :
‘রাজা বিক্রমাদিতে্যর দুই মহিষী ছিলেন।’
তিনি ইংরেজি অনুবাদ করলেন :
‘রাজা বিক্রমাদিত্যের দুটি মাদি মহিষ (সি বাফলো) ছিল।’
বাংলা ভাষায় পারদর্শী এক ইংরেজ মহিলা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ ইংরেজি অনুবাদ করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনিও ‘গোলাপ ওড়ে’র বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, ‘জার্নি অব ফ্লাইং গোলাপ।’
এক কলেজের ছাত্ররা তাদের এক সহপাঠীর সম্মানহানির প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মৌন মিছিল করেছিল। পরের দিনের পত্রিকায় ছাপা হলো ছাত্ররা যৌন মিছিল করেছে। একটা শব্দের হেরফেরে পুরো বিষয়টি ভূমিকম্পে উলটপালট হয়ে যায়।
আর এখন আমরা ফেসবুকের বিচিত্র শব্দে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি ক্রমশ।
আমার মতো অতি সাধারণ মানুষের জীবনে বিরাট কোনো আনন্দের ঘটনা খুব কমই ঘটে। আমি নিজে চেষ্টা করি আনন্দ সৃষ্টির। ছোট্ট ছোট্ট আনন্দকে বড় করে দেখি।
-নিউইয়র্ক