আমি বরাবরই দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে লেখালেখি পছন্দ করি। গত বছরের নভেম্বর মাসে আমি ঢাকায় থাকাকালীন কাগজে একটি চমৎকার খবর দেখলাম। বহুলপরিচিত ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র, ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে, ঐতিহ্যের গৌরবময় প্রতীক হয়ে ইউনেসকো থেকে স্বীকৃতি পেল। এর আগে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি শাড়ি ও শীতল পাটি, যা পুরোপুরিভাবেই ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের কৃতিত্বের ফসল। সেই সারিতে এবার যোগ দিল ঢাকার রিকশাচিত্র, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইতিমধ্যেই অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
১৯৪৭-এর দেশভাগের কিছু আগে ঢাকায় রিকশা ও রিকশাচিত্রের প্রচলন ঘটে। শুরুতে এটি অভিজাতদের বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল। রিকশাচিত্রের এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার নেতৃত্ব দেন সুনীল দাস, আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ ওস্তাদ প্রমুখ শিল্পী, যাদের মাধ্যমে বিকশিত হয় দেশের সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং, ট্রাক আর্ট ও রিকশা আর্টের মতো নান্দনিক শিল্প। ছবি আঁকার আনন্দ, সেই সঙ্গে কাজটির ক্রমবর্ধমান চাহিদা তাদেরকে এই পেশায় যুক্ত থাকতে সহায়তা জুগিয়েছে। গত ৭৫ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পধারা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। রিকশা আর্টে নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও স্বকীয়তা প্রকাশ পায় সৃষ্টিকারকের হাত থেকে।
রিকশা আর্টে যেমন রিকশার অঙ্গসজ্জার দিকে জোর দেওয়া হয়, তেমনি রঙের সাহায্যে রিকশাকে চিত্রিত করা হয়। রিকশার পেছনে ঝুলবোর্ডে টিনের শিটের ওপর যে রং-বেরঙের ছবি আঁকা থাকে, তা-ই রিকশাচিত্র হিসেবে সুপরিচিত। রিকশাচিত্রের মূল লক্ষ্য হলো রিকশাকে আকর্ষণীয় করে তোলা। আর এটি করতে তারা বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু নির্বাচন করে পেছনের প্যানেল আঁকার জন্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রিকশাচিত্র করা হতো চলচ্চিত্র তারকাদের প্রতিকৃতি অবলম্বনে। মুম্বাই সিনেমার বিষয়বস্তু ধরে অনেক কাজ তৈরি হতো।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রিকশায় আঁকা হতো মুক্তিযুদ্ধ, কাল্পনিক শহরের দৃশ্য, গ্রামের জনজীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। গ্রামীণ দৃশ্যের মধ্যে ধান ভানা, উঠানে বিশ্রাম নেওয়া, নদীতীরে সূর্যাস্ত, গ্রামের বধূর কলসি কাঁখে পানি নিয়ে যাওয়া, রাখাল বাঁশি বাজিয়ে গরু নিয়ে যাওয়া বরাবরই ব্যাপক জনপ্রিয়। স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ইত্যাদি স্থাপত্যও রিকশা আর্টের বিষয়বস্তু হয়েছে। ইদানীংকালে রিকশাচিত্রের আরও একটি উপাদান হলো যমুনা নদীর বুকে বঙ্গবন্ধু সেতু।
ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে এই বিশেষ চিত্রকলা একসময় হুমকির সম্মুখীন হয়। বর্তমানে ঢাকায় সক্রিয় রিকশাচিত্রীর সংখ্যা ১৫-২০ জনের বেশি নয়। এ ছাড়া অন্যান্য জেলা শহরেও আছে বেশ কিছু শিল্পী। বেশির ভাগ রিকশাচিত্রী পেশা পরিবর্তন করেছে বা বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছে। যারা এই পেশায় এখনো সক্রিয়, তারা বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল।
১৯৯৯ সাল থেকে রিকশা আর্ট এক ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রঙিন রিকশা পেইন্টিংকে নতুন রূপে বাঁচিয়ে তোলা হয় ঘর সাজানোর বিভিন্ন পণ্য, আসবাবপত্র ও গৃহসামগ্রী অলংকরণের মধ্য দিয়ে। চেয়ার, টেবিল, ফুলের টব, কেটলি, ল্যাম্প, পর্দা, চায়ের কাপ, ট্রে, হারিকেন ইত্যাদি যাবতীয় জিনিসের মধ্যে নকশাকারকেরা ফুটিয়ে তুলছে রিকশা আর্টের নান্দনিকতা। এ ছাড়া রিকশাশিল্পের রঙিন চিত্রকর্ম রাঙিয়ে তুলছে মেয়েদের শাড়ি, শাল, কোট, জ্যাকেটের মতো পরিধেয় বস্ত্র।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে আমিও সংগ্রহ করেছি এমন কিছু জিনিস। একটি অনলাইন পোর্টালে অর্ডার করে পেয়ে গিয়েছি রিকশা পেইন্টিং করা দেশীয় হারিকেন, নকশা করা কাঠের চামচ, চায়ের কাপ, কেটলি, মোমদানি প্রভৃতি। রিকশা আর্টের আদলে তৈরি প্রাচীন মোগল সাম্রাজ্যের ছবি আঁকা একটি শাড়িও সংগ্রহ করেছি। তবে সবচাইতে পছন্দের যে জিনিসটি বানিয়ে এনেছি, তা হলো আমার লেখক নাম ‘শিশিরকন্যা জয়িতার’ একটি চমৎকার নেমপ্লেট। রঙিন ফুল আর ময়ূর দিয়ে আঁকা আমার নেমপ্লেটটি দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও লোকশিল্পের এক জ্বলজ্বলে উদাহরণ, যা রিকশাচিত্রকে করেছে আরও প্রতীয়মান।
বিগত আট দশক ধরে চলমান রিকশা চিত্রকর্ম একটি বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে নিঃসন্দেহে ইউনেসকো দ্বারা অভাবনীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন মণ্ডলে আমাদের দেশীয় এই শিল্পশৈলী রিকশা আর্টের আরও প্রচার ও প্রসার হোকÑএই কামনা করি।
লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার, টেক্সাস