Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

প্রলম্বিত বাড়ি ফেরা

প্রলম্বিত বাড়ি ফেরা
‘এলিভেটর’ থেকে বের হলেই তার নাকে রান্নার ঘ্রাণ এসে লাগে। ঘ্রাণেই সে আঁচ করতে পারে, আজকে বাসায় কী রান্না হতে পারে। বেশির ভাগ সময় মিলে যায়। কাজ থেকে ফিরে বাসায় ঢোকার সময় এটা একটা ‘কমন’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘ্রাণ নিয়ে আরেকটি বিষয়ের ব্যাখ্যা সে এখনো দাঁড় করাতে পারেনি, পুরোটাই কাকাতালীয় হতে পারে। একদিন আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ে স্টেশন থেকে উপরে উঠতেই কী একটা মজাদার পোড়া গন্ধ তার নাকে এসে লাগে, অনেকটা বেগুন পোড়ার মতো। টাইমস স্কয়ার এরিয়ায় প্রচুর হাটডগ, শিশ কাবাব, হালাল জায়রো বিক্রি হয়। ভিজিটরদের জন্য সহজলভ্য খাবার। পোড়া গন্ধটা সম্ভবত ওখান থেকেই এসেছে। সেই গন্ধটা কিছু সময়ের জন্য তাকে স্মৃতিকাতর করে ফেলে। মায়ের হাতের সুস্বাদু বেগুনভর্তার কথা মনে পড়ে যায়। আহা! কত দিন হয় বেগুনভর্তা খাওয়া হয় না! বাসায় ডাইনিংয়ে খেতে বসলে তার স্ত্রী বলে, ‘একটু বেগুনভর্তা করলাম, খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে? ফ্রিজের ড্রয়ারে দুটো বেগুন ছিল অনেক আগের। ভাবলাম আজ একটু ভর্তা বানাই!’ এই ঘটনায় কিছু সময়ের জন্য সে বাকহারা মূর্তির মতো হয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রীর ডাকে সংবিৎ ফিরে পায়, ‘কী ব্যাপার, হঠাৎ এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলে?’ কিছু না বলে খাওয়া শুরু করে। এ ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা আছে? স্ত্রীকে কিছু বলল না। আরেকদিন কাজের জায়গায় এক ডেলিগ্রোসারিতে কফি কিনতে গেলে সেই গ্রোসারিতে তৈরিকৃত কী একটা স্যুপের গন্ধ নাকে এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় গ্রামের বাড়িতে বড় চাচির হাতে সিম বিচি দিয়ে আইড় মাছের তরকারির কথা। কী তার স্বাদ! সেই স্বাদ বোধ হয় আর জীবনে পাওয়া যাবে না! বাসায় এসে সেদিনও একই ঘটনা! খেতে বসলে তার স্ত্রী বলে, ‘ইচ্ছে থাকলেও ঝামেলার কথা মনে হলে মন সায় দেয় না! বাংলাদেশ থেকে আনা সিম বিচি কত সময়ে যে সেদ্ধ করেছি, ঠিক নাই, সহজে সেদ্ধ হয় না! তারপর খোসা ছাড়ানো আরেক যন্ত্রণা, খাওয়া খুব সহজ কিন্তু করাটা কঠিন, যে করে সে বুঝে!! দেখো তো, তরকারিটা কেমন হয়েছে?’ আজও সে কিছু সময়ের জন্য স্থাণু হয়ে ছিল! না, স্ত্রীকে কিছুই বলেনি! বললে তার স্ত্রী অবশ্যই ঠাট্টা করে বলবে, ‘ও তুমি বোধ হয় পীর-আউলিয়া হয়ে গেছ! যত্ত সব ভণ্ডামি!’ মানুষের জীবনে বোধ হয় এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না!
ষাট তলার এই ‘লাক্সারিয়াস’ বিল্ডিংয়ে তারা থাকে নয় তলায়। আরও দুটো বাঙালি পরিবার আছে। তবে তাদের সঙ্গে সেই পরিবার দুটো প্রতিবেশীসুলভ তেমন একটা সম্পর্ক রাখে না, এ দেশে সচরাচর বাঙালিদের মধ্যে যা থাকার কথা। দেখা হলে আমেরিকান স্টাইলে ‘হাই-হ্যালো’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই ‘হাই-হ্যালো’ মার্কা বাঙালি পরিবার চলাফেরায় শতভাগ ‘আমেরিকান’ হতে চেষ্টা করে, বাসায় রান্নাবান্না করে না, বিশেষ করে বাঙালির মসলাযুক্ত খাবার। কারণ মসলার গন্ধ কাপড়চোপড়ে লেগে থাকে। বাঙালি হচ্ছে ‘কাঁচড়া’ টাইপ জাতিÑএ ধরনের একটা উষ্মা তাদের কথাবার্তায় প্রকাশ পায়! তা ছাড়া এই বিল্ডিংয়ের একটা ইজ্জত আছে! যারা থাকেন তারা মোটামুটি সবাই ‘এলিট’ শ্রেণির, সে ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সচেতন! পরিবেশ বুঝে বাঙালির সাড়া দেওয়ার মতো অসাধারণ ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে আছে বলে মনে হয় না! তাদেরকে যে পাত্রে রাখা যাবে, সেই পাত্রেরই আকার ধারণ করবে! তা ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করার জন্য তারা সব সময় একটা ‘ডিব্বা’ বহন করে বেড়ান। সে তার নাম দিয়েছে ‘ফুটানিকা ডিব্বা’। সেই ডিব্বা ভর্তি থাকে আত্মহংকারের নানান সরঞ্জামে। সময়-সুযোগে তা ব্যবহার করে নিজেকে অপরের কাছ থেকে আলাদা প্রমাণ করায় সচেষ্ট থাকেন। সম্ভবত এ কারণেই ওই দুই পরিবারের সদস্যরা সকালের নাশতাটা অন্যান্য এলিট শ্রেণির টেনেন্টের মতো ‘ব্রেকফাস্ট’ হিসেবে রেস্টুরেন্টে গিয়ে সারেন। সেই তুলনায় এরা একেবারেই ভাতে-মাছে খাঁটি বাঙালি। চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা থেকে শুরু করে কোনো কিছু বাদ যায় না। ছাব্বিশ বছর যাবৎ আমেরিকায় থাকলেও তার কিংবা তার স্ত্রীর কারও আর ‘আমেরিকান’ হয়ে ওঠা হয় না।
সে কাজ করে নিউইয়র্ক সিটি ট্রানজিটে। সাবওয়ে স্টেশনের কাস্টমার সার্ভিসে। প্রতিদিন আট ঘণ্টার ট্যুর। বিকাল তিনটা থেকে রাত এগারোটা। রাতে যে লোক তাকে ‘রিলিফ’ দেয়, সে তাড়াতাড়িই আসে। ট্যুর শেষ হওয়ার পনেরো-বিশ মিনিট আগেই তাকে ছেড়ে দেয়। কোনো কোনো ‘এমপ্লয়ি’ আছে, এরা সব সময় দেরি করে আসে ‘লেট কামার’। সেদিক দিয়ে সে ভাগ্যবান। তার পরও কাজ শেষ হলে তার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। কখন বাসায় ফিরবে। অথচ বাসায় যেতে লাগে মাত্র বিশ মিনিট। ট্রেনে দশ মিনিট, ট্রেন থেকে নেমে ‘ক্রসটাউন বাস’। না পেলে হেঁটে গেলে বড়জোর দশ থেকে পনেরো মিনিট।
এগারোটা বাজার দশ মিনিট বাকি। আজ তার রিলিফ আসতে দেরি করছে কেন? এ রকম তো হয় না! হঠাৎ ফোনে রিং, ‘হাই! দিস ইজ ইয়োর রিলিফ, আই এম অন মাই ওয়ে, মে বি কপল অব মিনিট লেট, প্লিজ এক্সকিউজ মি।’ তার মেজাজ বিগড়ে যায়! সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে শাসন করে, ‘ছি! প্রতিদিন লোকটা তোমাকে ‘আর্লি’ বাড়ি যেতে দেয়, আজ এক দিনের জন্য তুমি অধৈর্য হয়ে গেলে? তুমি এত স্বার্থপর!’ নিজেকে সংযত করে উত্তর দেয়, ‘ডোন্ট অরি ব্রাদার, টেক ইয়োর টাইম!’ পনেরো মিনিট দেরিতে তার রিলিফ এসে পৌঁছায়। ঠিক সেই সময়ের ট্রেনটা দৌড়ে গিয়েও ধরতে পারেনি, মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়! যাহ শালা!! বলেই ট্রেনের ওপর রাগ ঝাড়ে! পরের ট্রেন আসতে বিশ মিনিট বাকি। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে স্ত্রীকে কল দেয়, ‘হ্যালো! কী করছ?’ ‘কী ব্যাপার? এই সময়ে তোমার ফোন? স্টাক হয়েছ নাকি? রিলিফ নাই?’Ñতার স্ত্রী জানতে চায়। ‘না, তা নয়, রিলিফের একটু দেরি হয়েছে আসতে, ট্রেনও মিস করলাম একটুর জন্য! মেজাজ খারাপ হয় না, বলো?’ ‘আচ্ছা যাও, এত অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই, প্রতিদিনই তো টাইমের আগে আসো, একদিন না হয় আট ঘণ্টা হালাল উপায়ে রুজি করলে।’ স্ত্রীর কণ্ঠে ঠাট্টার সুর। ‘তুমি খেয়ে নাও, আমার আসতে বারোটার উপর বাজতে পারে।’ সে বলে। ‘আসো আস্তে আস্তে, আমি অপেক্ষা করছি’, তার স্ত্রী সান্ত্বনা দেয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে নিউইয়র্ক সিটিতে আইনকানুনের কোনো বালাই নেই। বিশেষ করে, প্যান্ডামিকের পরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ক্রাইম মনে হয় ‘আউট অব কন্ট্রোল’। অনেক বড় বড় স্টোর চুরির যন্ত্রণায় বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রেনগুলো রাতে পুরোটাই ‘হোমলেস’দের দখলে চলে যায়। যার যা ইচ্ছা তা-ই করছে। কেউ গাঁজা খাচ্ছে, কেউ এক কোনায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে, কেউ তার জীবনের সব সম্পত্তি নিয়ে পুরো বগি দখল করে আছে। সম্পত্তি বলতে বড় বড় প্লাস্টিক ব্যাগবোঝাই পত্রিকার কাগজ, শপিংকার্ট, বেবি স্ট্রলার, সিটি বাইক। এসবই চুরি করা, বোঝাই যায়। তার ওপর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধ! মনে হবে, পচে যাওয়া  কোনো ‘ডেডবডি’ জম্বি হয়ে কবর থেকে উঠে এসেছে! স্বস্তিতে কাজে যাওয়া-আসার কোনো গ্যারান্টি নেই বললেই চলে। আর লেট নাইট হলে তো কথাই নেই।
১১০ স্ট্রিট স্টেশনে যাত্রীদের নামানোর পর তার ট্রেনের ‘কন্ডাক্টর’ কোনোক্রমেই দরজা বন্ধ করতে পারছিল না! কেউ একজন দরজা ধরে রেখেছে। কন্ডাক্টর বারবার অনুরোধ করছিল, তবু বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছিল না! দেখা গেল, একজন বিশিষ্ট ‘হোমলেস’ ভদ্রলোক পা ছড়িয়ে দরজার মাঝখানে বসে আছেন। সম্ভবত উনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কী করবেন! ভেতরে ঢুকবেন নাকি প্ল্যাটফর্মে যাবেন? একসময় একটা উৎকট গন্ধযুক্ত গাঁজা ধরালেন। আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়ছেন আর চিন্তা করছেন। বগিতে বসা যাত্রীরা তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। সবাই একনজরে সময়টা দেখে নিচ্ছে। চোখেমুখে বিরক্তির চাপ স্পষ্ট হলেও কারও মুখে কোনো আওয়াজ নেই। অথচ একে একটা লাত্থি দিয়েই বের করা যায়, দ্বিতীয়টার প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। তা সম্ভব নয়। কেননা আমেরিকায় এটা তার নাগরিক অধিকার, মানবাধিকারও বটে! এর জন্য পুলিশি সহায়তা প্রয়োজন। পুলিশও এদেরকে ঘাঁটাতে ভয় পায়। এদের জন্য শেল্টারের ব্যবস্থা আছে, খাবারদাবারসহ সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এরা বেরিয়ে আসে, সাধারণ জনগণকে ক্রমাগত বিরক্ত করে যায়। এটা নাকি তার ব্যক্তিস্বাধীনতা। কেউ কিছু বলতে পারবে না। সবাইকে আশ্বস্ত করে একসময় উনি দরজা ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে গেলে কন্ডাক্টরসহ সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। থ্যাঙ্ক ইউ বলে ট্রেন কন্ডাক্টর দরজা বন্ধ করলে ট্রেন চলতে শুরু করে। প্রায় বিশ মিনিট সময় নষ্ট হয় এই ঘটনায়। সে তার ঘড়ি দেখে। বারোটা পাঁচ। বারোটা সতেরোতে একটা বাস আছে, ভাগ্য ভালো থাকলে ধরা যেতে পারে।
নিউইয়র্ক শহরকে বলা হয় বিশ্বের রাজধানী। টাইমস স্কয়ার নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত পথচারী সংযোগস্থল এবং বিশ্ব বিনোদন শিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিদৃষ্ট পর্যটনস্থল হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এই এলাকাটি রং-বেরঙের বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জা ও প্রোজ্জ্বল সাইনবোর্ডের কারণেও বিখ্যাত। প্রতিবছর এখানে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে ইংরেজি নববর্ষ উদ্্যাপিত হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তখন পর্যটকেরা এসে ভিড় করে ‘নিউ ইয়ার বলড্রপ’ দেখতে।
এই টাইমস স্কয়ারই হচ্ছে তার ‘হোম স্টেশন’। ট্রেন থেকে নেমে ছোট্ট একটা এক্সিট ৪২ স্ট্রিট আর ৮ অ্যাভিনিউ। উপরেই ‘ক্রসটাউন বাস’। যদিও এক্সিটটা রাতের বেলা নিরাপদ নয়, বাসটা সহজে ধরার জন্য সে এটা ব্যবহার করে। আজ সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বেশ কয়েকটা স্প্যানিশ আর কালো যুবক মিলে ব্যারিকেড দিয়ে বসে ‘ড্রাগ’ নিচ্ছিল। যেহেতু এই এক্সিটটা একটু অন্ধকার এবং কম লোকই ব্যবহার করে, সেহেতু এরা এই জায়গাটাই বেছে নেয়। সুযোগ পেলে যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে সর্বস্ব ছিনিয়েও নেয়! অথচ নিচেই ট্রানজিট পুলিশ প্রিসিঙ্কট। সে একটু ভয় পায়। তাড়াতাড়ি এক্সিট বদল করে অন্য এক্সিট দিয়ে রওনা দেয়। যাওয়ার সময় কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল দু’পা দুদিকে ছড়িয়ে ফোন টেপাচ্ছে আর চুইংগাম চিবোচ্ছে। বিষয়টা সে তাদেরকে বললে তাদের কোনো ভাবান্তর বা কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না! ছোট্ট একটা উত্তর, ‘ওকে উই উইল টেককেয়ার দেট’ বলে তারা আগের দৃশ্যতেই ফিরে গেল। টাইমস স্কয়ারের মতো স্টেশনের এই পরিবেশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। না জানি পর্যটকেরা কত ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরে! এখন তাকে রাস্তা ক্রস করে বাস ধরতে হবে। ওয়াক সাইন আসছে না, এর মধ্যে দেখা গেল তার বাস বাসস্টপে এসে হাজির। একজন মাত্র প্যাসেঞ্জার নামল, ওঠার মতো কেউ নেই। লেট নাইটে তেমন একটা প্যাসেঞ্জার থাকে না। এখনো আশা আছে ধরা যাবে। সাইন চেঞ্জ হলে সে এক দৌড় লাগায়। বাস ড্রাইভার দরজা বন্ধ করার মুহূর্তে সে গিয়ে হাজির। কিন্তু ড্রাইভার দরজাটা তার মুখের ওপর বন্ধ করে দিল! বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এবং একই ইউনিফর্ম পরা দেখেও ড্রাইভার পাত্তাই দিল না! বিশালদেহী কালো ড্রাইভার তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে একধরনের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বাসে টান দিল। তার প্রতি এ রকম রূঢ় আচরণ সে সহজভাবে নিতে পারছিল না। একই ডিপার্টমেন্টের এমপ্লয়ি দেখেও সে এমনটি করল! আশ্চর্য! কী কারণ হতে পারে? কোনো কোনো ড্রাইভার তাকে হেঁটে যেতে দেখলে মাঝ রাস্তায় থামিয়ে হলেও বাসে তোলে। ও এমন করল কেন? বাসের ভেতরে বড়জোর চার কি পাঁচজন প্যাসেঞ্জার হবে। তাকে দেখে হয়তো ড্রাইভারের পছন্দ হয়নি! এ কথা ভেবে নিজেই কিছুক্ষণ হাসল! ছোটখাটো বিশেষত্বহীন, ব্যক্তিত্বশূন্য, গো-বেচারা টাইপ চেহারা। বাঙালিরাই পাত্তা দেয় না আর এ তো আমেরিকান কালো! নাকি এশিয়ান এমপ্লয়ি দেখে হিংসা করল? আবারও তার মেজাজ খারাপ হয়। না! এই ড্রাইভারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেই হবে। এরা অনেক পর্যটকের সঙ্গেও কোনো কারণ ছাড়াই এমন আচরণ করে। তার অনেক উদাহরণ আছে! সে তারিখ, সময় এবং বাসের নাম্বার টুকে রাখল। এর মধ্যে তার স্ত্রীর কল, ‘কত দূর তুমি? এখনো ট্রেনে? এত দেরি? কোনো সমস্যা?’ ‘আর বোলো না, এই মাত্র বাসটা মিস করলাম! মিস করলাম কী, ড্রাইভার আমাকে দেখেও দরজা বন্ধ করে দাঁত কেলিয়ে চলে গেল!’ বলে ড্রাইভারকে গালাগাল করতে থাকলে তার স্ত্রী থামায়, ‘তোমার মুখ এত খারাপ হলো কবে থেকে? বন্ধ করো তো গালাগাল, পরের বাস কটায়?’ স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে বলে, পরের বাসের অপেক্ষা করলে বাসায় আসতে রাত পোহাবে! আমি হেঁটেই আসছি। রাগে গজগজ করতে করতে সে হাঁটা দেয় আর মনে মনে বাস ড্রাইভারের বিরুদ্ধে কীভাবে অভিযোগ করা যায়, তার একটা খসড়া করতে থাকে।
আর একটা ব্লক পার হলেই তার বিল্ডিং। কিন্তু ওখানে কী হয়েছে? পুরো ব্লক পুলিশের ‘ব্যারিকেড’, কাউকে ওদিক দিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বিকল্প পথ দেখিয়ে সবাইকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর ফায়ার ফাইটার আর অ্যাম্বুলেন্সের ফ্লাশলাইটের আলোয় চোখ খোলা যাচ্ছিল না! নিউইয়র্কের বেশ কয়েকট টিভি চ্যানেলের গাড়িও দেখা যাচ্ছে। লাইভ নিউজ কভারেজ হচ্ছে! চারদিকে ধোঁয়া আর পেট্রোলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পেট্রোলের গন্ধ কেন? কোনো নাশকতামূলক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয় তো? ঘটনা কি তার বিল্ডিংয়ে? এই সামান্য সময়ে এত কিছু? কিছুক্ষণ আগেও তো তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে, ও তো কিছু বলেনি! স্ত্রীকে কি আবার কল দেবে? একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলে জানা যেতে পারে। এই দেশের পুলিশ সহজে কোনো কিছু বলতেও চায় না, এমনকি চাক্ষুষ সাক্ষী হলেও না। বাংলাদেশের পুলিশ সেদিক দিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড বেস্ট’। তারা সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো ঘটনা বুঝতে পারে, কে ঘটিয়েছে? কারা আগুন দিয়েছে? কারা খুন করেছে? এসব এক সেকেন্ডে কোর্টে প্রমাণ হওয়ার আগেই বলে দিতে পারে! সে একজন পুলিশ অফিসারের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলে অফিসার বোধ হয় তাকে ‘এমটিএ এমপ্লয়ি’ দেখে ঘটনার প্রায় পুরোটাই বর্ণনা করল-একটা বাস বিল্ডিংয়ের কাছ দিয়ে অতিক্রম করার সময় ওই বিল্ডিংয়ের কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য রাখা সুউচ্চ ক্রেন হঠাৎ করেই অজ্ঞাত কারণে ‘কলাপ্স’ হয়ে বাসের ওপর পড়ে এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে বাসে আগুন লেগে যায়! ড্রাইভার ‘স্পট-ডেড’, ভেতরের তিনজন যাত্রী পুরোই অঙ্গার, একজনের প্রায় ৯০% দগ্ধ। বাসের আগুন নেভাতে অনেকক্ষণ লেগেছে! বাস পুড়ে কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। পুলিশের বর্ণনা শুনে সে ভাবল, হয়তো ‘ট্যুরিস্ট বাস’ হবে। এই এরিয়ায় সাধারণত এ ধরনের বাস দিনরাত ট্যুরিস্ট নিয়ে চলাচল করে। কী বাস জিজ্ঞেস করতে মধ্যবয়সী পুলিশ অফিসার উত্তরে বলল, ‘ক্রসটাউন বাস’! জাস্ট অ্যারাইভড অ্যান্ড এক্সিডেন্ট হেপেন্ড! আই হ্যাভ নেভার সিন বিফোর ইন মাই লাইফ, সো স্যাড!’ এ কথা শুনতেই সে ধপাস করে রাস্তায় বসে পড়তে গেলে পুলিশ অফিসার দ্রুত তার হাত ধরে বলে, ‘হেই ম্যান, আর ইউ ওকে?’ ততক্ষণে সে নিজেকে সামলে নেয়। উঠে বলে, ‘সরি! আই অ্যাম ফাইন! থ্যাঙ্ক ইউ!’
বিকল্প রাস্তা ধরে সে কীভাবে যে তার বিল্ডিংয়ের সামনে হেঁটে এল, বুঝতে পারছিল না। তার দুই পা অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। সারা শরীর ভয়ংকরভাবে কাঁপছিল আর ঘামছিল। বিল্ডিংয়ের মেইন ডোর চাবির রিঙের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট একটা ডিভাইস দিয়ে স্ক্যান করে খুলতে হয়। আজ সেটা সে ভুলে গিয়ে দরজায় ধাক্কা লাগায়। সিকিউরিটি গার্ড তাকে টেনেন্ট হিসেবে চিনে দৌড়ে এসে ডোর খুলে দেয় আর কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাকে ‘গুড মর্নিং স্যার’ বললে সে তারও কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা এলিভেটরের দিকে এগিয়ে যায়। নিজ অ্যাপার্টমেন্ট চাবি দিয়ে খোলার কথাও আজ সে ভুলে যায়, জোরে দরজায় নক করতে থাকে। এত রাতে সন্তানেরা ঘুমে সেটা চিন্তা করার মতো অবস্থা তার নেই।
তার স্ত্রী ‘কী হলো’, তাকে দেখে আশ্চর্য হয়! দরজা খুলে অনেকটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার, তুমি আজ চাবি নাওনি? বাচ্চারা ঘুমুচ্ছে জানো না? আর দরজায়ই-বা নক করলে কেন? ডোর বেল কী হয়েছে! ছেলেটা বোধ হয় উঠেই গেছে! কী হয়েছে? তুমি এমন করছ কেন?’ সে কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ‘ব্যাকপ্যাক’ ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোনোক্রমে পায়ের জুতো খুলে সোজা লিভিংরুমের সোফায় গিয়ে ধপাস করে বসেই স্ত্রীর কাছে এক গ্লাস পানি চায়। ‘এই তোমার কী হয়েছে, তুমি এ রকম ঘামছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’ বলে দৌড়ে স্ত্রী পানি নিয়ে এলে সে বলে, ‘আমার ছেলেমেয়েদের ডেকে তোলো।’ ‘কী?’ তার স্ত্রী অনেকটা চমকে প্রশ্ন করে। ‘ছেলেটা ঘুমিয়েছে, সকালে স্কুল, জানো না? মেয়ের কী একটা অ্যাসাইনমেন্ট এখনো শেষ হয়নি।’ স্ত্রী বলতে থাকলে সে বলে, ‘ডাকো ওদের।’ ‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? অ্যাম্বুলেন্স ডাকব?’ বলতে বলতে তার স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে মেয়েকেও রুম থেকে ডেকে আনে, ‘দেখ তো তোর আব্বু কেমন যেন করছে, তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স কল কর।’ ইতিমধ্যে ছেলেও ঘুম থেকে উঠে লিভিংরুমে চোখ কচলাতে কচলাতে চলে আসে। ‘অ্যাম্বুলেন্স কল করতে হবে না, আমি এখন ঠিক আছি’ বলে সে দুই সন্তানকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বসে স্ত্রীকেও  কাছে বসতে বলে, এক চুমুকে পুরো গ্লাস পানি শেষ করে! তার স্ত্রী আবারও জানতে চায়, শরীর বেশি খারাপ লাগছে কি না? তার উত্তর না দিয়ে সে বলে, ‘টিভিটা একটু ছাড়ো তো।’ এখন তাকে কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে। তার সন্তানেরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতভম্ব! তাদের আব্বুর এমন আচরণের সঙ্গে তারা মোটেই পরিচিত নয়!
নিউইয়র্ক ওয়ান চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে এমন ভয়াবহ এবং হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারছে না। বিশেষ করে, সিটি বাসে আগুনে পুড়ে মানুষ মরা! টিভি স্ক্রিনের নিচ দিয়ে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে ঘটনার পুরো বর্ণনা ক্রমাগত ‘ট্রল’ হচ্ছে। সবাই নিউজ দেখতে লাগল। হঠাৎ তার স্ত্রী চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ‘আরে, এ তো দেখি আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশে ঘটেছে, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ ফায়ার ফাইটার আর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনছিলাম। হায় হায় এ কী বলছে? চারজন মানুষসহ ড্রাইভার মারা গেছে! এটা কি ট্যুরিস্ট বাস? আহারে কত আনন্দ নিয়ে সিটি দেখতে হয়তো তারা এসেছিল! তুমি কি ওখানে ছিলে সেই সময়? এসব দৃশ্য দেখলে কি স্বাভাবিক থাকা সম্ভব? এখন বুঝেছি কেন তুমি এমন করছ! আমাকে না তুমি বলো আমি ভিতু, আজ তো দেখি তোমার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ!’ স্ত্রীর একসঙ্গে অনেকগুলো কথা শোনার পর সে আস্তে করে স্ত্রীকে বলে, ‘এটা কোনো ট্যুরিস্ট বাস ছিল না! এটা ছিল সেই ‘ক্রসটাউন বাস’, যা আমি ধরতে পারিনি, ড্রাইভার আমাকে উঠতে দেয়নি, আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করেছিল!’
-নিউইয়র্ক
কমেন্ট বক্স