Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

লেইলা ও লেইলা

লেইলা ও লেইলা
লায়লাকে যে আরব দেশের মানুষ ‘লেইলা’ উচ্চারণ করে, মাসকটে না গেলে আমার জানা হতো না। কীভাবেই-বা হবে! ওমানের রাজধানী মাসকটের আগে আর কোনো আরব দেশে আমি যাইনি যে!
ইয়েমেনি মেয়ে লেইলা দেখতে নামের মতো সুন্দর নয়! অতি সাধারণ চেহারা বলতে হবে। সেই কিনা প্রেমে পড়ে গেল অতি সুদর্শন ওমানি যুবকের! ওদের পরিচয়-পর্ব আমার সামনেই ঘটেছিল। তারপর কী হলো বলি...।
ইয়েমেনি তরুণীরা এত দিন জানতাম অনিন্দ্যসুন্দরী হয়। লেইলার চেহারা সেই তুলনায় বেশ সাদামাটা, গায়ের রং গাঢ় শ্যামলা বর্ণের। আমি ছাড়া সেবার পুরো ওমানে ওর চেহারা সম্ভবত আর কেউ দেখেনি। কীভাবে দেখবে বলেন! ও তো সারাক্ষণ মুখ কঠিন নেকাবে ঢেকে রাখে।
একদিন রাতে ডাইনিংয়ের নিরিবিলি এক কোণে ডিনার করছিল লেইলা। হঠাৎ গিয়ে আমি সামনে বসলাম। খাওয়ার জন্য নেকাব খুলে রেখেছিল। সেই মুখ দেখে একটু চমকে উঠলাম। যারা সারাক্ষণ মুখ পর্দায় ঢেকে রাখে, হঠাৎ তাদের চেহারা দেখলে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয় আমার। এটা আমার আগেও হয়েছে।
ঘটনাটা ঘটেছিল ২০১২ সালের মে মাসে। বাংলাদেশ থেকে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম ওমানের এক কনফারেন্সে। প্রোগামটি ছিল এশিয়ান অলিম্পিক কমিটির। ওমানের রাজধানী মাসকটে শাংরালিরা রিসোর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রিসোর্টে গিয়ে মনে হলো স্বর্গ যেন পৃথিবীতে নেমে এসেছে। এত অসম্ভব সুন্দর চারপাশ। নীল জলের সমুদ্র রুমের সামনে। এত বিলাসবহুল রুমে তার আগে আমি কখনো থাকিনি।
দিনে তিন থেকে চারবার ড্রেস পাল্টে আমি হাজির হই পাঁচ সপ্তাহের ক্রীড়া-বিষয়ক ওয়ার্কশপে। কাতার আর কুয়েতের মেয়েরা আমাকে দেখে হিংসিত। ওরা করুণ স্বরে জানাল, একমাত্র কালো রঙের বোরকা ছাড়া আর কোনো ধরনের পোশাক পরার সুযোগ ওদের নেই।
তবু তখন কুয়েত, কাতার আর ওমানের মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর চেয়ে কিছুটা অগ্রসর। ওরা বাইরে এসে কাজ করার আর পড়াশোনার সুযোগ পায়। মুখ ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়। সৌদি আরব আর ইয়েমেনি নারীদের সেই সুযোগও ছিল না। ইরানি নারীরা হিজাব পরলেও পোশাক-আশাকে দারুণ স্মার্ট দেখলাম।
ওই সেমিনারে গিয়ে আমি আসলে একটা বিষয়ে খুব দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। আমি আসলে ‘হিজাব’ এর পক্ষে নাকি বিপক্ষে বুঝতে পারছিলাম না। শৈশব থেকে পরিবারের কাউকে হিজাব পরতে দেখিনি। তবে আমার এক জর্ডানি বন্ধুর কথায় অন্য রকম বোধোদয় হলো।
‘হিজাব পরা একটি মেয়ের স্বাধীনতা, সে কী করবে, সেটা তার ওপর ছেড়ে দিতে হবে!’
আমার সেই জর্ডানি বন্ধু কিন্তু দারুণ আধুনিক। পোশাকে ও চেহারায় ইউরোপিয়ানদের মতো। জর্ডানের নামকরা ক্রীড়া সাংবাদিক ও। বিশ্বকাপ ফুটবল আর অলিম্পিক গেমস কভার করেছে এক-দুবার নয়, একাধিকবার।
আমাদের ওই সেমিনারে আলোচনা উঠল, খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের হিজাব করা নিয়ে। খেলোয়াড়দের হিজাব ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি বা আইওসি। এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হলো। আমার জর্ডানি সাংবাদিক বন্ধু জানাল :
‘মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশে হিজাব পরা ঐতিহ্যের একটি অংশ। তারা আবহাওয়ার কারণেও এটা পরে।’
এশিয়ার সব মুসলিম দেশের অবস্থা কিন্তু একরকম নয়। লেবানন, জর্ডান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানের মেয়েরা পোশাক-আশাকে অনেক বেশি খোলামেলা। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে করুণ দশা সৌদি আরবের। মক্কা-মদিনার দেশ থেকে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিল না সেই সম্মেলনে। যদিও শুনছি, এখন সৌদি নারীদের অবস্থা পাল্টেছে। ইয়েমেন থেকে একা এসেছিল লায়লা বা লেইলা।
সম্মেলনের শেষ দিনে জানানো হলো, সবাই নিজেদের মতো ঘুরতে পারবে। আমি তো এখানে কোনো জায়গা চিনি না, কোনো মানুষকে চিনি না, কোথায় আর ঘুরব! আবহাওয়া প্রচণ্ড গরম তখন। তাই গাইডের সহযোগিতায় শপিংমলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গাইড কাম ড্রাইভার হিসেবে ওরা একজনকে পাঠাল আমার জন্য।
ওমানি পুরুষেরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের তুলনায় বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল সেবার। ওরা লম্বা আলখেল্লার সঙ্গে কোমরে খঞ্জর নিয়ে ঘোরে। তেমন গায়ে আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি পরা এক সুদর্শন তরুণ এল আমাকে শপিংমলে নিয়ে যেতে। হঠাৎ করে শেষ মুহূর্তে লিয়াজোঁ অফিসার এসে জানালেন, লেইলাও আমার সঙ্গে যাবে।
গাড়িতে ওঠার পরে দেখলাম, গাইড কাম ড্রাইভার বাম দিকে বসা। আমি তখন বাংলাদেশে ছিলাম বলে বাম দিকে ড্রাইভিং সিট আগে কখনো দেখিনি। আমি ড্রাইভারের পেছনে বাম দিকে বসলাম আর লেইলা আমার পাশে ডান দিকে। গাড়িতে ওঠার পরে ইয়েমেনি তরুণী আর ওমানি যুবকের যে কথা শুরু হলো, সেটা আর থামে না।
দুই পাশের পাহাড়ের মধ্যে খিরিগাদের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল গাড়ি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ দুজনে কথা বলে গেল। আরবি ভাষায় কথা বলছিল ওরা। ফলে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার হাতের মোবাইলে ইন্টারনেটও নেই যে কিছু করব। আমি লেইলা নামের মেয়েটার আক্কেল দেখে অবাক হচ্ছিলাম! আমি যে পাশে বসে আছি, এটা মনে হয় ওর মাথাতেও নেই। অপরিচিত দুজন নারী-পুরুষ যে এত কথা বলতে পারে, আমার ধারণায় ছিল না।
চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম, নারী আর পুরুষের আকর্ষণ সহজাত। যতই পোশাকের আবরণে মুড়িয়ে রাখা হোক না কেন, আবেগের বাঁধ যখন ভেঙে যায়, তখন কথা যেন দুই কূল ছাপিয়ে নামে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে ইয়েমেনি মেয়েটি অপার স্বাধীনতা পেয়ে আবেগে দিশেহারা হয়ে গেছে।
একসময় আমরা শপিংমলে এলাম। লেইলা আর আমি কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পরে আলাদা হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি তাকে হারিয়ে ফেললাম। তাকে যে চেহারা দেখে খুঁজে বের করব, সেই উপায় নেই। কারণ তার মুখ নেকাব দিয়ে ঢাকা। শপিংমলে বহু নারী কালো বোরকা পরে চোখমুখ ঢেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে লেইলাকে আলাদা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। দুজনের কারও কাছে স্থানীয় ফোন নম্বর নেই। তাই কাউকে ফোনও করতে পারছিলাম না।
আসার আগে আমাদের লিয়াজোঁ অফিসার বলেছিলেন, দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেললে গাড়ির কাছে চলে যেতে। অনেকক্ষণ খুঁজে লেইলাকে না পেয়ে বেসমেন্টে গাড়ির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি গাড়িতে উঠতেই দেখি, ও আগেই সিটে বসে আছে। তবে এবার সে বসেছে ফ্রন্ট সিটে। মনে হলো অনেকক্ষণ আগেই চলে এসেছে সে!
এবার আমার মেজাজ আগের বারের চেয়েও খারাপ হলো। মনে হলো, লেইলার মতো ফালতু মেয়েমানুষ এর আগে জীবনে দেখিনি। আসার পথে দুজনের বকবকানি আগের চেয়ে তুমুল বেগে চলতে লাগল। শপিংমল থেকে লেইলা একটা ঘড়ি কিনেছে। সেটা দেখাতে লাগল ওমানি ড্রাইভার কাম গাইডকে। নানাভাবে চেষ্টা করলাম, ওদের দিকে মনোযোগ না দিতে! কিন্তু কিছুই করার নেই মনোযোগ না দেওয়া ছাড়া!
রাতে ক্যাফেটারিয়ায় বসে খাচ্ছি, হঠাৎ আমার সামনের চেয়ারে এসে বসল লেইলা। আমার মতো বুফে থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। এমনভাবে বসল, যাতে আশপাশে কেউ ওর মুখ দেখতে পারে। বসা নিশ্চিত করার পরে ও মুখের নেকাব খুলল। ওর দিকে তাকিয়ে মেজাজ খারাপের পাশাপাশি মনে হলো, চেহারা ভালো না হওয়াতে দেশে হয়তো বিয়েশাদি হচ্ছে না, বিদেশে এসে সুদর্শন ড্রাইভার দেখে পটে গেছে। ভাগ্যিস, ড্রাইভার তোমার চেহারা দেখেনি! দেখলে কি আর এত গল্প করত!
ওমান থেকে দেশে ফেরার কিছুদিন পরে আমার কাছে লেইলার ইমেইল এল। আয়োজকদের তালিকা থেকে ও সম্ভবত আমার ইমেইল অ্যাড্রেস সংগ্রহ করেছে। আমার কাছে ওমানি সেই ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর আছে কি না জানতে চাইছে ও! আমি জানালাম, আমার কাছে ড্রাইভারের নম্বর নেই। তবে লিয়াজোঁ অফিসার যে ভদ্রলোক আমাদের শপিংমলে পাঠিয়েছিলেন, তার নম্বর আছে। লেইলা সেই নম্বরটা পাঠাতে বলল। তারপর কী হলো জানি না! দুজনে বকবক করতে এত ব্যস্ত ছিল যে ফোন নম্বর বিনিময়ের সুযোগও পায়নি।
প্রায় ১২ বছর পরে এস্টোরিয়ার এক জিমে গিয়ে পেলাম আরেক লেইলাকে। ওখানে একটা জুম্বা ক্লাসে নিয়মিত অংশ নিতাম সেই সময়। জুম্বা ক্লাসের ইনস্ট্রাক্টর ম্যাবেল একটা বিরতি দিত বেলি ড্যান্সের। তখন একটা অসম্ভব সুন্দরী ও চমৎকার ফিগারের মেয়ে লিড দিত। আমি ভেবেছি মেয়েটা হয়তো গ্রিক হবে! আরব মেয়েরা এতটা খোলামেলা পোশাকের হতে পারে ভাবিনি।
একদিন সনা রুমে বসে আছি একা। হঠাৎ ওই মেয়েটি এসে বসল আরেকজনসহ। ওরা দুজনে ইংরেজিতে কথা বলছিল। ওদের কথায় জানলাম, বেলি ড্যান্সার মেয়েটির নামও লেইলা। ও তিউনিসিয়ান আরব। অনলাইনে এক মরক্কান ছেলের সঙ্গে পরিচয়ের পরে বিয়ে করে আমেরিকায় এসেছে ও। লেইলা নামের মেয়েটি এখানে প্যারা লিগ্যাল নিয়ে পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যতে অ্যাটর্নি হতে ইচ্ছুক। এ ব্যাপারে মরক্কান স্বামীর সহযোগিতার কথা বলল। কিছুদিনের মধ্যে আবিষ্কার করলাম, লেইলার মরক্কান স্বামীও এই জিমের সদস্য। স্বামী নিশ্চিত হলাম এই জন্য যে দুজন দুজনকে চুমু দিচ্ছিল জিমে আসা-যাওয়ার পথে।
ওদের দিকে তাকিয়ে আমার বহুকাল পরে মনে হলো ইয়েমেনি তরুণী লেইলার কথা। ও কি শেষ পর্যন্ত ওমানি পুরুষটির নম্বর পেয়েছিল! তারপর ওদের কি কোনো সম্পর্ক হয়েছিল!
-নিউইয়র্ক
কমেন্ট বক্স