সময়টা গত বছরের মার্চের শেষ ভাগ। নিউইয়র্কে তখন শীত-বসন্তের দোলাচল। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ড শহরে একটি কনফারেন্সে যোগদান শেষে নিউইয়র্কে যাই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাতে। পোর্টল্যান্ড থেকে ডালাস হয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে ঘটে নানা বিড়ম্বনা। মধ্যরাতে ফ্লাইট বাতিলের পর ডালাস বিমানবন্দরেই কাটে রাত। পরদিন নর্থ ক্যারোলাইনার শাটল বিমানবন্দর হয়ে নিউইয়র্কে লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দরে পৌঁছাই। ক্লান্তিকর জার্নি শেষে বিমানবন্দর থেকে বের হতেই বৃষ্টিভেজা, গুমোট সন্ধ্যা নিউইয়র্কে স্বাগত জানায় আমাকে।
নিউইয়র্কের বাঙালি-অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসা হয় আমার ভ্রমণকালীন ঠিকানা। পরদিন সকালে রোদের দেখা মেলে। উষ্ণতার খোঁজে বাসার সামনে খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ পার্কিংয়ে থাকা একটি গাড়িতে চোখ আটকায়, দেখি ‘ঠিকানা’ পত্রিকা। বুকটা ধক করে ওঠে। ভেতরে ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। আহা ‘ঠিকানা’!
‘ঠিকানা’, আমার আবেগ-ভালোবাসার ঠিকানা। দীর্ঘদিন ধরে ‘ঠিকানা’য় ‘সিলেটের চিঠি’ শিরোনামে ধারাবাহিক লিখে এলেও ছাপা পত্রিকার ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। যদিও নিউইয়র্কে যাওয়া নিশ্চিত হতেই ‘ঠিকানা’ অফিসে যাওয়ার ইচ্ছাও মনে মনে পুষে রাখি। আমার মাসতুতো ভাইকে এই ইচ্ছার কথা জানাতে গিয়ে জানতে পারি, নিউইয়র্কে ‘ঠিকানা’র তুমুল জনপ্রিয়তার কথা। তার সঙ্গে এক রাতে খাবারের পর জ্যাকসন হাইটসের ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে পেয়ে যাই ‘ঠিকানা’ অফিসের অবস্থান।
ভাইয়ের বাসা থেকে পায়ে হাঁটাপথ দূরত্বেই ‘ঠিকানা’ অফিস। জ্যাকসন হাইটসের বাণিজ্যিক একটি ভবনের তৃতীয় তলায় ‘ঠিকানা’ অফিস। ‘ঠিকানা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এম এম শাহীন ভাইয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে পরদিনই অফিসে বেড়াতে যাই। তখন রমজান মাস। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ভাবগম্ভীর পরিবেশ নেই। দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই দেখি, বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর মতোই পুরোদস্তুর একটি পত্রিকা কার্যালয়Ñসবাই যার যার মতো ব্যস্ত। কম্পিউটার সেকশন, বার্তা, বিজ্ঞাপন সবাই নিজের মতো করে কাজে মনোযোগী। চমৎকার পেশাদারত্ব সবার। শাহীন ভাই এক এক করে পরিচয় করিয়ে দেন পত্রিকার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকসহ অন্য সবার সঙ্গে। আহাদ সেলিম ভাইকে পেয়ে যাই দরজার আরেক পাশে। আমাদের ‘মানব ঠিকানা’র দিনগুলো, কুলাউড়ার স্মৃতিগুলো বেজে ওঠে। আলাপ জমে, দেশের কথা ওঠে, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে ভাববিনিময় হয়। ঢাউস সাইজের এই পত্রিকা কীভাবে প্রকাশিত হয়, তা নিয়ে আমার কৌতূহলের জবাব দেন কেউ কেউ। টেলিফোন বাজছে। বিজ্ঞাপন নিয়ে সশরীরে আসছেন কেউ কেউ। শাহীন ভাইয়ের টেবিলে গিয়ে বসি। দেখি, নিউইয়র্কে বসে তিনি ঢাকাকে মনিটরিং করছেন। পেজ মেকআপ করছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন মুহুর্মুহু। তুমুল ব্যস্ততা সবার মধ্যে। ফাঁকে আমাকেও দিচ্ছেন হৃদয়ের উষ্ণতা।
‘ঠিকানা’ পত্রিকাটাকে আমার কাছে একটা বিস্ময়ের মতো মনে হয়। একটা বাংলা পত্রিকা তাও আবার প্রবাসের মাটিতে, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। পেশাদারত্ব এবং বস্তুনিষ্ঠতা না থাকলে কীভাবে একটি সংবাদপত্র প্রবাসী বাঙালির মুখপত্র হয়ে ওঠে! নিউইয়র্কে যত দিন ছিলাম, যেখানেই যাই, হোক তা কারও বাসা, সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা গ্রোসারি সুপারশপÑসবখানেই দেখি ‘ঠিকানা’। আমার বুঝতে বাকি থাকে না, ‘ঠিকানা’ আসলে তত দিনে হয়ে উঠেছে প্রবাসী বাঙালির প্রতি সপ্তাহের সুখ, দুঃখ, সমস্যা, সম্ভাবনার এক নিটোল ঠিকানা। টের পাই নিউইয়র্কের প্রত্যেক বাঙালির কাছেই ‘ঠিকানা’ সপ্তাহান্তের একটি নির্ভরযোগ্য দলিল হয়ে উঠেছে। দেখি, বাঙালি পাঠক মানেই ‘ঠিকানা’য় ভরসা রাখেন। আমাকে পুলকিত করে এই নানারঙা অনুভূতিগুলো।
সেই ‘ঠিকানা’ এবার পঁয়ত্রিশে পা রাখছেÑএ সংবাদটা আমার কাছে পরম আনন্দের। বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনের শত ব্যস্ততা, শত সংকট মোকাবিলা করে ‘ঠিকানা’ পথ চলছে স্বীয় আলো ছড়াতে ছড়াতে। শুধু সংবাদ প্রকাশই নয়, প্রবাসী বাঙালির ন্যায্য দাবি কিংবা অধিকার আদায়ে ‘ঠিকানা’র সংশ্লিষ্টতা বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো, যার স্ফূরণ দেখা যায় পত্রিকার প্রতিটি পাতায়। বিশেষ করে, দেশের সঙ্গে প্রবাসের সেতুবন্ধ রচনায় ‘ঠিকানা’র ভূমিকা অগ্রগণ্য।
তাই পঁয়ত্রিশের শুরুতে আমার বুকভরা বিশ্বাস, ‘ঠিকানা’ এগিয়ে যাবে বহুদূর। পেশাদারত্ব দিয়ে জয় করে নেবে পাঠকের মন। আজকের শুভলগ্নে আমি অভিনন্দন জানাই পুরো ‘ঠিকানা’ পরিবারকে।
লেখক : সংগঠক ও সহযোগী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।