কয়েকদিন আগে খাওয়ার কোনো সমস্যার কারণে হয়তো আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নানরকম ওষুধপথ্যের পাশাপাশি চললো ওরাল স্যালাইন। ওরাল হোক আর শিরা ফুটো করে হোক আমরা ঐ পানিটাকে স্যালাইনই বলি। কিন্তু এই স্যালাইন খেতে খেতে মনে পড়ে আমার আম্মা, মানে মায়ের কথা। আমরা যখন ছোঁ ছিলাম, আম্মা পাটির ওপর আমাদের বসিয়ে ভাত বেড়ে দিতেন। আমরা খেয়ে উঠতাম। এর মধ্যে কোনো ভাইবোন হয়তো বলে উঠলো, আম্মা, বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। পেট ব্যথা করছে, আম্মা অমনি তাকে বলতেন হা কর, আমরা হা করতাম, আর আম্মা দু আঙুলে এক চিমিটি লবণ নিয়ে আমাদের বেশি খেয়ে-ফেলা ভাই বোনের জিভে ঘসে দিতেন। বলতেন, এবার চেটে চেটে লবণটা খাও তারপর পানি খাও। সব হজম হয়ে যাবে। এই সরল প্রতিষেধকটিকে আম্মা বলতেন ‘নুনপানি’। ছোঁবেলায় আমরা নুনপানিতে এত অভ্যস্ত ছিলাম, যে খাওয়া শেষ করে উঠবার আগে নিজেরাই নুনপানি খেয়ে নিতাম। বিশেষ করে রাতের খাবারের পর আম্মা যদি কোনোদিন ভুলে যেতেন, অমনি আমরা চেঁচিয়ে উঠতাম, আম্মা নুনপানি! ‘নুনপানি’ একটা চমৎকার পরিভাষা। স্যালাইন ওয়াাঁর বা ওরস্যালাইন হয়তো সেই ‘নুনপানি’রই আধুনিক সংস্করণ। এ যুগে এসে স্যালাইন ওয়াাঁর বা স্যালাইন শব্দের কোনো বাংলা রূপান্তরেরও দরকার পড়ে না। ‘স্যালাইন’ই পরিভাষা। এ ইংরেজি শব্দটিকে কেউ চেনে না বা বোঝে না এমন মানুষ বোধ হয় এখন ভূ-ভারতে নেই। তবে ‘নুনপানি’ এই সহজ বাংলা শব্দটিকে বোধ হয় অনেকেই সঠিক অর্থে চিনবে না।
আম্মা আর একটা শব্দ বলতেন ‘ধুকধুকি’। লালন তাঁর গানে ‘অচিন পাখি’ রূপী আত্মা বা আত্মস্বরূপের সন্ধানে ব্যাকুল মনের কথায় বলেছেন, ‘চেনাল পেলে চিনে নিতাম যতো মনের ধুকধুকি’! কিন্তু লালনের গানে ‘ধুকধুকি’-র মানে দ্বন্দ্ব, সন্দেহ। আম্মা ধুকধুকি বলেতেন হার্টবিটকে। বুকের ভেতরে বসে যে জিনিসটা ধুক ধুক করে জীবনের জানান দিচ্ছে সেটাই ধুকধুকি! প্রাণ! ‘প্রাণ’-এর এত সুন্দর একটা বাংলা প্রতিশব্দ ধুকধুকি! আম্মার ভাষা ছিল সরল জীবনের জলে ধোয়া আর সহজিয়া ভাবনার রঙে রাঙানো, প্রাণবন্ত।
আমার নানিশাশুড়ি, প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে তিনি অনন্তলোকে চলে গেছেন, আমাকে খুব ভালোবাসতেন। শ^শুরবাড়িতে আমি সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকি, নাওয়া খাওয়ার দেরি হয়ে যায়। তো তিনি হেসে হেসে আমাকে বলতেন, “কী গো বইন, তোমার প্যাটে তাও লাগে না?” ‘তাও’ মানে তাপ, মানে পেটে তাপ লাগে না? অদ্ভুত সুন্দর সহজিয়া জীবনের শব্দ। ক্ষুধা তো আগুনই! ক্ষুধা লাগলে তো সেই আগুনের তাপই পেটে টের পাওয়া যায়! ক্ষুধাকে বাংলা ভাষায় পেটে আগুন, ছুঁচোর কেত্তন, নাড়িভুড়ি হজম Ñ এরকম নানা শব্দবন্ধে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু নানী শাশুড়ির মুখের সেই ’প্যাটে তাও’ কথাটি যেন একেবারে ব্রহ্মশব্দ! তাঁরই বলা কথা থেকে আর-একটি চমৎকার পারিভাষিক শব্দ আমি আমার ভাষা-অভিজ্ঞানে তুলে রেখেছি। একদিন নানী শাশুড়ি তাঁর বাবার গল্প করছিলেন আমার কাছে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘বাবা পালং-চা খেতেন’! মানে বেড-টি! ঘুম ভেঙে শয্যায় বসেই যে চা খাওয়া হয়। ভাষার মদমত্ত দৌড়ের এই যুগে কেউ যদি বেড-টিকে ‘পালঙ্ক-চা’ বা পালং-চা বলেন তাহলে হয়তো তার কাছে চায়ের স্বাদই যাবে মাটি হয়ে। কিন্তু আমার কাছে এই ‘পালং-চা’ শব্দটি কী যে মিষ্টি আর মাদকতাময়, তা বলে বোঝাতে পারবো না!
সোনার গাঁয়ে ডাক্তারি করতেন আমার চাচাশ্বশুর। একবার সেখানে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম চাচিশাশুড়ির কাজকর্মে সাহায্য করছে একটি সাত-আট বছরের বালিকা। মেয়েটি একদিন মন খারাপ করে বসে আছে। চাচাশ^শুর আদরের সুরে বললেন, কী নাতিন, মুখ কালো কেন, কী হয়েছে? মেয়ে মুখ ব্যাজার করে উত্তর দিল, ‘নানা, আমি বাড়িত যামু গা, মার নিগা খালি প্যাঁ পোড়ে!’ প্যাঁ পোড়ে! শব্দটি শুনে আমি চমকিত হই। মানে মাকে সে ‘মিস করছে’! এখানেও পেটে আগুন! কিন্তু আগুনটা স্নেহপ্রেম ভালোবাসার অভাব বোধের। এ আগুনে মন পোড়ে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধিকা বলেছে, ‘মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পুণী’। অর্থাৎ কৃষ্ণকে না দেখে রাধিকার মন যেন বিরহের আগুনে কুমোরের পুইনের মত পুড়ছে। সেই মন পোড়ানো শব্দ সরল জীবনের ছায়ায় এসে হয়েছে প্যাঁ পোড়ানো। জীবনসংগ্রামে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত মানুষের কাছে মন বলে ব্যাপারটা গৌণই থাকে। পেটই আসল। পেটের জন্যই দুনিয়া। তো মন পোড়ার চেয়ে ‘পেট পোড়ানো’ অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ। ‘মিস করা’ অনুভূতি প্রকাশক আরও অনেক শব্দ আছে- পরান পোড়ে, কলিজা জ¦লে, কলিজা পোড়ে ইত্যাদি। সবই অভাব বোধের তীব্রতার আগুনে ঝলসানো। ’মিস করা’-র মতো কৃত্রিম রঙে রাঙানো নয়। কিন্তু এখন আমাদের ভাষা থেকে এই জীবনঘনিষ্ঠ বাংলা শব্দগুলো হারিয়ে গেছে। গ্রামীণ মানুষও অনেকের মুখেই এখন ‘মিস করা’র মতো অনেক আধুনিক বা ইংরেজি শব্দ বাংলার মতোই সহজ হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে ‘হেডফোন’ বা ‘ইয়ার ফোন’-এর একটা চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছেন ‘কান-ফোন’। শব্দটি অবশ্য পুরো বাংলা নয়, ‘ফোন’ তো ইংরেজি ‘ফোন’-ই আছে, আবার সব ফোনই তো কানে লাগিয়ে শোনা হয়, সেখানে কানই বা এমন কি নতুন শব্দ! কিন্তু একটা বাঁকানো হোল্ডারকে মুকুটের মতো মাথায় বসিয়ে দুপাশের অডিও চাকতি দুটো কানে লাগিয়ে কথা শোনার যে পদ্ধতি হেড ফোনের, তা ঐ ‘কান-ফোন’ শব্দটির মধ্যে যেন সহজতায় আর চিত্রময়তায় মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। খুব সুন্দর শব্দ ‘কান-ফোন’!
সাহিত্যিক আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’ উপন্যাসে এমন একটি সহজিয়া আর সৃজনশীল পরিভাষা পেয়েছিলাম। সেটি হলো ‘জলচালুনি’। বাথরুমের শাওয়ারকে এ যুগে আমরা ‘শাওয়ার’ বলতেই ভালোবাসি। শাওয়ার এখন গ্রামগঞ্জের মানুষও অবলীলায় বলে, কারণ গ্রামের মানুষ অনেকেই এখন বাড়িতে দালান বানায়। ‘এটাচড বাথ’ থাকে, আর থাকে আধুনিক সব ফিটিংস। সেখানে শাওয়ার তো থাকবেই! এই শাওয়ারকে আমরা একসময় চমৎকার বাংলা শব্দেই বলতাম ‘ঝরনা’। কোথাও কোথাও ‘ঝাঁঝরি’ও বলতে শুনেছি। কিন্তু ‘জলচালুনি’ শব্দটি অদ্ভুত সুন্দর। এখানে আছে বাঙালি গৃহস্থালির নিত্যদিনের সরঞ্জাম ‘চালুনি’-র রূপকল্প। চালুনি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস চালা হয়। অজস্র ছিদ্র দিয়ে মিহি হয়ে চাল বা অন্য কিছুর গুঁড়ো পড়তে থাকে। জলচালুনিও তেমনি ফুটো দিয়ে অজস্র জলের গুঁড়ো ঝরিয়ে দিতে থাকে। ল-এর অনুপ্রাস এবং জ, চ-এর ধ্বনিসাম্য নিয়ে শব্দটির কাব্যিক দ্যোতনাও দারুণ আকর্ষণীয়।
গ্রামের মানুষ তাঁদের সরল জীবনযাত্রা আর অকৃত্রিম সহজ বোধ দিয়ে এমন অজস্র শব্দ তৈরি করে গেছেন, যা বাংলা ভাষাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এসব শব্দের মধ্যে প্রকাশ পায় তাদের সৃজনশীলতা ও জীবনঘনিষ্ঠ ভাবনা। আমার পিতৃগ্রাম মাতৃগ্রাম দুটোই বিক্রমপুর। বিক্রমপুরে ব্যবহৃত এমন অনেক পরিভাষা আছে যা শব্দ গঠনে অর্থময়তায় এবং কাব্যসৌন্দর্যে অতুলনীয়। নারীদের গর্ভধারণ, প্রসবকাল ইত্যাদি বিষয়ে গ্রামীণ মানুষেরা সৃষ্টি করেছেন এমন চমৎকার সব শব্দ যেগুলোর অর্থই শুধু নয়, তার গঠন, বিষয়ের অন্তর্নিহিত রূপ, গূঢ়ার্থ বা ভাবগত অর্থ প্রকাশেও অত্যন্ত দ্যোতনা সৃষ্টিকারী। আমরা আম্মার মুখে এমন একটি স্বপ্নসম্ভব শব্দ শুনতাম, সেটি হল ‘বাচ্চাদানি’। ফুলদানির আদলে সৃষ্ট শব্দ ‘বাচ্চাদানি’। আম্মা ইউটেরাস কী জানতেন না তাই বলার প্রশ্নই ওঠে না। জরায়ু শব্দও জেনেছেন অনেকটাই পরিণত বয়সে। কিন্তু ‘বাচ্চাদানি’ জেনেছেন তার যাপিত জীবনের পরিসরে অন্যান্য চেনা শব্দ ফুলদানি, পানদানি, আতরদানি, কাজলদানি, ধূপদানি ইত্যাদি থেকে। ইউটেরাস বা তার প্রমিত বাংলা পরিভাষা ‘জরায়ু’ (এ শব্দটাও খুব সুন্দর) মানে আমরা জানি, তবে ‘জরায়ু’ উচ্চারণকালে তার অবস্থান আর পূর্ণায়ত চিত্র কিন্তু ধরতে পারবো না। কিন্তু ‘বাচ্চাদানি’ বললে মুহূর্তেই আমরা মাতৃউদরে সুন্দর সুষমাময় ফুলের মত সাজিয়ে রাখা ভ্রƒণশিশুটির আদল যেন দেখতে পাই। মাতৃগর্ভই যেন সেই স্বর্গীয় ফুলদানি। প্রসব বা ভ্রƒণ বিষয়ক একটা পরিভাষা তো ‘ফুল’ই। আমার মায়ের মুখে শুনেই প্রথম এ শব্দ শিখেছি। শিশু জন্মের পর আর-একটা অন্ত্রের পিণ্ডের মত জিনিস এই ‘ফুল’ মাতৃ গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে। এই ফুল হলো গর্ভাবস্থায় ভ্রƒণ ও মায়ের দেহের মধ্যে যেসব অস্থায়ী টিস্যুর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হয়, তা। শিশুর আবাসস্থল জরায়ুকে আবৃত করে রাখা অপূর্ব গঠনশৈলির এই টিস্যুর পিণ্ডটিকে সত্যিই মনে হয় রক্তফুল। প্লাসেন্টার চলতি পরিভাষা হিসেবে ‘ফুল’ মোটামুটি সবার কাছেই চেনা শব্দ। প্লাসেন্টার প্রমিত বাংলার পরিভাষাটিও চৎকার। অমরা। অমরা মানে স্বর্গ। শিশুর ভ্রƒণটি যে মাতৃজঠরে বিকশিত হতে থাকে তা তো স্বর্গই! স্বর্গের মতো সুন্দর, নিরাপদ আর পবিত্র (যদিও হিংসার পৃথিবীতে বসবাস করা একজন মায়ের গর্ভও শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। সেখানে মাতৃগর্ভে থাকা শিশু পাষণ্ড পিতার লাথি খেয়ে মরে যায়, সন্ত্রাসীদের গুলি খেয়ে গর্ভে থাকা অবস্থায় চোখ হারায়, ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত মায়ের পেট ফেটে বেরিয়ে আসে বাচ্চা।) মায়ের মুখে শুনে শুনে আর একটি সুন্দর শব্দ শিখেছি, ‘পানিপাতা’।
র্ভবতী নারীর ফুলওয়ালা ব্যাগ এটি। গর্ভস্থ ভ্রƒণ একটি পাতলা পর্দার থলির ভেতরে জলের মতো তরলের মধ্যে বেড়ে ওঠে। অনেক সময় বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই এই ব্যাগটির পাতলা পর্দা ছিঁেড় যায়। ফলে সন্তান জন্মকে সহজ করে তোলে যে পানি সেটি আগেই বেরিয়ে যায়। আম্মা বলতেন ‘পানিপাতা ভেঙে যাওয়া।’ আম্মা আমাদের মা-হওয়ার সময় খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন যাতে পানিপাতা আগে ভেঙে না যায়। এখন পানিপাতা শব্দটিকে ব্যবচ্ছেদ করি! ওটা পানি-পাত্র। পাত্র হয়েছে পাতা। জলের কলসও তো ভেঙে যায়! সব জল তখন ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর পানিপাতাও তেমনি ভেঙে যায় শিশু জন্মের সময়, আবার কখনো বা আগেই! শব্দটি কিন্তু ভাঙে না। কারণ, সুন্দর সহজ নৈমিত্তিকতার গঠনসূত্রে বাঁধা এ শব্দ।
আমাদের অঞ্চলের বিবাহ বিষয়ক কয়েকটি চমৎকার শব্দের কথা বলে এ লেখা শেষ করি। আমাদের সমাজে এখন বিয়ে অনুষ্ঠানের এত এত পর্যায় আর এত সব সাজগোজ আচার অনুষ্ঠানের জমজমাট দামামা বাজে যে, সেসবের নাম লিখতে গেলেই আধপৃষ্ঠা লেগে যাবে। বিয়ের শতেক কথাবার্তার পরে যখন পাকা কথা হয়, এর পরে আসে পাত্রপাত্রীর বাগদান অনুষ্ঠান। অভিভাবকের পক্ষ থেকে পাত্রপাত্রীর হাতে আংটি বা প্রতীকী কোনো সামগ্রী তুলে দিয়ে বাগদান অনুষ্ঠান করা হয়। সে অনুষ্ঠানটিকেও আমরা এখন আর বাগদান বলি না, বলি ‘এনগেজমেন্ট’। মুর্খ শিক্ষিত নির্বিশেষে সবাই বলি। কারণ বাগদান অনুষ্ঠানের আড়ম্বর আর বহর এখন এত বেড়ে গেছে যে বাংলা শব্দ দিয়ে তাকে আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু একদিন এই ইংরেজি ‘সাহেব-শব্দটির’ কোথাও পাত্তা ছিল না। কিন্তু আমাদের অঞ্চলে (অনেক অঞ্চলেই) বিয়ের পাকা কথা হওয়ার অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘পানচিনি’। সেদিন ছেলে পক্ষের মুরব্বিস্থানীয় লোকজন মেয়ের বাড়ি আসেন। তাঁরা সওগাত হিসেবে নিয়ে আসেন পানসুপারি আর মিষ্টি। মেয়ের বাড়িতেও থাকে পান শরবত ইত্যাদির আয়োজন। বাঙালি সংস্কৃতিতে নতুন মেহমানদের শরবত আর পান দিয়েই আপ্যায়ন করার রীতি বহু পুরোনো। এনগেজমেন্টেরই একটা সরল বাহুল্যবর্জিত আনুষ্ঠানিক রূপ ‘পানচিনি’। পানচিনি হলো মানে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
অনেক সময় ধর্মীয় রীতিতে বিয়েটা আগে সেরে ফেলা হয়। পরে লোকজন দাওয়াত দিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান করা হয়। ধর্মীয় বিয়েটাকে এখন বলা হয় ‘আকদ’ বা ‘কলমা’। গ্রামীণ সংস্কৃতিতেই ‘কলমা’ বলা হয়ে থাকে। তবে বিক্রমপুর অঞ্চলে এই কলমা বা আকদের একটা সুন্দর প্রতিশব্দ ছিল। সোনাকাপড়। ছেলের বাড়ি থেকে কলমা অনুষ্ঠানে মেয়ের জন্য দেয়া হতো স্বর্ণের অলংকার, সেটা হতো মূলত নাকফুল, কারণ নাকফুলকে বিবাহের চিহ্ন বা এয়োতির চিহ্ন মনে করা হতো। আর থাকতো একটি শাড়ি। এই নাকফুল আর শাড়ি পরিধান করে মেয়ে কবুল বলে ফেলতো। এই হলো সোনাকাপড়। বিয়ের সময় কনে আর বর দুজনকেই গায়ে হলুদ দিয়ে তারপর গোসল করানো হতো। এই হলুদ মাখা এবং গোসল করানো অনুষ্ঠানটির গ্রামীণ নাম ‘তেলই’ বা ‘তেলাই’। বর বা কনের গায়ে যে মদির সুগন্ধ সৃষ্টির জন্য খুব করে তেল হলুদ গিলা বাটা সোন্দা মেথি ইত্যাদি মাখা হয়েছে! হলুদের তেল, মেথির তেল, এই তেল তোলাও সহজ না। জলেভাসা সাবান দিয়ে ডলে ঘসে, ললনারা গীত গাইতে গাইতে এ গোসল অনুষ্ঠান করে। এভাবেই হলুদ গোসলের নাম হলো তেলই। আয়োজনের সবকিছুর সাথে লেগে যায় এই শব্দ। তেলইর শাড়ি, তেলইর গামছা, তেলইর সাবান ইত্যাদি। এর পর আনুষ্ঠানিক বিয়ে। এখন আমরা বিয়ের পর্বগুলোকে আকদ, রুসমত, ওয়ালিমা নানা আরবি ফারসি নামে ডাকি। কিন্তু গ্রামীণ মানুষেরা এই পর্বগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য নিজেদের জীবন থেকে নিয়েছিলেন চমৎকার সহজবোধ্য আর মধুময় সব শব্দ! বিয়ের আসরে বর কনে পরস্পরকে মিষ্টি মুখ করায়। এটি একটি মিষ্টি সুন্দর অনুষ্ঠান। এখন বলা হয় রুসমৎ। কিন্তু গ্রামীণারা এর নাম দিয়েছিলেন ‘খিরভোজানি’! খির ভোজন করিয়ে দিচ্ছে তাই খির ভোজানি।
পল্লীর সরল জীবনের এই সুষমাকে যে কবি পূর্ণাঙ্গভাবে দেখতে পেয়েছিলেন, সেই কবি জসীম উদ্দীন তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যে এই খিরভোজানির দৃশ্য এঁকেছিলেন গ্রামীণ যুবক রূপাই আর গ্রামকুমারী সোনাইয়ের বিয়েতে। কনে বউয়ের ঠোঁটের স্পর্শ লাগা খির চট করে খেয়ে নেয় প্রেমিক বর রূপাই- ‘রূপাই তখন ফেললো খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই খীর/ হাসির তুফান উঠলো তখন মেয়ের দলের ভিড়।” আবার কনেবউকে নিয়ে যখন বর নিজের বাড়ি গিয়ে উঠলো, পালকি থামলো উঠোনে। আশপাশের জ্ঞাতিগোষ্ঠী সব ভিড় জমালো বউ দেখতে। বউ দেখলো বাড়ির মানুষ, পাড়ার লোকজন, কিন্তু বউ তো তাদের দেখলো না! পরের দিন বউকে নিয়ে মুরব্বীস্থানীয়রা বাড়ির সব ঘর চিনিয়ে দেন, কোন ঘরটা চাচাশ^শুরের, কোনটাতে থাকেন ভাসুর, কোনটাতে দাদাশ^শুর। এ অনুষ্ঠানের নাম ‘ঘরচিনানি’। এই পানচিনি, তেলই, সোনাকাপড়, খিরভোজানি, ঘরচিনানি শব্দগুলো যেভাবে বাংলার সরল জীবনের রঙে রাঙানো বিবাহ সংস্কৃতির নানা ছবিকে সামনে এনে হাজির করে তেমন ছবি কি এনগেজমেন্ট, আকদ, রুসমত, ওয়ালিমা ইত্যাদি শব্দের ভেতরে পাওয়া যায়?
সময়ের আবর্তনে সবই বদলে যায়। বদলে যায় মানুষের মন, ভাবনা চিন্তা, মূল্যবোধ, শিক্ষা সংস্কৃতি সব। সবচেয়ে বেশি বোধ হয় বদলায় ভাষা। ভৌগোলিক উপনিবেশ উৎখাত করা গেলেও ভাষা আর সাংস্কৃতিক উপনিবেশ উৎখাত করা যায় না। বরঞ্চ সময়ের সাথে সাথে, তা নানাভাবে বেড়ে চলে। সময়ের মতো ভাষাও প্রবহমান। আমাদের ভাষা এখন বয়ে চলছে মিশ্র সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে। প্রতিনিয়ত তাতে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তির প্রভাব। ইংরেজি, আঞ্চলিকতা, আরবি, অশিক্ষা ও অজ্ঞানতাপ্রসূত বিকৃতি নানা বিষয়ের উপনিবেশ শেকড় গেড়ে বসছে আমাদের ভাষায়। আমাদের বয়সী প্রজন্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ‘এক্সাম’, ‘ড্রেস’ ’আলহামদুলিল্লাহ’, এসব শব্দের জায়গায় যে ‘পরীক্ষা’, ‘জামা’, ‘ভালো আছি’ বলা হতো, তা হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের কেউ জানবেই না!
লেখক : কথাশিল্পী।