Thikana News
২২ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা এবং সম্পাদক সাংবাদিক ও মালিকপক্ষ প্রসঙ্গে কিছু কথা

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা এবং সম্পাদক সাংবাদিক ও মালিকপক্ষ প্রসঙ্গে কিছু কথা



 
সাপ্তাহিক ঠিকানার ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে একটি লেখা দিতে হবে। একসময় ঠিকানায় লিখতাম। এখন সেভাবে লেখা হয় না। পাঁচমিশালি লেখাই লিখতাম সাধারণত। তবে রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর লেখার আধিক্য বেশি থাকত। আমি ছাড়া আরও অনেকেই রাজনৈতিক বিষয় লেখেন, লিখে থাকেন। সবার লেখায় মতের ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা নিয়ে কখনো পত্রিকা কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণ বোধ করিনি। বরং প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্ব পেয়েছে বলেই মনে হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকানা নিয়ে লেখার আগে বর্তমান সময়ের আলোকে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম নিয়ে কিঞ্চিৎ পর্যালোচনা করা অপরিহার্য মনে করি।
সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ- এ কথা আদিকাল থেকে শুনে এসেছি। সমাজও হয়তো আজও তা-ই ভাবে। সাধারণের ধারণা, আজও সংবাদপত্র সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। সমাজের এ ধারণা অমূলক নয়। কেননা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের পূর্বশর্ত। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে আশান্বিত হওয়ার কারণ দেখি না। করপোরেট পুঁজি ও মালিকপক্ষের গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রয়োজনই মুখ্য। সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের বিপরীতমুখীন এরূপ ভূমিকা স্বাধীন মত ও সংবাদ প্রকাশে নিছক হেয়ালিপনা।
গণতন্ত্রে স্বাধীন গণমাধ্যমে সজীব ও নির্ভীক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। অথচ গণমাধ্যমের স্বাধীন মতপ্রকাশে করপোরেট পুঁজি ও ক্ষমতাসীনদের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ সমাজের প্রতি সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা চরম হুমকিস্বরূপ। সাধারণের ধারণা, দেশের সংবাদমাধ্যম মাঝেমধ্যে নেহাত দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের যতটা না সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে তারা আত্মসমালোচনাবিমুখ ও অসংবেদনশীল। তারা নিজেদের খুবই নীতিনিষ্ঠ মনে করেন।
অনেক সংবাদমাধ্যম আছে, মালিকপক্ষের স্বার্থের প্রয়োজনে মিথ্যা ও বিকৃত সংবাদ পরিবেশনে যথেষ্ট পারঙ্গম। এরূপ অনেক সাংবাদিক আছেন, অর্থের বিনিময়ে মালিকের স্বার্থরক্ষায় ঘটনার সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনায় আপস করতে দ্বিধা করেন না। তারা রীতিমতো ভেবেচিন্তে ঘটনার বিকৃতি ও স্পর্শকাতর উপস্থাপনাই আসল দায়িত্ব মনে করেন। অথচ মানুষের কাছে এই উপস্থাপনাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। সাম্প্রতিক কালে অর্থের বিনিময়ে এরূপ স্বার্থবাহী সংবাদ পরিবেশন স্বাভাবিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে প্রকৃত সংবাদের বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনা প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
মিডিয়ার এই ভূমিকা নিয়ে ইদানীং আমাদের দেশেও প্রশ্ন উঠেছে। একশ্রেণির সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে নৈতিকতা বিকিয়ে দিতে একেবারে দ্বিধাহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। মালিকপক্ষের চরণতলে তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা অঞ্জলি দিয়ে রাখা। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ উঠেছে, সমালোচনাও হয়েছে অনেক। তা সত্ত্বেও তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একদিকে সংবাদকে উত্তেজনাকর ভঙ্গিতে উপস্থাপনার প্রকাশ-প্রবণতা, আরেকদিকে নিজেদের করপোরেট ‘বস’দের’ স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে সংবাদকে তুলে ধরার গোপন অভিপ্রায় দেশের সংবাদমাধ্যমের বেশির ভাগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই এখন এমন।
ফলে সংবেদনশীলতা কী, তা সম্ভবত সংবাদমাধ্যম ভুলেই গেছে। তারা নিজেদেরকে বাকি সবার নিয়ন্তা মনে করে। তাদের যেন কারোর কাছে কোনো জবাবদিহির দায় নেই। তাই মাঝেমধ্যে প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়, কীভাবে সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করা যায়, যাতে মানুষের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থা বুঝে তারা কাজ করবেন। প্রশ্ন আসে, তারা যে জবাবদিহি করবেন, সেটাই তো স্পষ্ট নয়। কারণ, ক্ষমতায় ভারসাম্যের অভাব এত প্রবল যে দায়বদ্ধতার ধারণাকে প্রচলিত গণমাধ্যম-ব্যবস্থায় সহজে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক ছাড়া সাংবাদিকদের ইচ্ছামতো কোনো কিছু প্রকাশ করার ক্ষমতা আদৌ তাদের আছে বা আইনি অধিকারের মধ্যে পড়ে কি না সন্দেহ। আইন মোতাবেক তাদের নিজেদের মালিকপক্ষ ছাড়া তাদের আর কারও কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক দায়বদ্ধতাও নেই।
‘অর্থ ও স্বার্থের বিনিময়ে’ সংবাদ প্রকাশের বীজ কত গভীরে প্রোথিত, কীভাবে এই দুর্নীতি সংবাদমাধ্যমকে গ্রাস করেছে, তা জানার জন্য সাংবাদিকদের ইচ্ছার প্রবণতা কতটুকু? সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা ও এর ভূমিকার ওপর নজরদারি সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ করে বলে মনে হয় না, বরং বিতর্কে না গিয়ে এ ধরনের ঘটনার জন্য কাউকে চিহ্নিত করার দায় এড়িয়ে চলা হয়। তা করতে পারলে হয়তো যারা এর সঙ্গে যুক্ত, তারা কিছুটা লজ্জা পেতেন। সংবাদমাধ্যমের নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা জোরালো ভিত্তি পেত। কিন্তু বাস্তবে ওই স্বার্থবাহী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা এবং প্রবণতা ও ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতাই প্রাধান্য পায়।
এবার আসি ঠিকানা সম্পর্কে। সাপ্তাহিক ঠিকানা প্রবাসের অন্যতম পুরোনো পত্রিকা। সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা বললে ড. রঞ্জিত দত্তের হাতে লেখা, কখনো সাইক্লোস্টাইলে সপ্তাহ-পনেরো দিনে বের হওয়া পত্রিকা। প্রিন্ট পত্রিকা প্রচলিত হওয়ার পর সেটি অচল এবং হারিয়ে যায়। ড. রঞ্জিতবাবুর হাতে লেখা প্রকাশের সময়ই নিউইয়র্কে সাপ্তাহিক প্রবাসীই ছিল একমাত্র বাংলা পত্রিকা। যেকোনো কারণে সেটি প্রায়ই অনিয়মিত ছিল। এমনই অবস্থায় ঠিকানার আত্মপ্রকাশ। ঠিকানা নিয়মিত প্রকাশে সচেষ্ট থাকায় অচিরেই প্রবাসীর চাহিদার শূন্যস্থান পূরণ করে। গ্রাহককুলে দুষ্টি আকর্ষণেও সমর্থ হয়।
তখনকার নিউইয়র্কে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি কারণে মানুষজন, বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিদের যথেষ্ট নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হতো। পত্রিকা প্রকাশের বাইরে কমিউনিটির এই নিরাপত্তাহীনতায় আন্দোলন, প্রতিবাদে ভূমিকা রেখেছে ঠিকানা। অন্যদিকে তখনকার প্রবাসে উত্তর আমেরিকা এবং পার্শ্ববর্তী কানাডায় অন্য কোনো বাংলা পত্রিকা বের হতো না। ঠিকানা তখন বাঙালিদের এই চাহিদা পূরণ করেছে। নিয়মিত প্রকাশের কারণে প্রবাসী অনেক লেখক-লেখিকার লেখালেখির সুযোগ ও সংঘবদ্ধ হওয়ারও অবকাশ ঘটিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, দেশ থেকে যেসব সাংবাদিক প্রবাসে এসে আর দেশে ফিরে যাননি, তাদের অনেকেরই কর্মস্থল হয়ে উঠেছিল ঠিকানা। প্রবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পত্রিকা প্রকাশের চাহিদাও বাড়ে। একসময় ব্যাঙের ছাতার মতো বের হওয়া অনেক পত্রিকা বন্ধ বা হারিয়েও গেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, তার পরও যেগুলো টিকে আছে, তাদের অনেকগুলোর প্রকাশক কিংবা মালিক একসময় ঠিকানায় ছিলেন এবং কাজ করেছেন। প্রাথমিক অবস্থায় ঠিকানায় থেকেই নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন- এ কথা অনস্বীকার্য। অথচ অনেককে অকৃতজ্ঞ হতেও দেখি। অনেকেই হয়তো আজ ঠিকানায় নেই, অনেক পত্রিকাও হয়তো হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঠিকানা তার সূচনার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে আজও প্রকাশ ও অবস্থান যথারীতি ধরে রাখতে সক্ষম বলেই প্রতীয়মান। পাঠক এবং প্রচারেও অভিন্নতা ঘটেছে বলে মনে হয় না। দীর্ঘ তেত্রিশটি বছর একনাগাড়ে সমানতালে চালিয়ে যাওয়া এবং টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালি কমিউনিটিতে সংবাদ পরিবেশনে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে অবশ্যই ঠিকানা প্রশংসার দাবি রাখে। ঠিকানার ৩৪তম বছরে পদার্পণে অবশ্যই সংহতি জানাই। উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঠিকানার মালিক ও সহকর্মী সকলের প্রতি শুভেচ্ছা জানাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
কমেন্ট বক্স