জীবন বহবান। ধারাপাতের হিসেব কষে না হলেও হৃদয়ের আকুলিত বিভায় অবিরাম এগিয়ে যাওয়া। পরস্পরকে ভালোবাসার মন্ত্রে দুরন্ত চির কিশোরী। প্রকৃতির প্রেমে আকুল হয়ে ‘দেয়া আর নেয়ার’ খরস্রোতা বয়ে যাওয়া বাদামী পালতোলা নায়ে উড়ে চলে দিনমান। কিছু দেখা-জানা আর শোনার মাঝেই অবচেতন মনে সঞ্চারিত বহুমুখীতার অনুভূতি। অশান্ত উন্মনামন কী যেন এক প্রত্যাশায় ব্যাকুল হৃদয় মেলে ধরে। পুরো বিশ্বকেই আমার বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। এমন করে সেই মনের অনুভূতি প্রকাশ পায় স্বীয় ভাষার মহিমায়।
মানুষের মনের প্রকাশিত ভাবাই হচ্ছে হৃদয়ের বলা না বলা ভাষা- মাতৃভাষা। এই ভাষার বহুমুখিতা মানুষকে করেছে বৈচিত্র্যময়। এই ভাষাপ্রেম একটি জাতিকে করে ঐক্যবদ্ধ, আর বিশ্বকে আবদ্ধ করে একই মন্ত্রে হৃদয়ের পরমত সহিষ্ণুতায়। কিন্তু কোথায় যেনো একটু ভিন্ন সুরে পত্র-পল্লবের বিভায় বয়ে যাওয়া বাতাস স্তিমিত হয়ে মনকে নাড়া দেয়। উতলা মন শক্তি পায়, প্রতিবাদে উন্মুখ হয়ে ওঠে। এগিয়ে যাবার অদম্য উৎসাহে বলীয়ান হয়ে ওঠে। পরাধীনতার শিকল ভাঙার সাহস জোগায়, জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হয়ে ভোগবাদের অশান্ত অগ্রহণযোগ্য ধারা থেকে সাম্যের হাত ধরে জাতিসত্ত্বা ও বিশ্বপ্রেমে জাতিরাষ্ট্র রক্ষায় সংগ্রামের তাগিদ আসে।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। নিজ দেশ ছেড়ে সুদূর প্রবাসে বসেও ভাবতে ভালো লাগে- অনেক রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস। গবেষকদের মতে, পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় সাত হাজারের মতো। এর মধ্যে ছয়শ’র মতো ভাষা সংকটময় অবস্থানে রয়েছে। প্রায় চৌদ্দ দিনে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। আর কিছু ভাষা আছে, যার ধারক মাত্র অল্প কয়েকজন। জানা মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে উপভাষা আট হাজারের মতো। আরো কিছু ভাষা আছে, যা এখনও অলিখিত। অর্থাৎ তাদের মৃত্যু মানেই সেই ভাষার, সেই জাতিসত্ত্বার মৃত্যু। প্রসঙ্গত সে কারণে জাতিসত্ত্বার সংরক্ষণ ও সংস্কার সাধনে ভাষার লালন অপরিহার্য। সেই সাথে নতুন ভাষা আবিস্কারের প্রচেষ্টাও অব্যাহতভাবে লক্ষ্যণীয়।
পৃথিবীতে হাজারো ভাষার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার স্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশ-বাঙালি আর বাংলাভাষা নিয়ে আমরা গর্বিত। আমরা জানি, ১৯৫২’এর ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনে অর্থাৎ নিজ সত্ত্বার অধিকার প্রতিষ্ঠার জীবনদানকারী সাহসী যোদ্ধাদের পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। স্মরণ করি জানা-অজানা সব সংগ্রামী বীরদের। আরো স্মরণ করি কীর্তিমান নারী যোদ্ধাদের, যাঁদের নাম আড়ালে রয়ে গেছে এখনও। কিংবা কম উচ্চারিত হয়। জীবন মানেই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের অগ্রবর্তী সেনানী নারী তার ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক তথা বিশ্বজনীন ক্ষেত্রে অসীম সাহস নিয়ে যুদ্ধ করে সবার জন্যে জয়ের প্রত্যাশায়।
আজ শুধু বাংলা ভাষাই নয়, বিশ্বের সব ভাষার জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে কানাডাপ্রবাসী বাঙালি সালাম ও রফিকের সক্রিয় উদ্যোগ ও তৎপরতায়। বিশ্ব মানবের কাছে তারা স্মরণীয়। ভাষার জন্য, শুধু নিজেদের জন্য নয়, ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এই বাণী আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণে তারা আমাদের অহঙ্কারী করেছেন।
ভাষার আগ্রাসন সভ্যতার ওপর আগ্রাসন। এখন সহজ এক প্রশ্ন মনে জাগে- নিজের ভাষা কাকে বলে? যে ভাষাতে কথা বলার সাথে কলম চলে, সেটাই হচ্ছে নিজ ভাষা। সে কারণে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় নিয়ে গবেষণা অত্যন্ত আবশ্যকীয় ও জরুরি। আমাদের এটি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হবে। কারণ আমরা শুধু বাঙালি নই- বিশ্ব বাঙালি। তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা কোন ভাষার আগ্রাসনে যেনো অন্য কোন একটি ভাষাও হারিয়ে না যায়। এ বিশ্ব থেকে কোন একটি ভাষাকেও আমরা হারিয়ে যেতে দেবো না। ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস ও গুরুত্ব এবং তা রক্ষার্থে করণীয় বিষয়ে গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। আমরা জানি, ভাষা আন্দোলন আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনাপর্ব।
বিশ্বে সব ভাষার সমান গুরুত্ব। আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার পাশাপশি সব উপভাষাকেও
মূল্যায়ন করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সব উপভাষায় পাঠদান আবশ্যকীয়। সরকারিভাবে অফিস-আদালতে, প্রয়োজনে কথা বলার জন্য, উপভাষা ব্যবহারের অনুমতি থাকতে হবে। অর্থাৎ উপভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা অনিবার্য। আমাদের উচিৎ পৃথিবীর তথ্য ভাণ্ডারে দেশের জন্য প্রাণ দেয়া মানুষদের অমূল্য জীবনী প্রকাশ করে অন্যদের অনুপ্রাণিত করা। তাঁদের স্মৃতি আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, সুকর্মে অবদান রাখতে উদ্দীপ্ত করবে। ভাষার সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। ভাষাই একটি জাতিকে জাগিয়ে রাখে। আগেই এ ব্যাপারে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের জানতে হবে বিশ্ব ইতিহাস। ভারতসহ একাধিক দেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছে। সেই তালিকায় গণহত্যা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রায় অনুচ্চারিত এই সব ভাষা আন্দোলন। ৭০০ জন শিক্ষার্থীর (বেসরকারি) জীবনের বিনিময়ে জুলু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ভারতবের্ষ ভাষা আন্দোলনের কথা অমারা জানি। যেমন তামিল ভাষা, তেলেগু, কন্নারা, ওড়িষ্যা, মণিপুরি ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি। ভারতে মোটা ভাষার সংখ্যা ১০০টিরও বেশি। তার মধ্যে ২২টি সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত এবং ৪টি ভাষা ঐতিহ্যবাহী হিসেবে স্বীকৃত। আইনগতভাবে ‘রাষ্ট্রভাষা’ কিংবা ‘জাতীয় ভাষা’ পরিভাষাটি সেখানে ব্যবহার করা হয় না।
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের এই মাসে নিজ ভাষাসহ বিশ্বের সব ভাষা নিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ভাষা রক্ষার সংগ্রামে করণীয় নিয়ে সোচ্চার থাকতে হবে। এজন্য প্রত্যেকটি ভাষার অনুবাদ অপরিহার্য। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ‘এ বিশ্ব থেকে একটি ভাষাকেও আমরা হারিয়ে যেতে দেবো না’।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সব ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা তাদের অতুলনীয় অবদানের জন্য। ভাষাশহীদ রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার আমাদের মাথার মুকুট হয়ে আছেন, থাকবেন।
সবশেষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি উল্লেখ করতে চাই, সেটি হচ্ছে- একজন পাঠক হিসেবে মনের আকুতি প্রকাশের যে মাধ্যম প্রবাসে বাঙালির ‘ঠিকানা’, আমাদের ‘ঠিকানা পত্রিকা’। তার ৩৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও হৃদয় নিঃসৃত সমর্থন। একজন লেখক ও পাঠকের মানসিক সৌহার্দ্য ও সংযোগ প্রকাশের মাধ্যম এই পত্রিকা আমাদের সব বাঙালির ‘ঠিকানা’। ঠিকানা ‘মেঘলা আকাশে উঁচিয়ে রেখেছো মাস্তল। জয়তু ঠিকানা।’ সেই সাথে আশাবাদ, সমাজ ও বিশ্বে প্রায় অনুচ্চারিত নারী এবং প্রবাস ও স্বদেশের জাতির ভবিষ্যৎ, তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুক ঠিকানা।
যারা শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও অধ্যাবসায় দিয়ে ঠিকানাকে পাঠক নন্দিত ও সবার প্রিয় পত্রিকা করে তুলেছেন, সেই অসাধারণ নিবেদিত সকল বিভাগে কর্মরতদেরও অভিনন্দন।
ঠিকানার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাক অনাদিকাল।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট