Thikana News
২২ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

জিন্নাহর জীবনে প্রেম বিবাহ ও উত্তরপুরুষ

জিন্নাহর জীবনে প্রেম বিবাহ ও উত্তরপুরুষ



 

পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার পর থেকেই আমাদের আজকের বাংলাদেশ যা অভিহিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে সেই ভূখণ্ডটি পাকে পাকে বাধা হয়ে ছিল নির্মম এক ষড়যন্ত্রের জালে। সৃষ্টির পর থেকেই আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানের সরকার প্রকাশ্যেই ঘৃণা ও উপহাস করতে কখনোই দ্বিধান্বিত হয়নি।

কিন্তু বাংলার মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলো সে দিনই যেদিন ঢাকার বুকে বসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৫২ সালে সদম্ভে দিয়েছিলেন একটি ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণা -উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।

তারই প্রতিউত্তরে আমাদের তৎকালীন ছাত্রসমাজ মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে রাজপথে ঢেলে দিয়েছিলেন বুকের তাজা রক্ত। আর যারা ছিলাম পরবর্তীকালের বাংলা ভাষার গর্বিত উত্তরসূরি ছাত্রসমাজ সেই প্রজন্মটি মাতৃভাষার প্রতি এই অবজ্ঞাপূর্ণ উক্তির কারণে জিন্নাহ নামটির প্রতি বুকের ভেতর শৈশব থেকে ঘৃণার আগুন ধারণ করে ঐতিহাসিকভাবেই বড় হয়েছি।

বাংলা ভাষার প্রতি এই ঘৃণা প্রকাশকারী জিন্নাহকে উর্দুতে উপাধি দেওয়া হয়েছিল কায়েদে আজম -বাংলায় তাকে বলা হতো জাতির পিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূববর্তী সময় পর্যন্ত তথাকথিত কায়েদে আজমের জীবনী পড়তে হয়েছে স্কুলের পাঠ্য বইয়ে। সেখানে থাকতো জিন্নার জীবন ও মৃত্যু কথা, পিতা মাতার নাম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পাঠ্য বইয়ের সেসব লেখায় শুধু নয় অন্য কোথাও যা পাকিস্তান সরকারকর্তৃক প্রকাশিত কোনো লেখা সেখানে তাঁর বিবাহ, স্ত্রী কিংবা সন্তানদের কোনো উল্লেখ নেই।

কিন্তু বাড়িতে আমার ব্রিটিশ যুগে শিক্ষিত নানার সংগৃহীত পুস্তকাদিতে এবং তাঁর বন্ধু বান্ধবের সাথে আলাপ আলোচনাকালে শোনা হয়েছিল জিন্নাহ সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা তথ্য। তখনকার সমাজের অনেক মানুষ শুধু নন এখনো কারও কারও কাছে ব্যাপারটি উন্মুক্ত নয় হয়তো।
পাকিস্তান দেশ ও সমাজের কিছু মানুষ যারা ছিলেন মনেপ্রাণে পাকিস্তান ভক্ত- তারা সেসময় দম্ না ফেলে উচ্চারণ করতেন ‘পাকিস্তান আল্লাহর সেরা সৃষ্টি।’ তারা শুনতে পেলেও এরকম কথা বিশ্বাস করতেন না।

অন্যদিকে বহুভাষী নানা জানাতেন সারা দুনিয়াই আল্লাহর সৃষ্টি। তবে পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালে অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছিলাম সে দেশ আল্লার এক নিকৃষ্ট সৃষ্টি।

আগে আলোচনাকালে তিনি আওড়াতেন ইকবালের কবিতা
‘চীন ও আরাব হামারা, হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হেঁ হাম,
ওয়াতন হ্যায় সারা জাহাঁ হামারা।’
এরপরেও প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা না বলে পারছিনা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ সময় পেরোবার পরও কারও মুখে আমি শুনেছি -জিন্নাহ সাহেব আসলে ছিলেন একজন নবী।

তবে আজ আমি ফেব্রুয়ারি মাসের এমন একটি দিনে অবশ্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নবূয়ত কিংবা রাজনীতির কথা লিখতে বসিনি। কি জানি কেন কলম খুলতে গিয়ে (থুড়ি কম্পিউটার) মনে পড়ে গেলো সেই বালিকা বয়স পেরোবার পর বাড়িতে নানান বই কিংবা ম্যাগাজিন পড়তে গিয়ে কখন যেনো নিজেদের পারিবারিক গল্পের মাঝে জেনেছিলাম জিন্নাহ নামের সেই আলোচিত ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী কন্যা পরিবার নিয়ে গোপন কিছু কথা।

আমরা জানতাম তার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন একজন অমুসলিম এবং নাম ছিল রতনবাই পেটিট! সাথে আরও শুনেছিলাম তার অভিজাৎ পরিবার সম্পর্কে। রতনবাই পেটিটের আরেক নাম রুতি। রুতি মেয়েটি বংশগরীমায়তো বটেই তার কিশোরী বয়েসেই রূপবতী হিসেবেও ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়েও অনেক দূর পর্যন্ত বিখ্যাত হয়েছিলেন, ফ্লাওয়ার অব বোম্বে নামে-যার কিংবদন্তিসম পার্সি পিতা ছিলেন স্যার দিনশ ম্যাকেঞ্জি পেটিট, তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের ব্যারনেট। এখানে মনে করানো দরকার একালেও সেই পরিবারের অংশ যারা টাটা নামে হয়ে আছেন পৃথিবী বিখ্যাত।

যখন রুতি তার কিশোরী বয়সে প্রবেশ করেন তখন শহরের উচ্চসমাজ তাকে আখ্যা দিয়েছিল ‘দ্য ফ্লাওয়ার অফ বোম্বে’। বিবিধ বয়সের বহু পুরুষই তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে রতনবাইয়ের পিতৃগৃহের বৈঠকখানায় ঘন ঘন অতিথি হয়ে আসতে পছন্দ করতেন। এদের মধ্যে পিতার প্রায় একই বয়েসের বন্ধু মৃতদ্বার জিন্না সাহেবও ছিলেন অন্যতম।

রতনবাইয়ের অগ্নি উপাসক পার্সি পরিবার ছিল বোম্বেতে অত্যন্ত অর্থবিত্তশালী ও আভিজাত্যে বিখ্যাত। এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ভারতের সুবিখ্যাত টাটা গোষ্ঠী সেই একই পরিবারের অন্যতম একজন উত্তর পুরুষ। তদানীন্তন ইন্ডিয়ায় রতনবাই যেমন ছিলেন ফ্যাশনেবল, বহির্মুখী অন্যদিকে তাকে বম্বের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হিসেবে বিবেচনা করা হতো- বলা হতো বম্বের গুলি।
রতনদের পেটিট পরিবার ছিল একটি ইংরেজ ধারার পরিবার। পরিবারের সদস্যদের পোশাক, ভাষা, খাদ্য এবং রীতিনীতি ছিলো যেন সম্পূর্ণ ব্রিটিশ ধাঁচের। বাড়ির জন্য ইউরোপ থেকে সেরা ফুল, মার্বেল পাথরের আসবাবপত্র আমদানি করা হতো- প্রতিটি ঘরে ছিল একাধিক পার্সিয়ান রাগ এমনকি তাদের প্রশস্ত হলটিতে পর্যন্ত ছিল একটি গ্রিসিয়ান ফোয়ারা। তাছাড়া তাদের পরিবারের সকল সন্তানদের বিলাসিতা ছিল রাজকীয়।

রতনের পিতা রাজকন্যার কায়দায় লালিত পালিত কন্যাকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন অগুনতি বইপত্র, জামাকাপড়, পোষা প্রাণী, খাবার দাবার দিয়ে।

এমনিতেই ইউরোপ বা ভারতের অন্যান্য অংশে পরিবারের ছুটি কাটানোর সময় তাদের কন্যাসহ সমগ্র গৃহকে দেশদেশান্তরের উপহার ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে এনে নবনব রূপে সাজানো হতো।

এমন এক মেয়ে নাবালিকা বয়সে যার নাকি বয়স ছিল ১৫ বছরের কম প্রেমে পড়ে কোর্টশিপ করে বিবাহ করেছিলেন সেই পিতৃ বন্ধু জিন্নাহকে। যিনি পিতার চাইতে ছিলেন মাত্র পাঁচ বছরের কনিষ্ঠ। তাছাড়া ব্যক্তিটি ছিলেন একজন মৃতদ্বারও বটে।
অন্য দিকে কিশোরীটি ছিল নিত্য নতুন ফ্যাশনের অসাধারণ অনুরাগী। তাকে অযৌক্তিকভাবে কেনাকাটা করতে এবং সে যা চাইত তা কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কোনো খরচসীমা ছাড়া। তার বাবা-মা সন্তানদের লালন-পালনের বেশিরভাগটাই ইউরোপীয় আয়াদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যখন তার দাদা-দাদি অর্থোডক্স জরাথুস্ট্রীয় ধর্ম অনুশীলন করছিলেন, তখন রতন ছিল শুধু নামমাত্র একজন পার্সি ধর্মাবলম্বী। তার ভাইবোনদের কেউই জরথুস্ত্রবাদ ধর্মে বেড়ে ওঠেনি, বাড়িতে গুজরাটি ভাষাও বলা হতো না। রতনবাই ও তার ভাইয়েরা নভজোট অনুষ্ঠান গ্রহণ করেছিলেন, একটি জমকালো পার্টি দেওয়ার জন্য।

রতনবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন নাবালিকা অবস্থায় প্রথম পিতার পাঁচবছরের কনিষ্ঠ বন্ধু জিন্নাহকে বিবাহ করলেন সে সময় আইন অনুসারে সেটি সিদ্ধ হয়নি। কিন্তু মেয়েটি তার ষোলো বছর পূর্ণ হওয়ার পর আবার করলেন কোর্টশিপ। নাম পরিবর্তন করে রাখলেন মরিয়ম।

জিন্নাহ ও রতনের এই অসঙ্গতিপূর্ণ বিবাহের শুরুতে উভয়েই ভেসেছিলেন প্রেমের জোয়ারে। জিন্নাহ নিজেও বিলাসপূর্ণ জীবনের অধিকারী- তার স্যুট থেকে শুরু করে সবই নির্বাচিত হতো তরুণী স্ত্রীর রুচিতে।
তারপরতো অনেক কথা। পঞ্চদশী মেয়ে পূর্ণিমায় পৌঁছানোর আগেই যেন ডুবে গেলেন অমাবশ্যায়। প্রৌঢ় খিটখিটে ব্যস্ত রাজনীতিবিদ স্বামী, পাকিস্তানের অচেনা সমাজ, সবকিছুই তাকে অসুস্থ করে তুলছিল দিনে দিনে। অবশেষে ১৯২৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অকাল মৃত্যু হয়েছিল বোম্বের পুষ্প রতনবাই পেটিটের। ফুলের মতো মেয়েটি বিবাহিত জীবনে সম্মুখীন হয়েছিলেন যে কঠিন বাস্তবতার সেটাই প্রাণ মনসহ প্রেমও ভেঙে দিয়েছিলো তার।

তবে এরই মধ্যে একসময়ে রতন মা হয়েছিল এক কন্যার। মেয়েকে লালন করবার জন্য বোম্বেতে নিজ পরিবারে পাঠিয়েছিলেন। আর স্বাভাবিকভাবে সেও বেড়ে উঠেছিল ওই পরিবারের মতো করেই।
সেকথাও একসময় প্রকাশ্যেই উড়ে বেরিয়েছিল পাক ভারতীয় সমাজে।

অবশেষে যখন সাবালিকা হয়ে মেয়ে দীনা একটি পার্সি ছেলের প্রেমে পড়ে। দীনা সেই ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানায় পিতাকে।
কঠিনভাবে পিতা বলেছিলেন -সমাজে এতো মুসলিম ছেলে থাকতে সে কেন অমুসলিম বিয়ে করতে চায়?
মেয়েটি প্রতিউত্তরে আরও কঠিনভাবে বলেছিলো -সমাজে এতো মুসলিম মেয়ে থাকতে তার পিতাই বা কেন বিবাহ করেছিল একটি অমুসলিম মেয়ে?

কিন্তু কাকে বিয়ে করেছিলেন জিন্না কন্যা?

১৭০০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ-নির্মাতা হিসেবে যে পরিবারটি বিশাল সম্পদশালী হয়ে পরবর্তীকালে ভারতে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে সেই পরিবারের প্রধান শাখার বংশধর নেভিল ওয়াদিয়া, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র বংশধর দীনা জিন্নাহকে বিয়ে করেছিলেন।
জানা যায় মৃত্যুর আগে পাকি ইসলামের নিশান বরদার মৃত্যুর আগে গিয়েছিলেন তার দুই নাতি-নাতনিকে দেখতে। তার একমাত্র বংশধরকে কোলে নিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়।

নভেম্বর ০৩, ২০১৭ তারিখে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায়- পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র সন্তান দীনা ওয়াদিয়া নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। দীনা তার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোম্বে-ভিত্তিক পার্সি ব্যবসায়ী নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেছিলেন এবং দেশ স্বাধীনের পর ভারতে থেকে যান। তিনি তার মেয়ে ডায়ানা ওয়াদিয়া, ছেলে নুসলি ওয়াদিয়া, নাতি নেস ও জেহ ওয়াদিয়া এবং দুই নাতহর জাহ ও এলা ওয়াদিয়াকে রেখে গেছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

কমেন্ট বক্স