হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত সুপ্রাচীন জনপদ হলো সন্দ্বীপ। এই দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। একটা মতামত হলো, কেউ কেউ এই দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে ‘স্বর্ণদ্বীপ’ আখ্যা দেন। ওই ‘স্বর্ণদ্বীপ’ হতে ‘সন্দ্বীপ’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। আমি এই সূত্রে আসা নামটিকে খুব পছন্দ করি এবং অনেক বেশি ভালোবাসি। কারণ, আমি সেই স্বর্ণদ্বীপের কন্যা।
আমার শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো কেটেছে ওই স্বর্ণদ্বীপের ছোট্ট একটা ইউনিয়নে, যার নাম মুছাপুর।
আজ থেকে বহু বছর আগে কোনো এক প্রহরে মুছাপুরের একটি বাড়িতে আমার জন্ম হয়েছিল। আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা, যাকে বলে শৈশবের একেকটি ধাপ কেটেছে ওই স্বর্ণদ্বীপের বিচিত্রতায়, সমুদ্রের শুভ্র সফেদ জলরাশির অপূর্ব তরঙ্গতায় আর অজানা এক আকর্ষণের মাদকতায়। দ্বীপের সৌন্দর্য আর আমাদের বাড়ির কাঁঠালচাঁপার গন্ধ আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে। আজও আমি খেজুরগাছের তাজা রসের মধুর সুবাসে মোহিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হই। কালবৈশাখীতে ঝরে যাওয়া আম কুড়ানোর আনন্দে মেতে উঠি। পুকুরভরা মাছ, খেতভরা ধানের শীষের অপূর্ব দোল আজও আমাকে নিয়ে যায় সেই গোধূলির স্বপ্নছোঁয়া স্বর্ণদ্বীপের আবির রঙে রাঙানো আলপনায়।
আমার প্রিয় স্বর্ণদ্বীপ বা বর্তমান সন্দ্বীপ : বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও আপনারা জেনে অবাক হবেন, ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাস থেকে জানা যায়, সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি বিদ্যমান।
সন্দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি দ্বীপ। সন্দ্বীপের লবণশিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্রশিল্প পৃথিবীখ্যাত ছিল। উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙর করতেন এবং সহজ বাণিজ্য-ব্যবস্থা ও পরিবহন সুবিধাদি থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। এ ছাড়া ভ্রমণ ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ফরাসি ও ওলন্দাজ পরিব্রাজকেরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬৩০ বর্গমাইল হলেও ক্রমাগত নদীভাঙনের কারণে বর্তমানে এটি মাত্র ৮০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সন্দ্বীপের সীমানা উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তৎপশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ, পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং চ্যানেলের পূর্ব পারে চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই উপজেলায় বর্তমানে একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ সন্দ্বীপ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম সন্দ্বীপ থানার আওতাধীন। উড়িরচর (উপদ্বীপ) বাদে বাকি ১৩টি ইউনিয়ন হলো গাছুয়া, সন্তোষপুর, কালাপানিয়া , হরিশপুর, বাউরিয়া, মুছাপুর, রহমতপুর, আজিমপুর, মাইটভাঙ্গা, মগধারা, হারামিয়া ও আমানুল্লাহ।
বর্তমান সময়ে সন্দ্বীপের সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য আপনারা কীভাবে পৌঁছাবেন ওই স্বর্ণদ্বীপে ভাবছেন তো…? ভাবনার কিছু নেই! আমি বলছি, চট্টগ্রামের কুমিরা নৌ-টার্মিনাল ঘাট থেকে ট্রলার বা স্পিডবোটের মাধ্যমে আপনারা যেতে পারেন। মাত্র ২০ মিনিটের যাত্রায় পৌঁছে যাবেন সন্দ্বীপের নৌ-টার্মিনাল ঘাটে। সেখানে মাটিতে পা দিলে সেখানকার গোট্টাছাড়া ঘাট আর ম্যানগ্রোভের অপার সৌন্দর্য আপনাকে সাদর স্বাগত জানাবে।
আমার প্রিয় জন্মস্থান, আমার আজন্মলালিত স্বপ্নের স্বর্ণদ্বীপের স্মৃতির আয়না খুললেই মনে পড়ে যায়, সেই শীতের শিশিরসিক্ত প্রভাতে গাছের ফাঁক দিয়ে যখন সূর্যের সোনালি আলো ঝলমল করে পড়ছিল সবুজ ঘাসের ওপর, তখন শিশিরবিন্দুগুলো কী অপূর্ব আবেশে একেকটা মুক্তো হয়ে জ্বলে উঠছিল। তখনকার শৈশব ছিল আদর-যত্নে আর ভালোবাসায় ভরা। দাদার বাড়ি আর নানার বাড়ির আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা। সেই শৈশবে ছিল সকালবেলার গরম গরম চিতই পিঠার ধোঁয়া-ওঠার মাদকতা, সদ্য কোড়ানো নারিকেলের শুভ্রতা আর ঘরে বানানো খেজুরের রসের মিঠা! এক অনবদ্য চিরন্তন গ্রাম-বাংলার অবিচ্ছেদ্য রূপ। শুধু কি তা-ই? আরো ছিল খেজুরের রসের শিরনি আর প্রতিটা ঘরে ঢেঁকিতে গুঁড়া করা আতপ চালের ধুপি পিঠা। ও, সে কী অপূর্ব আস্বাদন…! সকাল সকাল মাদ্রাসায় হেঁটে যাওয়া আর শিশিরের মুক্তো বিন্দুতে পা ভেজানো সেই অনুভূতি মনের কোণে জেগে ওঠে বারবার।
শীতের দুপুরে মা যখন উঠোনে রোদে দিতেন কাফুরার গন্ধভরা কাঁথা আর কম্বল, আর দিতেন নিজের হাতে বানানো কিছু আচার, তখন আচার ও কাফুরার গন্ধ আলতো বাতাসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। কী যে ভালো লাগত তখন! মনে পড়ে যায় সেই বিকেলবেলার কথা! সাথিদের সাথে উঠানে, বাগিচায় কত শত খেলার কথা। জানি না ওরা সবাই এখন কেমন আছে, কোথায় আছে? সবার খবর জানা না থাকলেও আমি জানি, সবার মন পড়ে আছে উঠোনের কোণে অথবা বাগিচার ফুলে ফুলে, ফলে ফলে এমনকি পাতায় পাতায়! আমগাছ, কাঁঠালগাছ, নারিকেল, বরই আর তালগাছের সমারোহে একেকটি বাগিচা ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু আজ আর নেই অথবা যা-ও দু-একটা আছে তারা কালের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। কী অকপটে মা-চাচিরা বানিয়েছেন আমের মোরব্বা আর আমসত্ত্ব, বরইয়ের আচার আর তেঁতুলের আচার! আহা! সেদিনের সেই আচার, আমসত্ত্বের ম-ম গন্ধ আজও খুঁজে পাই বুকের গহিনে, অনুভব করি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার ছোঁয়া! তাদের বানানো হাতপাখার বাতাস সারা শরীরে এক শান্তির পরশ বুলিয়ে দিত। শুধু কি পাখা? আড়মোড়া আর বানানো নকশিকাঁথা কম কিসে! নকশিকাঁথার একেকটি কাজ একেকটি গল্পের পটভূমির মতোই উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠত ঠিক আমার ফেলে আসা সেই শৈশবের দিনগুলোর মতো।
আমার মায়ের হাতের জলপাইয়ের আচারের স্বাদ আজও ভুলবার নয়! কী যে এক অমৃতের মিশ্রণ মিশিয়ে দিতেন মা আমার, মনে হতো এত স্বাদের খাবার জীবনে আর খাইনি কখনো, কোনো দিনও!
মনে পড়ে যায়, শীতের সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফেরা, গায়ে হালকা শাল বা সোয়েটার পরে হারিকেনের আলোয় একসঙ্গে ভাইবোনেরা মিলে পড়তে বসা! সেসব দিন কোথায় হারিয়ে গেল? কোন স্মৃতির গহ্বরের অতল তলে তলিয়ে গেল!
স্বর্ণদ্বীপের প্রাচুর্যে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোলাভরা ধান, গাছভর্তি ফল, খেতভরা ফসল, আর পুকুরভরা মাছ-আরো কত কি!
সন্দ্বীপের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই উৎসবের ধুম পড়ে যেত, চলত পুলি পিঠা আর পাকন পিঠা বানানোর প্রতিযোগিতা। হাট থেকে কিনে আনা আমতি আর রসে চোবানো রসগোল্লার অপূর্ব আস্বাদন এখনো মুখে লেগে আছে। গুলগুলা আর গজার সুন্দর চেহারার একরাশ মুগ্ধতায় মন ভরে উঠত। অজান্তেই ওরা চলে যেত মুখের ভেতর। মা-চাচিদের হাতের সেই মোয়া বানানোর অপরূপ দৃশ্য ভুলবার নয়! ম্যারা পিঠা আর সেমাই পিঠা বানানোর অপূর্ব দৃশ্যপট এখনো জ্বলজ্বল করে মনের গহিনে। লাল আলু পোড়ার গন্ধ আজও আমায় টানে! চোখ বুজলেই অনুভব করি এই সবকিছুর অস্তিত্ব, শ্বাস নিলে ফিরে পাই পিঠাপুলির সেই ম-ম করা সুবাসের। আজ আর আমাদের বাস্তবতায় এসব কিছু নেই, শুধু আছে কর্মব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা আর সময়ের কড়া শাসন। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস নিশ্চয় আছে! আর তা হলো শৈশবের সেই মায়াভরা স্মৃতি, যা আজও আমরা জাবর কেটে ফিরে পেতে চাই সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনগুলোর সোনালি মুহূর্তগুলো।
স্বর্ণদ্বীপ আমার, সন্দ্বীপ আমার! দ্বীপে কাটিয়ে দেওয়া একান্ত আমার সেই শৈশবের দিনগুলো আজ এই যৌথ বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির যুগে বিলীন হয়ে গেছে সব। আমাদের শৈশবের আদুরে আমুদে একেকটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ প্রযুক্তির যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, পারবে না ফিরিয়ে দিতে আমাদেরকে, আমাদের আগামী প্রজন্মকে। আমার সন্দ্বীপ ভালো থাকুক, ভালো থাকুক এই দ্বীপের প্রতিটি বাসিন্দা। হাসি-আনন্দে ভরে উঠুক তাদের হৃদয়-মন। শুভকামনা সবার জন্য।
লেখক : কলামিস্ট।