Thikana News
২২ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

পিয়ারি

পিয়ারি



 
মশারির আঁচল উঠিয়ে দেখে পিয়ারি বসে আছে। ঘুম-চোখে আর ভুরু ভাঁজ করতে হলো না। আধ-খোলা দৃষ্টিতে তাকাল মুখের দিকে। চুপচাপ বসে আছে। ভারী গলায় জহির জানতে চাইল, তুই? এত সকালে?
ভোরের আবছায় নির্জন কামরায় কখন এসেছে এই মেয়ে, মাথা নিচু করে ভাবল কিছুক্ষণ। চৈত্র মাসের হাওয়ার লোভে পায়ের দিকটার জানালা খুলে ঘুমিয়েছিল। পুকুরের ওই পাড় থেকে সুপারি বন পেরিয়ে ছোট ছোট বাতাস আসছে। মশারির কোনা উড়িয়ে নিল। একটু এলোমেলো হয়েই শুয়েছিল ও। সাদা গেঞ্জি আর নীল চেকের লুঙ্গি। গেঞ্জিটা গায়ের নিচের দিকে টানতে টানতে আর লুঙ্গি গুছিয়ে নিয়ে পা ঝুলিয়ে খাটের প্রান্তে দু’হাত খুঁটির মতো রেখে তাকাল পিয়ারির দিকে। মুখটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গম্ভীরতার আড়ালেও হাসি আছে। নিবু নিবু। আরেকবার বাতাস এলে নিভে যাবে ওই হাসি। উঠে জানালা আড়াল করে দাঁড়াল জহির। পিয়ারির হাসি সংরক্ষণের চেষ্টা। ছেঁড়া মেঘের মতো ওর চুল। কানের দুলের দাগ দেবে আছে চিবুকে। পাশ ফিরে ঘুমানোর সময় বালিশ আর চিবুকের মাঝখানে এসে পড়েছিল মনে হয়।

‘আপনি কবে যাবেন, ঢাকায়?’ ঘরের ছায়ায় শিহরণ এনে জানতে চাইল পিয়ারি।
‘আর যাব না রে’। বলে হেসে তাকাল। পিয়ারির চুলের আড়াল সরে গিয়ে চিবুকের ম্লান চাঁদ ভেসে উঠল। দুই ঠোঁট টিপে হাসিটা স্থির হতে দিল জহির। পিয়ারি তাকিয়ে আছে। সারা রাতের ঘুমে চোখের পাতারা ভারী। মণি থেকে পটলের মতো দু’ফালি পাপড়ি স্তিমিত হয়ে আছে। কথাটা সত্যি ভেবে পলক ফেলা ভুলে গেছে ও।

আপনার কি ভার্সিটি বন্ধ? সেদিন যে বললেন, ছুটি শেষ এই সপ্তাহের ভেতরে?
ঠিকই বলেছিলাম। মজা করলাম। মজাও বুঝতে পারিস না আজকাল?
আমি কী বুঝতে পারি আর পারি না, তা জানি না। আপনিই শুধু কথা হাওয়ায় ওড়াতে চান। ভারী, হালকা সবই।
এই-ই…, কথা কি ঘুড়ি যে ওড়াব?

আপনার কাছে ঘুড়ি। যেমন ওড়াতেন। সকাল নেই, বিকেল নেই। দেখতাম, গাঙের পাড় ধরে হেঁটে আসছেন। সুপারিতলার পুকুরপাড়ে ঘেমেনেয়ে লাল হয়ে বসে আছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে চাপকলের পানি চাইতেন আমার কাছে। ভুলে গেছেন?
শ্বাস বেশ জোরে বেরিয়ে এল। গহিন বাতাসটা যে কোথায় ছিল! এভাবে আসতে দিতে চায়নি। পিয়ারি গাছের পাতা-পতনের ভাষা বোঝে। যদি সবুজ-গুচ্ছ থেকে কেউ হলুদ পাখি হয়ে নেমে আসে, ও বুঝে যায় গাছ নয়, মাটির সখ্য চায় পাতাটা।
দুই সপ্তাহের জন্য বাড়িতে আসা। ক্লাস নেই। অনার্স থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা হলো। মায়ের জরুরি তলব। এই সময়টুকু ঢাকায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও কাটিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মাতৃ-আদেশ অলঙ্ঘ্য। গ্রীষ্মকালীন সব ফলসম্ভারে গাছগুলোও হেলেদুলে ডাকছিল। ঝিকরগাছা পার বাজারে, কপোতাক্ষের পাড়ে, ওদের পাঁচিলঘেরা বাড়ির ভেতরেই সব গাছপালা বনভূমির মতো হয়ে আছে। দূর থেকে অভয়ারণ্য বলে ভুল হয়। এমন কোনো ফলের গাছ নেই যে ওর বাবা লাগাননি।

পিয়ারিদের বাসা জহিরের পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায়। জহিরের ছোট বোনের সঙ্গে পড়ে ও। কেবল কলেজে উঠেছে। ছোট্টবেলা থেকে তিথি আর পিয়ারি-একটি কুঁড়ি দুটি পাতা। স্কুল থেকে এসেই ওদের খেলার জায়গা হতো জহিরের পড়ার ঘরের বারান্দা। শানের ওপর কত রকম খেলা, হাসি, হুড়োহুড়ি। পড়ার টেবিলে বসে শুনত ও। ওদের চেঁচামেচি, উল্লাসে অস্থির লাগেনি কোনো দিন। বরং পড়া থামিয়ে দেখেছে। একদিন তিথি দেখে ফেলল ওর দেখে ফেলা। ‘ভাইয়া দেখছে’ বলতেই তাকাল পিয়ারি। চোখে চোখ পড়তেই দু’মুহূর্ত থেমে হেসে চোখ নামাল। ওদের খেলা আবার শুরু হলো, ধীরে। প্রথমে খাসখুস, অস্ফুট শব্দ, তারপর কথা, হাসি, -আগের মতো।
সেদিনও তো ওরা এই এতটুকু ছিল। …কেবল হাইস্কুলে পা রাখল। ওদের দৈনন্দিনতার স্তর হাই হলো না। চুল বেণি করে বুকে বই চেপে সন্ধ্যায় পিয়ারি আসত। বারান্দায় বসে পড়ত দুজন। কিছু জানার থাকলে বই মেলে ধরে দৌড়ে এসে জেনে নিত তিথি। ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত পিয়ারি তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে তিথি বলত, আমি তো কতবার গেলাম, এবার তুই যা। পড়াটা বুঝে আয়। জিজ্ঞেস কর, ভাইয়াকে। লজ্জা পেলেও মনে খুুশির উড়াল নিয়ে আসত। পড়া বলার সময় পিয়ারির পলক পড়ত না। মাঝে মাঝে তাকালেও ওর চোখ থির হয়ে দেখত জহিরকে।

এইটুকু মেয়ে চাহনিতে এত কথা গেঁথে রাখে কী করে! শরীরের পাপড়ি কেবল মেলছে মেয়েটার। হাওয়ার সুড়সুড়িও সয় না। জহিরও কলেজ ফাইনাল দিতে যাচ্ছে। দেহভরা মদিরা। শরীরে আধার উপচানো বাসনার জ্বর। তবু অন্তঃস্রোতের মতো নিথর, আপাত চলমানতায় স্থির তাকিয়ে তাকিয়ে পড়া বলে দিত। শেষে সরু এক জোরালো শ্বাস বের হয়ে আসত। জহিরের নিঃশ্বাস পিয়ারির বই ধরে রাখা হাতে ঝড় আনত। মনে হতো, হাত দুটো যদি হঠাৎ মালা হতো বকুলের। এখনই জড়িয়ে নিতে পারত জহিরের গলা। ধীর, প্রকম্পিত পায়ে পিয়ারির চলে যাওয়া দেখে আবারও সেই শ্বাস ফেলত জহির। টের পেয়ে যেত পিয়ারি।
আপনি আর কত দিন ওই নিঃশ্বাস লালন করবেন, জহির ভাই?

হুম?
হুমম। বলছি আর কত দিন?
কী?
কিছুই জানেন না? বুঝতে পারছেন না?
না তো।

‘না তো’ বলে ঠোঁট কামড়ে মাথা নোয়াল জহির। পুবের জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। উত্তরের জানালায় মশারির দেয়ালের আড়াল। কুয়াশার মতো লাগছে পিয়ারির চোখে। একবার জহিরের দিকে আরেকবার অকারণে এক কোণ পড়ে যাওয়া ত্রিকোণ কুয়াশা-স্বচ্ছ মশারিটার দিকে দেখছে। এই গরমের কাল, শীতের ভোর এঁকেছে। সূর্যটার প্রচেষ্টা ধোঁয়া ধোঁয়া আকাশটাকে আলো দেবার, নীল করে তুলবার!

কেবল রোদ উঠল। আলোয় হেলান দিয়ে আছে জহির। এলোমেলো চুলের মেঘ ছাপিয়ে চিবুক, কান, মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে আছে। আনত মুখ। ঠোঁট দুটো জবাফুল। ওই ফুলে হাত রাখতে চেয়েছে কত দিন পিয়ারি। মেয়েরা ছেলেদের অন্তর্লোক দেখতে পায় একনজরে, জানত। মিথ্যে তা। হয়তো জহিরের বেলায়। কলেজের কতজনের চোখ পড়ে নেয় নিমেষে। এই একজনই এমন কেন হলো? কেন ও তাকায় শুধু! দেখে না কেন? এমন প্রশ্নে নিজেই শরমে মরে যায় মনে মনে। তবু সুখদ লজ্জাটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। সবটুকু সামনের এই আঁধার-প্রাচীর, প্রাচীন-মন বালকের কাছে বন্দী। কলেজের পারভেজ ছেলেটা কতভাবে নিবেদন করতে চায়। পিয়ারি, খুশির সরলতায় সামলে নেয়। খিলখিল হাসিতে, উড়ে যায় পারভেজের স্বপ্নমেঘ। পারভেজ আর জহিরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়েও দেখতে চায়নি কোনো দিন। তবে যেন ছায়ামূর্তির মতো সেদিন ভরদুপুরে ওর সামনে দুজনই দাঁড়াল, আমগাছটার তলায়। পিয়ারি উঠোনে মোড়া পেতে বসা। পারভেজ মোমের মতো ফরসা। ভাগ্যিস গাছের নিচে রোদ ছিল না। গলে যেত। আর জহির! সেই চির-বালকই রয়ে গেল।

বেতের মতো গড়নে একটু শুধু ভারিক্কি এসেছে। মুখশ্রীর মসৃণতা নিয়েছে শ্মশ্রু। স্কুলে পড়ার সময় ও যখন কলেজে উঠল, ভাবত পিয়ারি আর তিথি বাচ্চামেয়ে, বোঝে না কিছুই। অথচ ওর চলা, কথা বলা, তাকানো, সবই ইন্দ্রজাল। এখন না হয় মাসের পর মাস চোখের আড়ালে। তখন তো ছিল দিনের অনেকটা সময় দৃষ্টির আকাশেই। দূরের মেঘ হতে পারেনি। রাতে চোখের তারা। দিনে স্বপ্নের সূর্য হতো জহির। কতবার ভেবেছে, তিথিকে দিয়ে বলাবে, ‘তোর ভাইকে ভালো লাগে, বল না আমার হয়ে।’ সাহস হয়নি। তিথি ঠিকই করে দিত কাজটা। এখনো টিপ্পনী কাটে। বলে, ‘এখনো এজাহার করিসনি পিয়ার, মেরি সেহেলি, পিয়ারি। হিহিহি।’ পিয়ারি হেসেছে। সেই হাসির অর্থ কেউ জানবে না কোনো দিন।

জহির জানে। কারও দৃষ্টি যদি আকাশ হতে পারে, সে পিয়ারির। চাঁদ, তারা সূর্যের মতো আগলে রাখে জহিরকে। চোখের সামনে বড় হয়ে উঠল। খুকি থেকে তরুণী। ও যখন হেঁটে যায়, গোলাপ লজ্জা পায়। আকাশ আঁধার হয়ে আসে এলোচুলে। গোসলে গেলে, গাঙের স্বচ্ছ কালো জল দেখলে মনে হয়, এই রং পিয়ারির কেশ-নিসৃত। ওর নির্জন-স্নানে সকালের নিথর নদী সাঁতার শেখে, দুপুরের গাঙ রূপসী হলো ওর রঙে। এই সেদিনও জহির যখন পুকুরের পাড়টায় বসে ছিল, ও এল। পিয়ারির সরু কপালের দু’পাশ দিয়ে নেমে আছে চিরুনির মতো চুল। তবু যেন মনের মধ্যে এক অবিরাম ভুল নিয়ে ভ্রমরের মতো উদ্্ভ্রান্তি।

নিঃশব্দ-কথন, কতক্ষণ! একজন ভাবছে, ভাবনায় জবাব দেয় অন্যজন। জহির উঠে মশারি গোটাল। ভাঁজ করে রাখল বালিশের পাশে। পিয়ারি দাঁড়াল। বিছানার চাদর টেনে টেনে হাত বুলিয়ে মসৃণ করে রাখছে। পায়ের দিক থেকে জ্বরতপ্ত শরীরে মমতার হাত বোলানোর মতো বুলিয়ে গেল। জহির ‘একটু আসছি’ বলে বাইরে পা বাড়াল। পিয়ারি আড়াআড়ি পড়ে থাকা পাশ-বালিশের কোমর ধরে বিছানার এক পাশে লম্বালম্বি করে দিল। মাথার বালিশ রাখল সোজা করে। ওয়াড় উঠে গিয়ে অর্ধনগ্ন হয়ে আছে বালিশের পেট। বালিশ দুটো টেনে কোলের ওপর রেখে কোনা গুঁজে গুঁজে ঠিক করছে। রাখতে যাবে এমন সময় জহিরের মাথার কাছ থেকে কিছু একটা পড়ে গেল নিচে। উঠিয়ে দেখে, একটি মেয়ের ছবি। সেই ছবিতে নিজেকে দেখতে চাইল পিয়ারি। কীভাবে দেখবে, ছবি তো আর আয়না হয় না!

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার।
কমেন্ট বক্স