Thikana News
২২ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

তোমার অসীমে

তোমার অসীমে



 
নিচু হয়ে যাওয়া ঢালু পথটা বেঁকে গেছে ডান দিকে। এরপরই বিস্তীর্ণ একটা মাঠ। আর বাম দিক দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে সোজা জঙ্গলের দিকে। কিছুটা পথ পেরিয়ে গেলে পাহাড়ি একটা নদী। স্রোতস্বিনী নদীতে টলটলে স্বচ্ছ জল। নদীর বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় পাথর। বয়ে চলা পাথুরে নদীর বুক থেকে অবিরাম বেজে ওঠে অদ্ভুত এক সুর মূর্ছনা। অনেকটা দূর থেকেও যেন ভেসে আসে মোজার্টের জাদুর মায়া। নদীর দুই ধারে বড় বড় গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। আর এক পাশে কাঠের চমৎকার একটি দোতলা বাড়ি। চারপাশ ঘিরে বারান্দা। সব দিক থেকেই প্রকৃতির সুধা অনুভব করা যায়। বাড়ির প্রবেশপথ বাহারি ফুল দিয়ে ঘেরা। ফুলগুলোকে জয়া চেনে, তবে যে সুঘ্রাণ ভেসে আসে; তা অন্য কিছুর। সে কখনো হাসনাহেনার গন্ধ পায়। কখনো বেলি, জুঁই কিংবা গন্ধরাজের সুবাস ভেসে আসে। কখনো সে সকালের সোনারোদে নরম দূর্বাঘাসে মায়ায় মাখামাখি হয়ে ছড়িয়ে থাকতে দেখে একগুচ্ছ শিউলি ফুল। বকুল ফুলের মায়া কিংবা কামিনীর ছায়া হৃদয়ে থাকে সব সময়। অবশ্য এসবই তার কল্পনা। তবু ভালো লাগে।

ঘন জঙ্গলে মাঝে বাড়িটায় কাটে জয়ার দিনরাত্রি। বলতে গেলে একাই থাকে সে। ভয়ডর নেই। তেমন কিছু মনেও হয় না। বরং এটাকেই তার কাছে স্বর্গ বলে মনে হয়। ধারেকাছে তেমন কোনো ঘরবাড়ি নেই। জনমানবের দেখা মেলে কখনো কখনো। অনেকে পথ ভুল করে চলে আসে। কেউ দেখতে আসে স্বচ্ছ জলের নদীটাকে। জয়ার সঙ্গে তখন যা একটু কথা হয় তাদের। এর বাইরে অনেকটা চুপচাপ আর কখনো নিজের সঙ্গে কথা বলেই কাটে তার বেলা। অবশ্য প্রতিটা সময়, প্রতিটা মুহূর্ত তার কাটে অন্য এক আনন্দে। তার চোখ দুটো চেয়ে থাকে আঁকাবাঁকা ওই পথের দিকে। কারণ এই পথ ধরেই সে আসে। অনির্বাণ আসে তার কাছে। তখন সত্যিই স্বর্গ নেমে আসে।

অরণ্যের ধারে হরিণীরা ঘোরে। ডাহুক ডাকে অরিবাম। খরগোশেরা ছুটে বেড়ায় এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। নানা রঙের পাখি উড়ে যায় নানা ঢঙে। রাতে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়। কখনো ভেসে আসে অদ্ভুত কোনো শব্দ। কেউ যেন আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে। ওসবে জয়ার কোনো মন নেই। খানিকটা দূরেই পুরোনো একটা গির্জা। সেখান থেকে প্রায়ই ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে। সব মিলিয়ে রহস্যময় একটা পরিবেশ। আর এই নির্জনতা, এই রহস্যই ভালো লাগে জয়ার কাছে।

তবে তার জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে যে এমন নির্জনতায় কেটেছে, তা কিন্তু নয়। বরং কোলাহল আর জনমানবের মধ্যেই ছিল তার একেকটা দিন। পেশায় সে ছিল হাইস্কুলের আর্ট চিটার। প্রতিদিন স্টুডেন্ট, তাদের বাবা-মা কিংবা সহকর্মীদের সঙ্গে কত কথা যে ছিল তখন। সবার প্রিয় টিচার ছিল জয়া। ছবি আঁকাটাকে সে উপভোগ করত। এমনভাবে স্টুডেন্টদের শেখাত, তারা মনে করত এর চেয়ে ভালো সাবজেক্ট বোধ হয় পৃথিবীতে নেই। কেবল শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন আর্টিস্ট হিসেবে ভীষণভাবেই সফল ছিল জয়া। পৃথিবীর রাজধানী বলে পরিচিত নিউইয়র্কে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে অসংখ্যবার। এমনকি ম্যানহাটনের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টসের একটি প্রদর্শনীতেও তার একটা ছবি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। বিক্রিও হয়েছিল চড়া মূল্যে। সে সবই এখন ইতিহাস। পেছনে ফেলে আসা দিন। হাজারো মানুষের কোলাহল ছেড়ে এখন স্বেচ্ছায় এমন জীবনই বেছে নিয়েছে জয়া। তার কাছে এই জীবনই অনেক বেশি মূল্যবান বলে মনে হয়।

স্বপ্ন ছিল অবসরে যাওয়ার পর এমন একটি জীবনই বেছে নেবে সে। জয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সে অনন্ত নির্জনতাকে বেছে নিয়েছে। নির্জনতাও পরম মমতায় ঘিরে রেখেছে তাকে। তার এই জীবনে কেবল একজন মানুষের উপস্থিতি থাকবে; সে অনির্বাণ। এই মানুষটিকে জীবনভর ভালোবেসেছে জয়া। পাওয়া, না পাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়েও সব সময়ই যে ছিল, আছে আর থাকবে তার জীবনে। শেষ নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কিংবা তারও পরে, অনন্তকাল ধরে।

নিউইয়র্ক শহর থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। ঘণ্টা দুয়েকের পথ। পেনসিলভানিয়ার পোকোনো পাইনসে। পাহাড়ি জনপদে জঙ্গলের ধারে একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি কেনার কথা ভাবত সে। অবসরে যাওয়ার পর বেশ কিছু ডলার জমা আছে জয়ার ব্যাংকে। পেনশন, সোশ্যাল সিকিউরিটি কিংবা বিভিন্ন সময়ে তার ছবি বিক্রির অর্থ মিলিয়ে ঢের আছে তার। এর পরও জয়া ভাবত, এই বাড়িটা তাকে অনির্বাণ কিনে দিক। অনির্বাণের সেই সামর্থ্য অবশ্য ছিল না। তবে ছিল প্রবল ইচ্ছা। সেই ইচ্ছারই জয় হয়েছে শেষমেশ। জয়ার ইচ্ছাটা সে পূরণ করতে পেরেছে। এ জন্য নিজের জীবনকে সার্থক ভাবে অনির্বাণ। জয়া বাড়িটার নাম রেখেছে ‘তোমার অসীমে’। তাদের দুজনের ভালোবাসার রং, রূপ আর রস অন্য ভুবনের। অন্য জগতের। তারা দুজন দুজনের। তাদের জন্মই যেন দুজনের জন্য। প্রকৃতিও তাই তাদের দুজনকে কখনো আলাদা হতে দেয়নি। প্রেম, বিরহ, ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকা মায়ায় পূর্ণ একটি জীবনই কাটিয়েছে তারা। সেই পথ এখনো বাকি। এখনই তো আসল সময়। একে অপরের বুকে, কাঁধে মাথা রাখার। স্পর্শ অনুভব করার। ব্যস্ততা, মানুষের কুটিল চোখ কিংবা চরম বাস্তবতা; অনেক কিছুই করতে দেয়নি তাদেরকে। এখন তারা এসব কিছুর অনেক ঊর্ধ্বে। জীবন যেখানে কেবলই ভালোবাসাময়; বিপুল ও অর্থপূর্ণ।
আকাশজুড়ে বিশালাকৃতির একটা চাঁদ উঠেছে। মনে হয় আজ ভরা পূর্ণিমা। নদীর পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, গোলগাল একটা রুপার থালা; পানিতে টলমল করছে। পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসে আছে দুজন। আজ অনির্বাণ এসেছে। খুব কাছাকাছি বসে তারা। জয়ার চোখেমুখে অদ্ভুত একটা দ্যুতি। সে অনির্বাণের কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। অনির্বাণ একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। জয়ার হালকা নিঃশ্বাস এসে কখনো পড়ছে অনির্বাণের শরীরে। পাশেই একটা ইজেলে রাখা একটা ছবি। অনেক দিন পর জয়া একটা ছবি এঁকেছে। অনির্বাণের ছবি। গালে হাত দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে সে। জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই ছবি।

অনির্বাণ মাছ খেতে পছন্দ করে। সঙ্গে সাদা ধবধবে ভাত। একটু ডাল আর আলুভর্তা হলে তো কথাই নেই। আজ খুব যত্ন করে এসব কিছু রান্না করেছে জয়া। অনেক দিন পর কী তৃপ্তি নিয়েই না খেল মানুষটা। তার চোখ দুটো দিয়ে কয়েক ফোঁটা আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল। যদিও জীবনভর সে চোখের জল খুব একটা ফেলেনি। দৃঢ়চেতা জয়া ভাবে, চোখের জল অনেক দামি। এ জিনিস হেলায় ফেলে দেওয়ার জন্য নয়। তবে আজ মহামূল্যবান এমন দৃশ্যে চোখের জল ফেলতেও তার কোনো আপত্তি নেই। এখন থেকে প্রতিদিন যে অনির্বাণকে এমনিভাবে যত্ন করে খাওয়াতে পারবে; পাশে পাবে। আদরে আর মমতায়। কারণ অনির্বাণ বলেছে, আর কোনো দিন সে ফিরে যাবে না। বাকি জীবনটা এখানেই তারা থেকে যাবে দুজন। আজ তাই জয়ার মনটা খুব ভালো।

তারা দুজন মিলে ঠিক করেছে, বাড়ির কাছাকাছি কোথাও একটা নার্সারি তৈরি করবে। সেখানে থাকবে ছোট্ট একটা কফিশপও। দূরদূরান্ত থেকে হঠাৎ আসা কিংবা গির্জায় প্রার্থনার জন্য জড়ো হওয়া মানুষগুলো আসবে তাদের নার্সারিতে। তারা নার্সারি থেকে গাছ কিনবে। কেউবা কেবলই ঘুরে ঘুরে দেখবে। অবসরে কেউবা অনন্ত সুখে কফিশপে বসে কুণ্ডুলী পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ামাখা কাপে চুমুক দেবে। গল্পে-আড্ডায় মেতে থাকবে মানুষ। তারা দুজন হবে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ঘুরে ঘুরে নয়; একটি জায়গা থেকেই তারা স্বপ্ন বিক্রি করবে। জয়ার বাড়িয়ে দেওয়া একটা হাত দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে অনির্বাণ। সেই স্পর্শে কত মায়া, কত প্রেম। সেই স্পর্শে শক্তি, সাহস আর আস্থা। সীমার মাঝেই এ যেন অসীম এক অনুভূতি। অনির্বাণের গানের গলা বেশ ভালো। জয়া বলল, ‘একটা গান করো না আজ।’ মৃদু হেসে অনির্বাণ গান শুরু করল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটা যেন অনির্বাণের কণ্ঠের জাদুতে জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে পড়তে শুরু করল আকাশ থেকে। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঐন্দ্রজালিক একটি পরিবেশ তৈরি হলো। অনির্বাণ নিজেকে উজাড় করে গাইছে : ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই/ কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই…।’

লেখক : সাংবাদিক ও টিভি প্রেজেন্টার।
কমেন্ট বক্স