বিশ্ব ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গের ইতিহাস বিশ্বে নজিরবিহীন। যাদের আত্মত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এই মহান ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। সেই সব সূর্যসন্তান ও ভাষাসৈনিক-সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অসংখ্য শহীদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সালাম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনই বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনা পর্ব। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার সে স্ফুরণ ঘটেছিল। তাই পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণা সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের পথ ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ৬ দফা ও ২১ দফার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালি জাতির উত্থান ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম।
ফেব্রুয়ারি বা ফাল্গুন মাস এলেই প্রকৃতির মোহনীয় রূপ রঙিন হয়ে ওঠে বিভিন্ন ফুলের সমারোহে, আমরাও প্রাণ ফিরে পাই। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য বীর শহীদদের আত্মত্যাগের জন্য হই আপ্লুত ও উজ্জীবিত। পঞ্জিকার পাতায় এক উজ্জ্বল দিন ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি। একুশ আমাদের অহংকারের দিন, জাতীয় জাগরণের দিন। রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে বাংলা পায় তার যোগ্য স্বীকৃতি।
ব্রিটিশশাসিত বাংলায় সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১১) রাজনীতিতে ইংরেজির জায়গায় বাংলা ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকে। রাজনীতি তখন মিলনায়তন ছেড়ে চলে আসে মাঠে-ময়দানে ও রাস্তায়, তখনই সূচিত হয় জনজাগরণ। রাজনীতিতে ইংরেজি নিয়ে গণজাগরণ সম্ভব হতো না। স্বদেশি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার লেখক-পাঠকদের ও জনসাধারণের মধ্যে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিরাট উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আশা দেখা দিয়েছিল।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কালেও বাংলা ভাষার লেখক-পাঠকদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন বাংলা ভাষার লেখক-পাঠকদের মনে জাতীয় জীবনে বড় কিছু অর্জনের প্রবল আকাক্সক্ষা দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে গোটা ভারতে বাংলা ভাষা ছিল অন্যতম প্রধান অবলম্বন। সেটা ছিল রেনেসাঁসেরও কাল।
আমাদের জাতীয় জীবনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাস রয়েছে। ফাল্গুন বা ফেব্রুয়ারি, মার্চ, আগস্ট ও ডিসেম্বর। তেমনিভাবে ৮ ফাল্গুন বা ফেব্রুয়ারি মাস শহীদদের মাস। আন্দোলনের মাস।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দুভাগে ভাগ হয়। একটি নাম ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ-একটি পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। দূরত্ব প্রায় ১২০০ মাইল, মাঝখানে ভারতবর্ষ। যদিও লাহোর প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল মুসলিমদের জন্য দুটি রাষ্ট্রÑএকটি ‘বঙ্গস্থান’ ও অন্যটি ‘পাকিস্তানি’, কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘স্টেটস’ এর স্থলে ‘স্টেট’ লিখে দিয়ে ইংরেজদের কাছ থেকে ‘এক পাকিস্তান’ এনেছিলেন। এই যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, তা জিন্নাহর জীবিতকালেও ছিল, এর পরও পাকিস্তানিরা তা ধরে রেখেছিল।
প্রথমেই শুরু হয় আমাদের মায়ের ভাষার ওপর সেই ষড়যন্ত্র! পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নর জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের একটিই ভাষা হবে, আর সেটি হবে উর্দু। একই সালে আবার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের ব্যবহারিক ভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তখন বললেন, এটা মুসলিম দেশ, তাই উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আমিন তাকে সমর্থন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের বক্তব্যে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এভাবেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র ও পাশাপাশি ছাত্রদের আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা একসময় বৃহত্তর আন্দোলণে রূপ নেয়। তবে তখনকার ছাত্ররাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি ছিল না। ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল আদর্শের বড় জায়গা।
একসময় আসে সেই ফাল্গুন বা ফেব্রুয়ারি মাস, ১৯৫২ সাল। একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল সেই প্রাক্তন পরিষদ ভবনে, যা ছিল আজকের জগন্নাথ হলের মিলনায়তন। সেদিন ছাত্ররা মিছিল করে কলাভবন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তখন কলাভবন ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব দিকের বিল্ডিং। সেই ঐতিহাসিক আমতলায় মিটিং শেষে ১০ জন করে মিছিল নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের শপথ নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাহিনী মিছিলের ওপর বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ করে। এতে সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকত শহীদ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের উত্তর দিকে সেখানেই শহীদ মিনার স্থাপিত হয়। পরে বহু উত্থান-পতনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে এই শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়। আজও এই শহীদ দিবস আমরা পালন করি।
একসময় পাকিস্তান সরকার আমাদের জাতীয় ভাষা, অর্থাৎ মায়ের ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ক্যামেরায় ছবি ধারণ করেন। প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী কবিতা লিখেছেন :
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
আলতাফ মাহমুদ সেটিকে সুর দিয়ে গানে পরিণত করেন। এখন আমরা প্রতিটি ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ গান গেয়ে প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে ফুল দিই। রক্ত দিয়েই আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে জাতীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করেছি।
মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার, মৌলিক অধিকার। জন্মের পর মায়ের কোলেই মানুষ মাতৃভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়। মাতৃভাষা শেখানোর বিষয়টি পূর্ণতা পেতে থাকে শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে। শিক্ষা তথা জ্ঞান অর্জন ছাড়া মানুষ যোগ্য হতে পারে না, জাতি এগোতে পারে না। কিন্তু ভাষা ছাড়া কি জ্ঞানার্জন কখনো সম্ভব?
বাঙালি জাতির সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎসই হলো আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন। চার দশক পর্যন্ত শুধু বাংলা ভাষার লোকজনই দিবসটি পালন করত। পরে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালামের যৌথ প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয় এবং ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
তবে অভিবাসী জীবনে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে ১৯৯৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারার ব্যবস্থাপনায় প্রথম অস্থায়ী শহীদ বেদিতে পালন করা হয়েছিল। গত দশকে বাংলাদেশ সোসাইটি, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন, এমসি অ্যান্ড গভ. কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে জাঁকজমকভাবে পালিত হয়ে আসছে শহীদ দিবস।
নিউইয়র্ক সিটির প্রতিটি বরোতেই অগণিত অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয় এবং চার শতাধিক সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাজীবী সংগঠন মাতৃভাষা দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে।
উল্লেখ্য, কয়েক বছর যাবৎ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে ব্রঙ্কস ও কুইন্সে প্রভাতফেরি অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃক কুইন্স ও ব্রঙ্কসে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তা বাস্তবায়িত হবে বলে স্থানীয় কমিউনিটি বোর্ডের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এন মজুমদার এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব ব্রঙ্কসের সভাপতি সামাদ মিয়া (জাকের) ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এমরান আলী জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রায় ৩৪ বছর আগে ১৯৯০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যখন বাংলা পত্রিকা ঠিকানা প্রথম প্রকাশিত হয় নিউইয়র্কে, তখন কি কেউ ধারণা করতে পেরেছিল, ঠিকানা কমিউনিটির জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ, এতটা সহায়ক হয়ে উঠবে? ঠিকানা যেমন সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কমিউনিটিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কমিউনিটিও বিশ্বস্ততার সঙ্গে ঠিকানাকে জড়িয়ে রেখেছে এবং সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে ঠিকানা ৩৪ বছরে সব সময়েই অগ্রগামী। এই জায়গাটি অন্য আর কোনো সহযোগী পত্রিকার পক্ষেই স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। ঠিকানা আমেরিকায় অদ্বিতীয়। ঠিকানা যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে ততটুকু দিতে কার্পণ্য করেনি। প্রবাসে জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্র ঠিকানার ৩৪তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এম এম শাহীন এবং প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমানসহ সকল কর্মকর্তাকে অভিনন্দন ও একুশের চেতনায় আগামী দিন সবার জন্য শুভ হোক। এ ছাড়া সাপ্তাহিক ঠিকানার ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ৭১তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সফল হোক।
প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভাষাকন্যা উপাধি দিয়েছিলেন। এর একটি কারণও ছিল। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের ব্যাপারে তার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। ইউনেসকোর প্যারিস সম্মেলনে তার উদ্যোগেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করা হয়। বাংলাদেশের এত বড় সম্মান প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই অর্জিত হয়।
বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কোথাও তার ব্যবহার নেই। বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা করে তুলতে না পারলে এই ভাষা শুধু সাহিত্যের ভাষা হয়ে থাকবে। সাধারণ মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের ভাষা হয়ে উঠতে পারবে না। বাঙালি ডাক্তার বাংলায় ওষুধের প্রেসক্রিপশন এখনো লিখতে পারেন না। বাংলায় কোনো বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক চিঠি লেখা যায় না।
বাংলা ভাষা যখন একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা; তখন ইংরেজি, ফারসি ইত্যাদি ভাষার মতো বিজ্ঞানের ও কারিগরি শিক্ষা চর্চার ভাষা করে তুলতে হবে। বাংলায় যাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষাদান করা যায়, সে জন্য শুধু গবেষণা নয়, আন্দোলনও দরকার। পণ্ডিতেরা অনেক সময় তাদের রক্ষণশীলতার জন্য ভাষা সংস্কার করতে পারেন না। যেমন পণ্ডিতেরা টেলিফোনের বাংলা করেছিলেন ‘দূরালাপনী’ এবং চিফ সেক্রেটারিকে করেছিলেন ‘মহাকারণিক’, ভ্যানিটি ব্যাগের হিন্দি করা হয়েছিল ‘ফুটানিকা ডিব্বা’। এর একটিও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। তারা টেলিফোন, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি শব্দকে নিজের ভাষা করে নিয়েছে। গ্রামের মানুষ পর্যন্ত এখন জানে ‘হাইজ্যাক’ শব্দের অর্থ কী? সবাই এর অর্থ জানে এবং ব্যবহার করে।
বাংলা একাডেমির উদ্দেশ্য শুধু বাংলা ভাষায় বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ করা নয়, তাকে বিদেশি ভাষা থেকে বিজ্ঞান ও কারিগরি চর্চার নতুন নতুন শব্দ আহরণ করতে হবে। বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ রচনার উপযোগী করে তুলতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশে জিম্বাবুয়ের মতো গণ-আন্দোলন দরকার। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের শাসনামলে ইংরেজি ভাষাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সরকারি কাজের সকল স্তরে জিম্বাবুইয়ান ভাষা ব্যবহারে জনগণকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু মুগাবে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাদানের শব্দ ইংরেজি ভাষা থেকে তার ভাষায় গ্রহণ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন তাদের কোনো কোনো স্বদেশি ভাষায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হয়। কোনো কোনো আফ্রিকান দেশে যা সম্ভব হয়েছে, বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি। তার কারণ আমাদের রক্ষণশীল আমলাতন্ত্রের মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রতি অতিরিক্ত প্রভুভক্তি।
আজ খুব কষ্ট লাগে, যখন শুনি, অনেকেই বেদনা নিয়ে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলা ভাষার এ বেহাল অবস্থা কেন? পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকেরা গেল, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটল কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর থেকে শনির দশা কাটল না। বাংলা ভাষা যেন দুঃখিনী ভাষা হয়েই রয়ে গেল। আফসোস নিয়ে বরং বলা যায়, অনাবাসী বাঙালিরা যত ভালোবাসা নিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখেন, বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন, যারা স্বাধীনতার সর্বাধিক বেনিফিশিয়ারি, তাদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে লালন, যত্ম ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তত আন্তরিকতা লক্ষ করা যায় না।
প্রশ্নটা এসেই যায়, কেন এ অবস্থা ? কেন এত কার্পণ্য? কেন এত অবহেলা? ব্রিটিশ কলোনির বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল-জুলুম খেটে, জীবন দিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান হলো। সবাই স্বাভাবিকভাবে ভেবে নিল, ইংরেজ বিদায় হলো, এবার পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের নিজ নিজ ভাষা ব্যবহার, চর্চা ও লালনের সুযোগ পাবে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীও তাদের আত্মপরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে। তারা স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে, চর্চা ও সর্বস্তরে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করার অবাধ সুযোগ পাবে।
হায় কপাল! ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে দিল। সাত-আট মাস যেতে না যেতেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চালাকি ও শঠতা ধরে ফেলল। ১১ মার্চ তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এসে অন্য জাতিগোষ্ঠীর কোনো ভাষার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ বাঙালি ছাত্রসমাজের সামনে এমন বিবস্ত্র দম্ভোক্তি ছাত্ররা মেনে নেবে কেন? পাকিস্তানের আন্দোলন শেষ, বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু।
বাংলা ভাষার জন্য শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, শফিক আত্মদান করেছেন। এখন তাদের সেই আত্মত্যাগকে শুধু স্মরণ করা হয়। কিন্তু তারা যে উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই উদ্দেশ্য পূরণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে নিজের ভাষাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার কন্যা শেখ হাসিনা একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা করেছেন। এখন সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। এরই সঙ্গে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান উচ্চতর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা উচিত। বাংলা ভাষার সংস্কার ও উন্নতির জন্য আরও দরকার পণ্ডিতদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদেরও সংযোগ স্থাপন করা এবং সেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা এবং তা হবে বাংলা ভাষায়।
আমাদের সেই ভাষা আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। আজ ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। এটা আমাদের গর্ব। তাই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষাকেও আধুনিক প্রযুক্তির ভাষা হতে হবে। নইলে বাংলাদেশ বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির যুগে পিছিয়ে যাবে। ভারত এদিক থেকে এগিয়ে গেছে। বাংলা ভাষাকেও এগোতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিই পারে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে যাওয়ার সেই উদ্দীপনা জাগাতে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, দমন-পীড়ন, নিষ্ঠুরতা, উগ্রতা ও বৈরিতা নিয়ে কথা বলতে হয়। একুশের সঙ্গে ন্যায়, মানবিকতা, অধিকার-ভাবনা ও গণতান্ত্রিক চেতনা যে উচ্চতায় জড়িত ছিল, বর্তমান সময়ে তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের একুশের আনুষ্ঠানিকতা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারছে না। বিষয়টি কি আমাদের জন্য দুঃখজনক নয়?
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক।