অনেকে বলেন, ‘মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার নজির রয়েছে একমাত্র ঢাকাতেই।’ এটা যারা বলেন, তারা হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নন অথবা না বুঝেই বলেন। মাতৃভাষার জন্য সবচেয়ে বেশি মানুষের রক্ত দেওয়ার ঘটনা ঘটে এই সাব-কন্টিনেন্টেই। তবে সেটা ঢাকায় নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতের আসামের শিলচরের বরাক উপত্যকায়। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচরে মাতৃভাষার দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়। শিলচরের বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা দাবির এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সেখানেই ঝরে পড়ে ১১টি তরতাজা প্রাণ, যাদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য নামের এক নারীও ছিলেন। যে ১১ জন মানুষ মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে পুুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান, তারা সবাই একসময় এই বাংলাদেশের অধিবাসী ছিলেন। তাদের সবারই জন্ম এই বাংলাদেশেই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ব্রিটিশদের এক অদ্ভুত নিয়মে সিলেটের করিমগঞ্জ জেলা আসামের ভাগে চলে যায়। বাংলাদেশের এই মানুষগুলো হয়ে যান অসমীয়া তথা ভারতীয়।
এখানে একজন নারীকে নিয়ে আলোচনা করব, যিনি মাতৃভাষা আন্দোলনের একমাত্র শহীদ নারী। তিনি সিলেটের ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। তিনি বাংলা ভাষার জন্য প্রথম এবং একমাত্র নারী শহীদ।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
ভাষাবিপ্লবী কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৫ সালে অবিভক্ত বাংলার সিলেটে। তাঁর বাবার নাম রামরমন ভট্টাচার্য এবং মা সুপ্রবাসিনী দেবী। ছেলেবেলায় বাবাকে হারান কমলা। সাত ভাইবোনের মধ্যে কমলা পঞ্চম আর বোনদের মধ্যে তৃতীয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কমলারা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আবারও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার এবং গণহারে হত্যা শুরু হলে কমলার পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারই রেশ ধরে সাত সন্তানকে নিয়ে বিধবা সুপ্রবাসিনী দেবী ভারতে পাড়ি জমান। পশ্চিমবঙ্গে না গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন একসময়ের অবিভক্ত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে শিলচরে পা রেখেছিল কমলা।
শিক্ষাজীবন
কমলার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ‘ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউট’-এ। একে তো উদ্বাস্তু, তার ওপর অনটনের সংসার। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সিংয়ের চাকরি পেয়ে প্রশিক্ষণের জন্যে শিমুলগুড়ি চলে যান। কমলার মেজো দিদি প্রতিভা ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। অর্থনৈতিকভাবে গোটা পরিবার তার ওপরই নির্ভর ছিল। বইখাতা কেনার পয়সা ছিল না কমলার। সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার করে খাতায় টুকে নিয়ে পড়ত কমলা।
শোনা যায়, একটি অভিধানের জন্য বোন প্রতিভাকে বলেছিল কমলা। অর্থের অভাবে সেটাও কিনে দিতে পারেনি বোন। অভাবের মাঝে বড় হওয়া কমলা তবুও স্বপ্ন দেখে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করার। পড়াশোনার পাশাপাশি টাইপরাইটিং শিখে একটা কেরানির চাকরি হলেও জুটিয়ে নেবে। তাহলে আর মায়ের কষ্ট থাকবে না।
১৯৬১ সালে কমলা ক্লাস টেনের ছাত্রী। এ সময় বরাক উপত্যকা মাতৃভাষার সংগ্রামে উত্তাল হয়ে ওঠে। অভাবের সংসারে বেড়ে উঠলেও কমলা ছিল প্রতিবাদী স্বভাবের মেয়ে। আসাম রাজ্য সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে সেও ছিল সোচ্চার।
মাতৃভাষার সংগ্রামে
১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিলচরের কাছাড়ে গঠিত হয় ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সেখানে নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষাসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কমলা। সামনেই তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে চলে যায় সত্যাগ্রহী আন্দোলনে।
১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে ‘সংকল্প দিবসে’ সেও অংশগ্রহণ করে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার শপথ নেয়। এদিকে সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীরা ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু করে পদযাত্রা শেষ করে ২ মে শিলচরে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা করে, ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ভাষা বিল বাতিল না হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে।
১৮ মে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। তাই পরীক্ষা শেষে হরতালে যেতে আর কোনো বাধা নেই। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করল কমলা। দেশ ছেড়ে আজ পরবাসে। তাদের পরিচয় উদ্বাস্তু। যে ভাষাটা নিজের ছিল, সেটাও আর থাকছে না। এই মর্মবেদনা কমলার মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। মেজো বোন প্রতিভা কমলাকে হরতালে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু কিছুতেই তাকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী মেয়ের মর্মবেদনা বুঝলেন। কিন্তু বাধা দিলেন না। নীরবে চোখের জল ফেলে মেয়েকে বিদায় দিলেন।
ডেটলাইন ১৯ মে
১৯৬১ সালের ১৯ মে সকালে মেজো বোন প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার শাড়ি-ব্লাউজ পরে কমলা বাসা থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নেয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে যেন মুখে চেপে ধরতে পারে। যাওয়ার আগে মা মেয়েকে কিছু খেয়ে যেতে বলেন। কিন্তু ঘরে কিছুই না থাকায় কমলা খালি পেটেই বের হয়। সঙ্গে ছিল কমলার সব সময়ের সঙ্গী ১১ বছরের ছোট বোন মঙ্গলা।
স্থানীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের ডাকে ২০-২২ জনের একটি নারীর দলে যোগ দেয় কমলা। গন্তব্য শিলচর রেলওয়ে স্টেশন।
মায়ের মনে সেদিন কী উঠেছিল কে জানে! দুপুরের দিকে কমলার ছোট ভাই বকুল আর বড় বোনের ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে আসেন কমলার বিধবা মা সুপ্রবাসিনী দেবী। বকুল আর বাপ্পাকে প্রথমে পুলিশ ধরলেও পরে ছেড়ে দেয়। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মাকে আবার বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় কমলা। সেই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎ।
আন্দোলনের তীব্রতায় হকচকিত এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে আসাম রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকার পুলিশের সঙ্গে আসাম রাইফেল বাহিনীকেও শিলচর রেলস্টেশনে পাঠায়। আন্দোনরত নেতাদের ধরে ট্রাকে তুলতে গেলে জনতা পুলিশের ট্রাক ঘেরাও করে।
তখন সবার মুখে একটাই স্লোগান-
‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ
মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।’
এ সময় পুলিশ ও রাইফেল বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জ থেকে বোনকে বাঁচাতে মঙ্গলাকে নিজের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে কমলা। বিনা প্ররোচনায় দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে পুলিশ ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পুলিশের একটি গুলি কমলার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। লুটিয়ে পড়ে কমলা ভট্টাচার্য। সেখানেই ১৬ বছরের কিশোরী কমলার মৃত্যু হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম এবং একমাত্র নারী শহীদ কমলা ভট্টাচার্য। এরপর একে একে আরো ১০টি তরতাজা প্রাণ ঝরে যায়। কমলার বোন মঙ্গলা আহত হলেও হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে তার চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে চিরদিনের জন্য অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে।
একমাত্র নারী ভাষাশহীদ কমলা :
কমলার মৃত্যুর পর রেজাল্ট বের হয়। মাধ্যমিকে সে ঠিকই পাস করেছিল। কিন্তু তার আর চাকরি করা হয়নি। মেয়ের রেজাল্ট নিয়ে বিধবা মা বাকি জীবন আর্তনাদ করে কাটিয়েছেন। কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। কমলাসহ সেই ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় আসাম রাজ্য সরকার।
স্বীকৃতি
কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষমূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জফলক রয়েছে শিলচর স্টেশনের এক শহীদ বেদির ওপর। শিলচর স্টেশনকে ‘ভাষাশহীদ স্টেশন’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
২০১১ সালে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে কমলার স্কুল ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউট প্রাঙ্গণে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয়। শিলচরের পাবলিক স্কুলের পাশের সড়কটির নামকরণ করা হয় ‘কমলা ভট্টাচার্য সড়ক’। এই রাস্তার পাশেই ভাড়া থাকত কমলার পরিবার।
লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক, শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর, ঢাকা।