Thikana News
২২ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

কতটুকু বাংলা শিখছে প্রবাসে নতুন প্রজন্ম

কতটুকু বাংলা শিখছে প্রবাসে নতুন প্রজন্ম



 
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যখন সরকারিভাবে বাংলার ব্যবহার বাড়ছে, তখন বাংলাদেশিদের ঘরে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মাঝে মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আশা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রজন্মের মুখে টিকে আছে মায়ের ভাষা। দ্বিতীয় প্রজন্মের মাঝে বাংলার ব্যবহার আধাআধি। কিন্তু পরবর্তী অর্থাৎ তৃতীয় প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে ধরে রাখবে কতটুকু তা নিয়ে শঙ্কা দিন দিন প্রবল হচ্ছে।
প্রবাসে নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষাকে ধরে রাখার জোরালো কোনো চেষ্টা নেই। বাংলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অসাধারণ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে গুণী শিল্পীও তেরি হয়েছে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় প্রবাসে নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষার চর্চা আশাব্যঞ্জক নয়। অভিভাবকদের এ ব্যাপারে কোনো দায়বদ্ধতা চোখে পড়ছে না। বরং তারাই সন্তানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক ইংরেজিতে কথা বলে নিজেদের সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। অথচ এই বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার আর বরকতের মত ভাষাশহীদরা। পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালি জাতিরই মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। আর এ কারণে বাংলা ভাষা বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মহান ভাষা আন্দোলনের দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি থাকলেও বাঙালীদের অবহেলা আর অবজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্রে কোনঠাসা বাংলা ভাষা।
নিউইয়র্কে বহু কমিউনিটির বসবাস। প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এরমধ্যে তিন লাখেরই বসবাস নিউইয়র্কে। বাংলাদেশি কমিউনিটি নিউইয়র্কে অগ্রসরমান কমিউনিটি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে বাংলাদেশিদের চেয়ে এগিয়ে স্প্যানিশ এবং চাইনিজ কমিউনিটি। আরো একধাপ এগিয়ে দেশপ্রেমে। নিজেদের ভাষাকে তারা বাঁচিয়ে রাখছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্প্যানিশ ও চাইনিজ কমিউনিটির তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিটি শিশু তার মাতৃভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শতকরা ৯৯ ভাগ তাদের মাতৃভাষাকে বেছে নেয়। আমেরিকান অভিবাসী নাগরিক হিসাবে ঘরের বাইরে ইংরেজির ব্যবহার করলেও পরিবারে এসব শিশুরা তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার তাদের মধ্যে হতাশাব্যঞ্জক। দিন দিন বাড়ছে এই হতাশাজনক চিত্র।
নিউইয়র্কে বাংলা ভাষার ব্যবহারে বিভিন্ন সংগঠনের চেষ্টার কমতি নেই। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাংলা স্কুল। প্রবাসে আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির নিজস্ব বাংলা স্কুল রয়েছে। আরো কয়েকটি সংগঠন বাংলা স্কুল পরিচালনা করছে। কিন্তু এসব বাংলা স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে আগ্রহ নেই বেশিরভাগ অভিভাবকের। সন্তানের জন্য বাড়তি চাপ মনে করেন তারা। আর এ কারণে নতুন প্রজন্মের শিশুরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বাংলা শিক্ষায়। তবে এতসব বাধা-বিপত্তির পরেও এই কমিউনিটিতে অনেক শিশু গড়ে উঠছে বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐহিত্য নিয়ে। আর এর পেছনে কৃতিত্ব তাদের অভিভাবকদেরই। কিন্তু বাংলা শেখার এই দৌড়ে নতুন প্রজন্মের শিশুরা পিছিয়েই থাকছে।
নিউইয়র্কের কুইন্সের জ্যামাইকার বাসিন্দা নিলুফার করিম জানান, তার সন্তানেরা আমেরিকায় জন্ম নিলেও পারিবারিক অনুশাসনে বেড়ে উঠছে। জন্মসূত্রে প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান হলেও তারা অনর্গল বাংলা বলতে পারেন। তার ছেলে-মেয়ে প্রজন্মের হলেও অনর্গল বাংলা বলতে পারেন। ঘরে তাদের বাংলা বলা বাধ্যতামূলক।
এ প্রসঙ্গে নিলুফার করিম বলেন, আমার দুই ছেলে-মেয়ে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি উত্তর দেন না বা শুনতে চান না। বাংলায় প্রশ্ন বা উত্তর আদায়ে বাধ্য করেন। তিনি বলেন, শুধু বাংলা শেখা নয়, আমি চাই আমার সন্তানেরা বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বড় হোক। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানুক। যুক্তরাষ্ট্রে এটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন, তবুও অভিভাবক হিসাবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমার বাবা-মা আমাকে যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন আমিও আমার সন্তানদের সেভাবে শেখাব। এতে করে তারাও তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শেখাবে। তাহলেই বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে।
প্রবাসের আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির বাংলা স্কুল নতুন প্রজন্মকে বাংলা শেখাচ্ছে। করোনা মহামারীর কারণে এই স্কুলের কার্যক্রমে ভাটা পড়েছিল। তবে স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো বাংলা জানে। বাসায় অবশ্য কতটুকু চর্চা আছে তা তাদের অভিভাবকেরা ভালো বলতে পারবেন বলে জানান সোসাইটির একজন কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলা স্কুল বাংলাদেশ সোসাইটির অগ্রাধিকারভিত্তিক কার্যক্রমগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলা শেখার ব্যাপারে শিশুদের আগ্রহও রয়েছে। তবে সন্তানদের বাংলা শেখানোর ব্যাপারে অবিভাবকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবাসে নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষার ব্যবহার কমছে স্বীকার করে বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী বলেন, নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হলে প্রথমে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তারা যদি আগ্রহ না দেখান তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে।
তিনি মনে করেন, নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষাকে ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের নাড়ির টান বাড়াতে হবে। তাদের বাংলাদেশ সফরে নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের শিশুরা বাংলাদেশে গেলে স্বজনদের প্রতি এবং বাংলাদেশের প্রতি দরদ বাড়ে। কিন্তু প্রবাসের অভিভাবকদের বেশিরভাগই নানান কারণে বাংলাদেশে যেতে চান না।
রুহুল আমিন সিদ্দিকী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া তার তিন সন্তান শুদ্ধ করে বাংলায় কথা বলতে পারে। এমনকী আঞ্চলিক ভাষাও তারা জানে। ঘরে তারা সার্বক্ষণিক বাংলা বলে। বাংলাদেশ এবং সেখানকার স্বজনদের জন্য তাদের টান রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন দেশে স্বজনদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছে আর এতে করে তাদের বাংলা ভাষার চর্চ্চা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নতুন প্রজন্ম বাড়ছে। এখন থেকে আমাদের সচেতন হতে হবে সন্তানদের বাংলা শেখানোর ব্যাপারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশি অভিভাবক জানান, প্রবাসে অনেকেই তাদের সন্তানদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করেন। আবার অনেক অভিভাবক আছেন যারা সন্তানদের বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দিতে চান না, বিশেষ করে যারা একটু অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যতের পায়ে কুড়াল মারছেন। তিনি জানান, কম শিক্ষিত এক শ্রেণীর অভিভাবক মনে করেন যে তাদের সন্তানেরা ইংরেজিতে কথা বলছে এটাই তাদের জন্য অহঙ্কার। কিন্তু তারা বুঝতে চান না যে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাই ইংরেজি। এই ভাষা তাদের না শেখালেও স্কুল থেকেই তারা শিখবে।
নিউইয়র্কে স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে একজন শিক্ষার্থী ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ক্রেডিট’ পায়। কিন্তু অভিভাবকদের ভুল সিদ্ধান্ত বা উচ্চাভিলাষের কারণে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা প্রথম ভাষা হিসাবে ইংরেজি এবং দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্প্যানিশ অথবা ফ্রেঞ্চ ভাষাকে বেছে নিচ্ছে। তবে পারিবারিক অনুশাসনের আবহে নতুন প্রজন্মের অনেকেই অভিভাবকের পরামর্শে প্রথম ভাষা হিসাবে বাংলা এবং দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্প্যানিশ বেছে নিচ্ছে। যেসব শিক্ষার্থী বাংলা ভাষাকে পরিহার বা অগ্রাহ্য করছে তাদের অভিভাবকেরা বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে তাচ্ছিল্য করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের মতে, স্প্যানিশ বা ফেঞ্চ শিখলে তাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে উচ্চ বেতনে বড় চাকরি করতে পারবেন। এই আকাক্সক্ষা থেকেই তারা ভিনদেশী ভাষাকে স্কুলে সন্তানের পছন্দের তালিকায় রাখছেন। অথচ এর বিপরীত ঘটছে স্প্যানিশ ও চাইনিজ কমিউনিটিতে। এসব কমিউনিটিতে শতভাগ শিক্ষার্থী প্রথম তাদের নিজের ভাষা এবং পরে অন্য ভাষাকে বেছে নিচ্ছে।
এদিকে নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। নিউইয়র্ক সিটির পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে হাসপাতাল, স্কুল এবং বাস-ট্রেনে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন চোখে পড়ার মত। এমনকি দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে ভোটদানের সময় ব্যালট পেপারেও বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হয়েছে, যা বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য আনন্দের, পাশাপাশি বাংলাদেশের মর্যাদাকেও সুসংহত করছে।
কমেন্ট বক্স