ফেব্রুয়ারি মাস, ভাষার মাস। ভাষা আন্দোলনের মাস। কিন্তু আমরা কি ভাষা আন্দোলনের সকল ইতিহাস জানি? অনেক কিছুই রয়ে গেছে আমাদের অগোচরে। আসুন আজ জেনে নেই ভাষা আন্দোলনের একজন বীর ভাষা সৈনিকের অজানা কিছু কথা।
বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার উপর পাকিস্তানি পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল। সেই গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তৎকালীন এমএলএ খয়রাত হোসেন অ্যাসেম্বলি থেকে ওয়াকআউট ও পদত্যাগ করেন এবং পাকিস্তানি হায়েনা জান্তার হাতে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন।
১৯০৯ সালের ১৪ নভেম্বর, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন খয়রাত হোসেন। তাঁর বাবা জমিদার হাজী হেদায়েত উল্লাহ সরকার ছিলেন নীলফামারী জেলার প্রভাবশালী ও দানবীর মানুষ। নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়ন ও আশপাশের স্টেটগুলোর জমিদারী ছিল তাঁর অন্তর্ভুক্ত।

ছবিতে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডানে খয়রাত হোসেন
ছোটবেলা থেকেই খয়রাত হোসেন ছিলেন গণমানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ। এলাকার গরীব ও দুঃখী মানুষের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদতো। মা-বাবার অগোচরে তাদের পারিবারিক ধানের গোলা থেকে তিনি গরীব-দুঃখী মানুষের মাঝে ধান-চাল বিলিয়ে দিয়েছেন। গরীব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই মানুষটি যে দিনে দিনে এলাকার মানুষের মাথার মুকুট হয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা তাঁর বাবা হাজী হেদায়েত উল্লাহ সরকার বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন।
১৯২৯ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনাকালে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে খয়রাত হোসেন প্রথম মুসলিম ভিপি নির্বাচিত হন। ছাত্র অবস্থাতেই তাঁর ভেতরে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব দিন দিন প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। উপমহাদেশের সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে এক বিশাল আন্দোলনের চিন্তাভাবনা তাঁর মাঝে ঘোরপাক খেতে শুরু করে।
১৯৪৪ সালে খয়রাত হোসেন নীলফামারী থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। এসময় মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে আসামের বিখ্যাত ‘লাইন পোতা’ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং তারা একত্রে গ্রেফতার হন ও কারাবরণ করেন।
১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সেসময় আসামে মুসলিম উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন এবং খয়রাত হোসেন সেই আন্দোলনেও যোগ দেন। এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের ভিতরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার করে এবং খয়রাত হোসেন গ্রেফতার হন। আসাম জেলে দীর্ঘদিন কারাবরণের পর ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি মুক্তি পান।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা দেশের জন্ম হয়। ভৌগলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব, ভাষা ও সংস্কৃতি সবকিছুর ভেতরেই ছিল অনেক পার্থক্য। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিকভাবে দুই অঞ্চলের নেতাদের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
১৯৫০ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা থাকাকালে খয়রাত হোসেনের নির্দেশে নীলফামারি মহকুমায় দবির উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে খয়রাত হোসেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশন বর্জন করেন। তাঁর সাথে তখন একাত্মতা প্রকাশ করেন তৎকালীন নেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারিও খয়রাত হোসেন ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবুল কালাম শামসুদ্দিনের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের অধিবেশন বর্জন এবং অ্যাসেম্বলি থেকে ওয়াকআউট করেন। ভাষার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত গোটা দেশে ধর্মঘট পালনের নির্দেশ দেন এবং এমএলএ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানি শাসকচক্র তাকে গ্রফতার করে এবং দীর্ঘ ১৮ মাস কারাভোগের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম মন্ত্রী হন খয়রাত হোসেন। তিনি কৃষি, খাদ্য, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং একজন সফল মন্ত্রী হিসেবে সারা দেশে স্বীকৃতি পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করেন এবং নীলফামারীর তৎকালীন নেতা দবির উদ্দিন, আফসার আলী, রহমান চৌধুরীসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতারদের সহায়তায় ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করতে থাকেন। এ সময়ে তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
১৯৭২ সালের ১০ মার্চ ভাষা আন্দোলনের এই মহান নেতা নীলফামারিতে তাঁর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নিজ হাতের লেখা আত্মজীবনীতে খয়রাত হোসেনের রাজনৈতিক আদর্শের কথা মোট ১৩টি জায়গায় লিপিবদ্ধ আছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে মুসলিম লীগ, মুসলিম আওয়ামী লীগ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ভাষা সৈনিক, যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী, সর্বোপরি একজন জনদরদী নেতাকে রংপুরের মানুষ মনে রেখেছে। কিন্তু গোটা দেশের মানুষ বা নতুন প্রজন্ম তাকে চিনে না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোদ্ধা, মাওলানা ভাসানীর বন্ধু, শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠজন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে একই যুক্তফ্রন্টের কৃষিমন্ত্রী খয়রাত হোসেনের নাম ইতিহাসে তাই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
নীলফামারী এলাকায় প্রতিটি মানুষ এখনো শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করেন। নীলফামারী জেলায় তাঁর সম্মানে পৌর মার্কেটের নাম রাখা হয়েছে ‘খয়রাত হোসেন পৌর মার্কেট’। এছাড়াও নীলফামারীর উলটপারা ট্রেন স্টেশনের নামও পরবর্তীতে ‘খয়রাত নগর স্টেশন’ রাখা হয়েছে। নীলফামারী জেলার আপামর জনতা এখনো তার রাজনৈতিক জীবনের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি নীলফামারী জেলার সোনারায় ইউনিয়নের বেড়াকুঠি গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
লেখক : মিডিয়া কর্মী এবং খয়রাত হোসেনের নাতি।