২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ দেশের তালিকায় সর্বোচ্চ ৯৮ দশমিক ০৯ স্কোর নিয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই দেশের এক সাবওয়েতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে যে চিত্র চোখের সামনে ঝিলিক মেরে উঠল, তা ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’। সেই চিত্র দেখেই হৃদয়ের স্পন্দন শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নিজ ফোনে তাকে বন্দী করে রাখলাম। বর্তমানে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি চলছে। কিন্তু এই মাসে আমি নিজ মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা হতে অনেক দূরে। যে দেশে আমার বসবাস, তার আশপাশে নেই আমার মাতৃভাষার অস্তিত্ব, নেই তার প্রভাব, তা ভাবতেই কান্নায় দু’চোখে জল চলে আসে। আর এই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মনে পড়ে যায় অম্লান কিছু স্মৃতি। তখনই নিজ মনে বলতে থাকি :
‘কেন বাংলা তোমাকে
আমি ভুলতে পারি না,
কেন স্বাধীনভাবে
তোমাকে নিয়ে কথা বলতে পারি না,
কেন নিজ ভাষার মাধ্যমে
অন্যকে সহানুভূতি জানাতে পারি না,
কেন সুখে-দুঃখে তোমাকে ব্যবহার
করতে পারি না?’
একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই অতীতের কিছু স্মৃতি আমাকে কাঁদায়, মনকে নাড়া দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে যাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করেছি, অনুষ্ঠান করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি তার মাধুর্য, মনের মধ্যে বুনে রেখেছি কিছু অম্লান স্মৃতি; আজ সেই অমর মাতৃভাষা দিবস, শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এটি বাঙালি জাতির জীবনে একাধারে মর্মান্তিক ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন ১৩৫৯) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে বেশ কিছু তরুণ যুবক শহীদ হন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীন হওয়ার পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা যায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। ছাত্ররা পাঁচ-সাতজন করে ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে তাদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং গুলি চালায়।
এতে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন এবং আরো অনেকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকত নিহত হন। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। আন্দোলনের মুখে সরকারের মনোভাব কিছুটা নমনীয় হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে ফরিদপুরের আদেল উদ্দিন আহমদের (১৯১৩-১৯৮১) দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবেই ১৯৫২ সালের পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালিদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে আজও দিনটিকে পালন করা হচ্ছে। সেদিন বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে যে মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে এই দিনটি।
এই দিবসের মর্যাদা উপলব্ধি করতেই গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। মানুষ যত বেশিসংখ্যক ভাষা শিক্ষা অর্জন করুক না কেন, মাতৃভাষাই হলো তার চিন্তাজগতের ভাষা। এ কারণে ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে নিজেকে সুন্দর, সহজ ও ভাবগম্ভীর করে তোলা যায় না। তাই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজিতে কাব্য রচনা করেও আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। আজ নিজের লেখার মাধ্যমে পুরোনো অতীতের ‘অমর একুশ’কে স্মরণ করে নিজের মনের আবেগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজে যেমন আত্মতৃপ্তি লাভ করতে আগ্রহী, তেমনি প্রবাসীদের আত্মতৃপ্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি মাত্র। এই বিদেশে এসে আমার কেবলই বলতে ইচ্ছা হয়, দেশ তোমাকে ভালোবাসি, তার চেয়েও অধিক ভালোবাসি আমারই মাতৃভাষাকে, যাকে কেন্দ্র করে মনের অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করার স্বাদ পাই। আজ সেই একুশ, তার জন্মদিন। তাই তার জন্মদিনে হাজারো শুভেচ্ছা, আর যারা প্রাণ দিয়ে এই ভাষাকে অম্লান করে রেখে গিয়েছেন, তাদের প্রতি রইল হাজারো সালাম।
লেখক : শিক্ষক।