Thikana News
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

একজন শেখ হাসিনা এবং মার্কিন ফ্যাক্টর

একজন শেখ হাসিনা এবং মার্কিন ফ্যাক্টর
বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় গর্ব বা সমস্যা একজন ব্যক্তির ওপর এসে বর্তেছে, আর তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দল আওয়ামী লীগের কাছে তিনি জাতীয় গর্ব, ঐক্যের প্রতীক, উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশে উন্নয়ন ও রোলমডেলের একমাত্র রূপকার, বাংলাদেশে তার নেতৃত্বের আর কোনো বিকল্প নেই এবং তাদের একমাত্র দাবি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই পরবর্তী নির্বাচন করতে হবে। পক্ষান্তরে বিরোধীরা তাকে গুম, খুন, ভোট ডাকাতি, দুর্নীতির প্রশ্রয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করা একজন স্বৈরাচারী বলে মনে করে এবং তাদেরও এক দফা দাবি শেখ হাসিনার পদত্যাগ। গত ১২ জুলাই আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিশাল সমাবেশ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে উপস্থিত রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই বিতর্কিত পদে অর্থাৎ এক দফার কেন্দ্রবিন্দুতে বসিয়ে দিয়েছে। 

আবার বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার অথবা ভূরাজনীতি, যেকোনো কারণেই হোক পৃথিবীর একমাত্র সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন সব ডিপ্লম্যাটিক টুলস নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যাতে মনে হয় বর্তমান সরকারের পরিবর্তনই তাদের লক্ষ্য। যদিও তারা সরকার পরিবর্তনের কথা অস্বীকার করে বলছে, তারা শুধু পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। 

মার্কিনিদের এই ভূমিকা বেশ জনসমর্থনও পেয়েছে। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীও বলছেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কিন্তু বিগত দুটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের কারণে তার এই প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম। দৃশ্যত, আমেরিকা ও প্রধানমন্ত্রী এক অলিখিত স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত, যার শেষ দৃশ্য বলা মুশকিল। তবে প্রাথমিক বিশ্লেষণে বোঝা যায়, আমেরিকানরা অর্থ, সামর্থ্য, বিভিন্ন টুলস এবং জনসমর্থন নিয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্বল তার দলের বিশাল কর্মী বাহিনী, অনুগত পুলিশ বাহিনী এবং আমলা সকল। তার এই টুলস দিয়ে সমষ্টিগত বিরোধী দল, দ্রুত পতনশীল অর্থনীতি এবং আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। গত ১৫ বছরে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে তিনি ব্যাপক হারে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। তার বর্তমান অবস্থাটা এক বছর আগে তারই একজন ঘোর সমর্থক, একুশের কিংবদন্তি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মৃত্যুর কিছুদিন আগে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং তাকে উদ্দেশ করে যুগান্তর পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারি সাবধান সাবধান।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সাবধান হননি।

প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য ও সমস্যা
২০০৮ সালে প্রকৃত জনগণের ভোটেই তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তার পর থেকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃষি খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি, রফতানি সহায়ক পলিসি, নারীর ক্ষমতায়ন, মৃত্যুহার কমিয়ে আনা, গরিবদের গৃহায়ণ, অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন, ব্যক্তিগত খাতকে ব্যাপক উৎসাহিত করার মতো অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।
অন্যদিকে তিনি ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে নির্বাচনগুলোতে অনিয়ম, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা সংকোচন, দুর্নীতিকে প্রশ্রয়, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসনসহ সরকারি সব সংস্থাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এই কর্তৃত্বপরায়ণতা এতটাই ভয়ংকর ছিল, তার দল আওয়ামী লীগ বাদে সকল রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামলেও কিছুই করার ক্ষমতা কারও ছিল না। কিন্তু তার ছন্দপতন ঘটিয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং ভূরাজনৈতিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে।

মার্কিন ফ্যাক্টর
২০০৭ সালে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে, মতি/মাহফুজের মিডিয়া ব্যবহার করে, ১/১১ ঘটিয়ে ভারতবিরোধী বিএনপি ও জামায়াতকে একটি চরম শিক্ষা দেয়। যুদ্ধবাজ জর্জ বুশ সেই অভিযান শেষ করে বাংলাদেশের দেখভাল ভারতের হাতে ছেড়ে দেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ওবামা-বাইডেন ক্ষমতায় এসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বুশ যেভাবে মুসলিমবিরোধী মনোভাব জাগ্রত করেছিলেন, তা প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এসেছিলেন কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তেমন কোনো নজর দেননি। তবে ২০১৪ সালে ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল আরও ইনক্লুসিভ নির্বাচন। সে লক্ষ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা কয়েকবার ঢাকা-দিল্লি দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। কিন্তু ঢাকার প্রবল আপত্তিতে দিল্লিও কোনো সাড়া দেয়নি, বরং তারা তাদের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে পাঠিয়ে শেখ হাসিনার ক্ষমতা থাকার নিশ্চয়তা বিধান করে যায়। মার্কিন দূতের ওই প্রচেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর দল খুব অকূটনৈতিকভাবে তাচ্ছিল্য করেছে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ড্যান মজিনাকে কাজের বুয়া/ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইত্যাদি বলে অপমান করেছেন। এই ডিপ্লম্যাটিক স্নাবটি ওয়াশিংটন সহজেই ভুলে যাবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এরপর ট্রাম্প এসে তার ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির কারণে বাংলাদেশ কখনো আলোচনায় আসেনি। বাইডেন ক্ষমতায় এসে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তার পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকার দিলে আবার বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ওদিকে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, সামরিক, শিল্প ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বিধায় ওবামা প্রশাসনের শেষ দিকে চীনকে আর বাড়তে না দেওয়ার একটা নীতি গ্রহণ করা হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের পুরো সময়টাতেই চীনের সঙ্গে কথার মারামারি, ট্যারিফ যুদ্ধ এবং করোনাভাইরাস নিয়ে হুয়ান ল্যাবরেটরির প্রপাগান্ডা বিদ্যমান ছিল। চীন তার দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করাতে আমেরিকা ও তার মিত্র জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলে চীন বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, যাদের সাগর ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। তাই কৌশলগতভাবে পিছিয়ে পড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই চীনের বলয়ে না যায়, সে প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রয়াস চালায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মেগা প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য ইতিমধ্যেই চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ফেলেন। এটা ভারতের ব্যর্থতা বিবেচনায় নিয়ে ২০২১ সালের ২০ আগস্ট ক্রিস্টিনা সেশন নামের মধ্য পর্যায়ের পররাষ্ট্র দফতরের একজন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, এখন থেকে আমেরিকা বাংলাদেশকে আর ভারতের দৃষ্টি দিয়ে দেখবে না, তারা নিজেরাই মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবকিছু দেখভাল করবে, যা পরদিন ইংরেজি দৈনিক স্টারে প্রকাশিত হয়। আমেরিকার এই পরিবর্তন বার্তাকে শেখ হাসিনা কোনো গুরুত্ব দিয়েছেন বা কোনো নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন, সে রকম কোনো লক্ষণ ছিল না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু অকূটনৈতিকসুলভ ঘটনাও ঘটে।

অকূটনৈতিক আচরণ
২০১৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকটের গাড়িতে ছাত্রলীগের হামলা, এ বছর বর্তমান দূত পিটার হাস ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি ভুক্তভোগী সংগঠনের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময় সরকারি মদদে গড়ে ওঠা মায়ের কান্না নামের সংগঠনের কর্মীদের দ্বারা বাধাদান, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল লাউবাচারের ঢাকা সফরের সময় সেগুনবাগিচায় অজয় দাশগুপ্তের নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন করানো এবং কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই মার্কিন ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা প্রত্যাহার ইত্যাদি। উপরিউক্ত ঘটনাগুলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমতি ছাড়া ঘটা সম্ভব ছিল না। আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ২০২১ সালে র‌্যাব ও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর সরকার সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না দিয়ে উল্টো তাদের পুরস্কৃত করায় মার্কিন প্রশাসন তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে।

ডিপ্লম্যাটিক চাপ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চ্যালেঞ্জ দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তারা অতি অল্প সময়ে অন্তত ডজনখানেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে প্রেরণ করে, যা গত ৫০ বছরে ঘটেনি। যারা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন কোনো সরকার পরিবর্তনে তাদের চষধহ অ, ই, ঈ থাকে এবং যতটুকু সম্ভব তার মিত্রদেশগুলোকে ওই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ানের দেশগুলো, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া হয়তো যুক্ত হয়েছে। এরপর ডিপ্লম্যাসির পাশাপাশি চলে মিডিয়া ও মনস্তাত্ত্বিক ক্যাম্পেইন। ওই যে ১২ জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠি, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্যের চিঠি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতি, জাতিসংঘের শান্তি মিশনের ডেপুটির বাংলাদেশ সফর এবং আফ্রিকা থেকে ১৫০০ বাংলাদেশি সৈন্যের ফেরত আসাÑসবকিছুই মনস্তাত্ত্বিক ক্যাম্পেইনের অংশ। এর মূল টার্গেট বাংলাদেশের সবচেয়ে পাওয়ারফুল অংশকে নিউট্রালাইজ করা, যাতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জে. আজিজের মতো ভূমিকা কেউ পালন না করে। তারপর ভিসানীতি দিয়ে আমলা, বিচারক, নিরাপত্তা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন, অর্থাৎ সব কারিগরের দিকে বুলেট তাক করিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাদের ভিসানীতি যে কোনো কথার কথা নয়, তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই জনসমক্ষে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. আকতারউজ্জামানকে এক মাস অপেক্ষা করিয়েও কানাডার ভিসা দেওয়া হয়নি, অথচ পদাধিকারবলে তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্টধারী এবং তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা পাওয়ার কথা। আর কানাডা ভিসার ক্ষেত্রে সব সময় আমেরিকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের অত্যন্ত ভালো এক সুহৃদ ভারত। বর্তমান সময়ে ভারতের মৌনতা প্রধানমন্ত্রীর জন্য মোটেই ভালো সংবাদ নয়। প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভারতকে খুশি রাখলেও তার দুঃসময়ে ভারতের কিছু করার নেই। কারণ আমেরিকা তো সরাসরি বলছে না যে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বা নিরপেক্ষ নির্বাচনে জিতলে তাকে ক্ষমতায় রাখা হবে না। তারা বলছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে; গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। ভারত দুটি কারণে এই সময় মৌনতা অবলম্বন করছে, (১) আমেরিকার সরকার পরিবর্তনের দৃঢ়সংকল্পতা। বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার চাইতে আমেরিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তারা বাংলাদেশে বছরে তিন বিলিয়ন রফতানি করে আর ১৫৭ বিলিয়ন আমেরিকাতে। ব্যবসা ছাড়াও টেকনোলজি বিনিময় ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বিষয়ে পরোক্ষ সহায়তার পুরস্কার হিসেবে মোদি সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরের সময় অনেক কিছুই পেয়েছেন। (২) প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা। ভারত ২০০৮ সালে মঈনুদ্দিনকে দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে, ২০১৪ সালে সচিব সুজাতা সিংকে পাঠিয়ে আরও এক টার্ম ক্ষমতায় রাখার নিশ্চয়তা এবং ২০১৮ সালে রাতের নির্বাচনকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় রেখেছেÑএই ধারণাটা বাংলাদেশের মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ নিয়ে তারা জরিপ করেছে, যা সাংবাদিক সুবির ভৌমিক তার এক কলামে ফাঁস করে দিয়েছেন। আবার ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে ৮০ শতাংশ বাংলাদেশি মানুষ পাকিস্তানকে সমর্থন করে, সেটা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি এড়ায় না। সুতরাং চীন-পাকিস্তান চিরশত্রু প্রতিবেশীর পাশাপাশি পূর্বাঞ্চলে শুধু একটি সরকারের সমর্থনের কারণে সমগ্র জনগোষ্ঠী ভারতবিরোধী হোক, সেটা তারা চাইবে না। সে রকম ইঙ্গিতই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর কদিন আগে দিয়েছেন যে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর সব দলের সঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা রাখেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথাটা গোপনে বা ডিপ্লম্যাটিক চ্যানেলে দিতে পারতেন কিন্তু প্রকাশ্যে বলার তাৎপর্য হলো উভয় দিকে পৌঁছানো।

অর্থনৈতিক চাপ
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপের পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাপও থাকবে, যা ডোনাল্ড লু এর আগেরবার বলে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ রফতানি আয় হয় পশ্চিমা দেশগুলো থেকে, যার পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়াতে বাংলাদেশ চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থানে রয়েছে। যদি তারা কোনো শুল্ক বসিয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ ওই প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না এবং পোশাকশিল্প খাতে ধস নেমে আসবে। আবার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী রেমিট্যান্সের বড় একটা অংশ আসে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে। সরকারি প্রচারযন্ত্র বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ, যেমন ড. সালেহউদ্দিন, ড. তিতুমীর আল রাশেদ, ড. আ. মান্নান বা ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের ভাষ্যমতে, দেশের অর্থনীতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গত ৭/২৩/২৩ তারিখে দৈনিক মানবজমিনে দেশের অর্থনীতির এক করুণ চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। গত সপ্তাহে ডয়েচে ভেলের খালেদ মহিউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামছুল আলম স্বীকার করেছেন, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে দেশের বিশেষ ক্ষতি হবে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আমেরিকা ফ্যাক্টর
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে স্বস্তিতে আছেন, সেটা বলা যাবে না। গত ১০ বছরে একটা ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বিরোধীরা রাস্তায় নামার সাহস করেনি, এটা সত্য। কিন্তু আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় সে ভয়ের সংস্কৃতি কেটে যায়, যদিও বিরোধীরা রাস্তায় রক্তপাত এড়ানোর জন্য বা সরকারকে আরও সময় দেওয়ার জন্য ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছে। বড় বিরোধী দল বিএনপি ইতিমধ্যেই তাদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো এবং অন্যান্য ছোট ছোট দল যদি একসঙ্গে রাস্তায় নামে, তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাঠ দখলে রাখা কঠিন হবে। তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সরকার ও বিরোধীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পার্টির নেতা জি এম কাদের এখন যেভাবে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৪ সালে যেভাবে সুজাতা সিংকে এনে, এরশাদকে সিএমএইচে পাঠিয়ে, রওশন এরশাদ কার্ড খেলিয়ে বিনা ভোটে নির্বাচন করিয়ে নিতে পেরেছিলেন, এবার সেটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ (১) আমেরিকা দৃঢ়সংকল্প, (২) জি এম কাদেরের নামে কোনো মামলা নেই, (৩) রওশন এরশাদ প্রায় অকেজো এবং (৪) ডিজিএফআই/ডিবির যেসব কর্মকর্তা এসব কেনাবেচা করত, তাদের প্রতি ভিসানীতির বুলেট তাক করিয়ে রাখা হয়েছে। সুতরাং জাতীয় পার্টি তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আমেরিকা ফ্যাক্টরে বিরোধী দলগুলো দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠে নামলে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাঠ নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হবে। আর মাঠে যদি ব্যাপক রক্তপাত ঘটে, তাহলে হয়তো তৃতীয় কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে, যা আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর হবে না।

প্রধানমন্ত্রী কী করতে পারেন
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কী করতে পারেন? তার কাছে দুটি পথ খোলা রয়েছে। তিনি বিরোধী ও পাশ্চাত্যের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের আলোকে বা কিছু পরিবর্তন এনে তার প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার প্রস্তাব দিতে পারেন। অবশ্যই সে আলোচনায় তার ক্ষমতা হস্তান্তরের পর কোনো প্রকার ভায়োলেন্স না হওয়ার নিশ্চয়তা রাখবেন। দ্বিতীয়ত, সকলকে উপেক্ষা করে ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন। তবে এবার ২০১৪ সালের মতো ডিজিএফআই দিয়ে কেনাবেচার ব্যবসা সুবিধা হবে না। আর সে ক্ষমতা কত দিন ধরে রাখতে পারবেন, সেটাও বিবেচ্য। কারণ পরাশক্তি আমেরিকা পরাজয় নিয়ে চুপ করে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আরও একটি খবরের প্রতি দৃষ্টি দিলে প্রধানমন্ত্রী ভালো করবেন। গত ৭/১৯/২৩ তারিখে আমেরিকা সাউথ আমেরিকার চারটি দেশের ৪৩ জন ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং সেখানে সালভেদরের দুজন সাবেক প্রেসিডেন্টের নামও রয়েছে, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এ খবরটি ৭/২০/২৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো ছেপেছে।

ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট কম পাওয়ায় জনৈক বি. জেনারেল মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে কারা কারা ভোট দিয়েছিল তার তালিকা করতে। বিষয়টি কি প্রধানমন্ত্রী জানেন? ভোট দেওয়া ব্যক্তিগত পছন্দ এবং এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা হতে পারে না। এটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে।

লেখক : কলামিস্ট।
কমেন্ট বক্স



9