নিউইয়র্কে ব্যস্ত সময় পার করলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ; বিভিন্ন দেশের বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে বৈঠক; রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে অংশগ্রহণ; প্রবাসীদের সঙ্গে সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার নিউইয়র্ক সফর অত্যন্ত সফল ও বাংলাদেশের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্বনেতাদের পূর্ণ সমর্থন
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ডজনখানেক বিশ্বনেতা। ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার হোটেল স্যুইটে সাক্ষাৎ করতে বিশ্বনেতারা আসেন। এ সময় তারা প্রধান উপদেষ্টা এবং তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিজেদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সময় বাংলাদেশকে তাদের দক্ষতা ও সহায়তা প্রদানের জন্য তারা নিজেদের আগ্রহের কথা জানান।
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা : ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা জাতিসংঘকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এর পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা সমস্যা, যুদ্ধ-সংঘাতসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। তরুণদের জন্য কীভাবে নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলা যায়, সেই আকাক্সক্ষা এবং পথ নিয়েও কথা বলেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে ৭ দফা প্রস্তাব
৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ‘হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য সিচুয়েশন অব দ্য রোহিঙ্গা মুসলিমস অ্যান্ড আদার মাইনরিটিজ ইন মিয়ানমার’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই নিহিত, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেশটির সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সাতটি পদক্ষেপ প্রস্তাব করেন :
১. রাখাইন রাজ্যে যুক্তিসংগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন।
২. মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করে সহিংসতা বন্ধ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসন শুরু, বিশেষত যারা সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং যারা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত।
৩. রাখাইনকে স্থিতিশীল করতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সেখানে আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
৪. রোহিঙ্গাদের রাখাইন সমাজে দীর্ঘমেয়াদি সংযুক্তি ও শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণে আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ।
৫. যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা (ঔড়রহঃ জবংঢ়ড়হংব চষধহ) সম্পূর্ণ অর্থায়নে দাতাদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা।
৬. দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ।
৭. মাদক অর্থনীতি ভেঙে ফেলা ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন।
এলডিসি উত্তরণে বাংলাদেশের প্রস্তুতি মূল্যায়নে সহায়তা দেবে জাতিসংঘ
বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি নিয়ে স্বাধীন মূল্যায়ন পরিচালনায় সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘে স্বল্পোন্নত দেশ, স্থলবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ ও ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ফাতিমা ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে এ ঘোষণা দেন।
মার্কিন কোম্পানিকে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ এক্সিকিউটিভ বিজনেস গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। ‘অ্যাডভান্সিং রিফর্ম, রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড গ্রোথ’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল (ইউএসবিবিসি)। প্রধান উপদেষ্টা অনুষ্ঠানে মেটলাইফ, শেভরন এবং এক্সেলেরেটসহ শীর্ষ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।
এমন নির্বাচন করতে চাই, যা বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বড় প্রচারাভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা চাই ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হোক মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক-যেমনটা বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি। এবার আমরা ভোটারদের, বিশেষত নারীদের স্বাগত জানাতে চাই। ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে একটি বড় প্রচারাভিযান চালানো হবে। ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে মানবাধিকার কর্মীদের এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কার বাস্তবায়ন
আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতর কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত নৈশভোজে শ্রম আইন, শ্রমিক অধিকার এবং দেশে চলমান সংস্কার প্রচেষ্টার ওপর একটি উচ্চপর্যায়ের সংলাপে তিনি এ কথা বলেন।
যুবশক্তিকে অন্তর্ভুক্ত না করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়
২৫ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্কে ‘যুবদের জন্য বিশ্ব কর্মসূচি’র ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে আয়োজিত এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন। সেখানে তিনি যুবসমাজের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং বলেন, যুবশক্তিকে অন্তর্ভুক্ত না করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের বৈঠক
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। নিউইয়ের্ক ২৯ সেপ্টেম্বর তাদের মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে তারা রাখাইন রাজ্যে অবনতিশীল মানবিক পরিস্থিতি, কক্সবাজারে এক মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়া এবং রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন স্ন্যাপচ্যাটের সাবেক সিএসও ইমরান খান
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিনিয়োগকারী ও স্ন্যাপচ্যাটের সাবেক প্রধান কৌশলগত কর্মকর্তা (সিএসও) ইমরান খান। এ সময় তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে সাক্ষাৎকালে ড. ইউনূস দেশের ক্রমবর্ধমান ফিনটেক, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক ব্যবসা খাতে বিনিয়োগ করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান।
আ.লীগের স্থগিতাদেশ স্থায়ী নয়, যেকোনো সময় প্রত্যাহার হতে পারে
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে স্বাধীন মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম জেটিও-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আওয়ামী লীগের স্থগিতাদেশ স্থায়ী নয়, যেকোনো সময় প্রত্যাহার হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। দলটি বৈধ রয়েছে। যা স্থগিত করা হয়েছে, তা হলো এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য বিঘ্নকারী হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। তারা মনে করছে, আপাতত তাদেরকে (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না দেওয়াই ভালো। তবে স্থগিতাদেশ স্থায়ী নয়, যেকোনো সময় তা প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
ঠিকানা/এসআর