২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে জোট। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারে স্থান পায় জামায়াত। মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হন, যা নিয়ে বিএনপি প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে। ওয়ান-ইলেভেনের আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই ছিল বহাল। এর পর থেকে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বেগম খালেদা জিয়া মিথ্যা মামলায় কারাগারে যান। জামায়াত নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা খেলায় দুই দলের ঐক্যে ফাটল ধরে। অনেকটা প্রকাশ্যেই একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন। এর সুযোগ নেয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার।
শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই একসময়ের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির প্রধান নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হতে জামায়াত ভোটের মাঠে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। দল দুটির নেতারা পরস্পরের কড়া সমালোচনা করছেন। প্রায় সব ইস্যুতে দল দুটির অবস্থান বিপরীতমুখী। শুধু কথার লড়াই আর বাহাস নয়, দল দুটির নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে সংঘাতেও জড়িয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারাও জামায়াতকে ব্যাংক দখলকারী, মোনাফেক বলে আখ্যা দেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াত নেতারা বিএনপির নেতাকর্মীকে চাঁদাবাজ, দখলদার আখ্যা দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
লন্ডনে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক নিয়ে জনমনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে, যা এখন রাজনীতির আলোচিত ইস্যু। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে হঠাৎ জামায়াতের অবস্থান বদল ও বিএনপির দাবির কাছাকাছি আনা-এ বৈঠকের ফল কি না তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। তবে লন্ডনের বৈঠকে দুই দলের সম্পর্কে যে বরফ গলছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে জামায়াত নেতাদের বক্তব্য থেকেই। কিন্তু সেই সম্পর্ক সামনের দিনে কোনো নির্বাচনী ‘সমঝোতা’ বা ফের ‘জোট’ গঠনের দিকে যাবে কি না, তা নিয়েও নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা এখনো অজানা। লন্ডনে বা ঢাকায় কোনো দলের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলা হয়নি। এ কারণেই হয়তো বিস্তর কৌতূহল। তবে দুই দলের মধ্যে যে দূরত্ব বেড়েছিল, তার কিছুটা হলেও অবসান হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে এক কক্ষে বসাটাকেও ইতিবাচক বলে মনে করছেন। কারণ দুই দলের মধ্যে উদ্বেগ ছিল, ছিল বেদনা। একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছিল।
জানা গেছে, অসুস্থ বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতেই জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় যান। ডা. শফিকুর রহমান ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমন্ত্রণে ব্রাসেলস গিয়েছিলেন। ইউরোপীয় নেতাদের কাছে তারা তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। জামায়াত কী চায় তাও স্পষ্ট করেছেন। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত এই বৈঠককে তারা অত্যন্ত সফল বলে বর্ণনা করছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হবেÑএ নিয়ে কোনো জল্পনা ছিল না। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই ডা. শফিকুর রহমান সেখানে হাজির হন। দুই দলের শুভাকাক্সক্ষীরা এই বৈঠকের ব্যাপারে নানাভাবে তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এর আগে অবশ্য ফোনালাপ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। তারেক রহমান নিজেই জামায়াতের আমিরকে স্বাগত জানান, যা ছিল অত্যন্ত আন্তরিকতায় ভরা। নিজ হাতে তিনি তাদের আপ্যায়িত করেন তার বাসভবনে। আলোচনার শুরুটা ছিল আবেগময়। অসুস্থ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কেমন, কীভাবে তার দিন কাটছে তা জানার চেষ্টা করেন ডা. শফিকুর রহমান। কবে দেশে ফিরবেন তাও জানতে চান ডা. শফিক। এরপর ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। কবে নির্বাচন হতে পারে তা নিয়ে বেশ কিছু সময় আলোচনা হয়। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে দুই দলের অবস্থান কাছাকাছি নয়, বিপরীতমুখী। দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমাতে কিছু করণীয় নিয়েও কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে। আরও ধৈর্য, আরও সংযমের ওপর জোর দেন নেতারা। ঢাকায় একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভবিষ্যতে দুই দলের সম্পর্কে ফাটল ধরে এমন কোনো কাজকে প্রশ্রয় দেবেন না কেউইÑসে বিষয়েও তারা এক অলিখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে মিল ছিল না জামায়াতের অবস্থান। তবে নির্বাচন ইস্যুতে দুই দলের অবস্থান এখন কাছাকাছি চলে আসার বিষয়টি হওয়া লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠকের ফল হতে পারে। ওই বৈঠক যদি ফলপ্রসূ হয় আগামী দিনে আরও কিছু তৎপরতা দেখা যেতে পারে, যা দুই দলকে আরও কাছাকাছি এনে দেবে। এতে করে সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন রাজনৈতিক দলের চাওয়া অনুযায়ী হবে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।