Thikana News
১৪ মার্চ ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

শেষ পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থান কি ব্যর্থ হবে?

শেষ পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থান কি ব্যর্থ হবে?
এ দেশের মানুষ গণমিছিল করেছে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ দেশের মানুষ লগি-বৈঠার মিছিল, মানুষ হত্যা দেখেছে। কিন্তু এবার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতনের ছয় মাসের মাথায় বুলডোজার মিছিল দেখল মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংগঠন এবং ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’ নামে সংগঠনের নেতৃত্ব ঘোষণা করা হলো, ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে। যেই কথা, সেই কাজ। বুলডোজার নিয়ে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন এবং খুলনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের ৩৫টি জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি, শেখ মুজিবের মূর্তি, ম্যুরালকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোষণা দিয়ে বুলডোজারের সাহায্যে প্রতিপক্ষের স্থাপনা মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশে প্রথম হলো। দেশে দু-তিনবার গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে-যেমন একাত্তরের স্বাধীনতা, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এমনকি ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর তিন দিন কোনো সরকার ছিল না। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষুব্ধ জনতা কোথাও আগুন অথবা ভাঙচুরের ঘটনা ছাড়া কিছু হয়নি। কিন্তু দেশে একটা সরকার থাকা অবস্থায় ঘোষণা দিয়ে বুলডোজার দ্বারা ধ্বংসের ঘটনা কখনো হয়নি।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে বিরাজমান। দেশে পুলিশ, র‌্যাব, আর্মি সর্বত্র পাহারা দিচ্ছে সকলের নাকের ডগায়-এ ধরনের ঘটনায় সমগ্র জাতি উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। পার্শ্ববর্তী দেশের প্রপাগান্ডা আমাদের বিরুদ্ধে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে যখন এ ব্যাপারে কোনো দেশ বা মানবাধিকার সংগঠন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রশ্ন করবে, তখন তিনি কী জবাব দেবেন? ঘটনার দুই দিন পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারতে বসে তাদের প্রশ্রয়ে শেখ হাসিনা দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে একটার পর একটা দেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার এই বক্তব্য আমাদের দেশকে অস্থিতিশীল ও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ১৬ বছরের হত্যা, গুম, খুন, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্নীতি, অর্থপাচার অথবা জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, আহত হলো, কোনো ব্যাপারে একটু অনুশোচনা নেই। আছে দাম্ভিকতা, ১৬ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি। কিন্তু ওনার বোঝা উচিত, মানুষ এই বক্তব্য মানতে পারেনি বিধায় পুলিশ বাহিনীর গুলির সামনে বুক চিতিয়ে প্রাণ দিয়ে গণ-অভ্যুত্থান করেছে এবং উনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই বাস্তবতা ওনাকে মেনে নিতে হবে। আগের মতো দিবাস্বপ্ন দেখলে কাজ হবে না। তিনি মানুষের এই আন্দোলন ও সংগ্রামকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বলছেন। প্রতিটা বক্তব্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। ক্ষমতায় থাকতে যেভাবে সব সময় বিএনপি, জামায়াতের বিরুদ্ধে করতেন। যা শুনে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার রক্তে আঘাত লাগে। কোনো অবস্থায় মেনে নিতে পারেন না।’
এই সব কথাই সত্য। কিন্তু আইন আপনারা নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। কোনো দল, গোষ্ঠী রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার বাইরে ইচ্ছামতো যেকোনো কিছু করতে পারে না। আধুনিক সভ্য জগতের সঙ্গে তা মানায় না। যদি হয় তবে ধরে নিতে হবে, সরকার বা রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা আছে। আর যদি এই প্রশ্ন দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দীর্ঘ স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, রক্তক্ষয়, গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছি। পতিত স্বৈরাচারের উচ্ছৃঙ্খল বক্তব্যের ফাঁদে পা দিয়ে হাজারো শহীদের রক্তস্নাত আন্দোলনের আকাক্সক্ষাকে ব্যর্থ করে দেব, নাকি আন্দোলনকারী সকল শক্তির ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে গণ-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করব? জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে এটাই এই মুহূর্তের চিন্তার বিষয়।
৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংসের পর শেখ হাসিনা এখন ভিন্ন সুরে মানুষের মন জয় ও কর্মীদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি এখন কান্নাভরা কণ্ঠে বলছেন, ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস, আমাদের গর্ব। ছয় দফা, স্বাধীনতার ঘোষণা, কত বিদেশিরা এই বাড়িতে এসেছেন, আমাদের ভাইবোনদের বড় হওয়ার স্মৃতি, আমার মা-বাবা ও ভাইদের রক্তের চিহ্নসহ হাজারো স্মৃতিবিজড়িত ছিল। তাই আমরা এই বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়েছিলাম। কিন্তু তাও শেষ করে দিল। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব? ১৯৮১ সালে তিনি দলের সভাপতি হয়ে দেশে ফিরলে মা-বাবা ও ভাই শিশু রাসেলের হত্যার বিচারের কথা বলে তার এ ধরনের আবেগঘন বক্তৃতা শুনেছিল আবেগপ্রবণ বাঙালি। মানুষ বিশ্বাস করেছিল। নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় থেকে বিচারও করেছেন। কিন্তু জাতি কী পেয়েছে, বাকিটা ইতিহাস!
শুধু একটা কথা উল্লেখযোগ্য, ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর, সেদিন একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে তার বাড়ির বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও নিজের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক হিংসার কারণে ঘরের তালা ভেঙে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই দিন সরকারের তরফ থেকে মিথ্যা, বানোয়াট বিবৃতি দিয়ে বলা হলো, খালেদা জিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ক্রন্দন করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন, আমি কার কাছে বিচার চাইব? সেই বাড়িটিও তার কাছে স্বামী এবং তার সন্তানদের কাছে বহু স্মৃতিবিজড়িত ছিল। চোখের সামনে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দিয়ে ইমারত প্রস্তুত করা হলো।
সেই কথাগুলোও শেখ হাসিনা নিজের মুখে দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেছিলেন। কথায় বলে, অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে একদিন নিজেকেই পড়তে হয়। আর আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও বলা আছে, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।
বিপদে মানুষ কোনো সময় বুদ্ধিহারা হয়ে যায়। আশা করি, বঙ্গবন্ধুর কন্যার বাস্তব রাজনীতির কথা চিন্তা করেই কথা বলা উচিত। বহু ত্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন এবং বিরোধী দলসহ সবাইকে প্রতিশোধ ও হিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নৈর্ব্যক্তিকভাবে দ্রুততার সঙ্গে শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে চলা জরুরি। সবচেয়ে চেয়ে বেশি দরকার মাঠের সংগ্রামী শক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার দ্রুত প্রতিযোগিতা না করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশটা গড়ে তোলা। সামনের ঘন অন্ধকার বেরিয়ে আলো আসুক-সেই প্রত্যাশা।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক
 
কমেন্ট বক্স