Thikana News
১৪ মার্চ ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

মহিমান্বিত লাইলাতুল বরাত বা নিসফে মিন শাবানে আমাদের প্রার্থনা

মহিমান্বিত লাইলাতুল বরাত বা নিসফে মিন শাবানে আমাদের প্রার্থনা
বিশ্ব মুসলিমের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর বিশেষ আশীর্বাদ ও রহমত হিসেবে পবিত্র লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্যরজনী তথা নিসফে মিন শাবান (শাবানের মধ্যভাগের রজনী) বছর ঘুরে আবারও এসেছে। বিশ্বের সকল প্রান্তের মুসলিম জনতার মতো নিউইয়র্ক প্রবাসী মুসলমানরাও আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পবিত্র লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান উদযাপন করবেন বলে জানা গেছে। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের পরিচালিত মসজিদগুলোও ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই মহিমান্বিত রজনী উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে ব্যক্তিগত অহমিকাবোধ ও পাণ্ডিত্য জাহিরের দুর্দমনীয় মোহ বশে লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান বা লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্যরজনী উদযাপন নিয়েও মুসলিম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য এবং বিভক্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে। আধিপত্য বিস্তার কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের বাতিকগ্রস্ত ও কলহপ্রবণ ওলামারা প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্যে কাফের ফতোয়া দিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। তাই বর্তমানের চরম ফেতনার যুগে মসনদের মোহাবিষ্ট মুসলিম রাজা-বাদশাহদের অনুকরণে ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপনকে কেন্দ্র করে বহুধাবিভক্ত আলেম-ওলামারা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামকে কলঙ্কিত করলে আফসোসের অন্ত থাকবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা পবিত্র লাইলাতুল বরাত উপলক্ষে মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা এবং ধর্মীয় বিভক্তির অবসান কামনা করছি। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুসারে, শাবানের মধ্যভাগের রাত বা নিসফে মিন শাবান হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের পাপরাশি মার্জনার জন্য মহান আল্লাহপ্রদত্ত পাঁচটি বিশেষ দিবস ও রজনীর অন্যতম। বিশ্ব মুসলিমের জীবনে পবিত্র লাইলাতুল বরাত বা নিসফে মিন শাবান বিশ্ব প্রতিপালকের অপরিসীম রহমত।
এই মহিমান্বিত রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা মাগরিবের পর থেকে ফজর পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টিজীবের প্রতি অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করেন। তাই কোনো মুসলমান অকপট চিত্তে ও অশ্রুসিক্ত নয়নে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে (বান্দার হক আত্মসাৎকারী এবং আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারকারী ছাড়া) রাব্বুল আলামিন তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি বিশেষ রহমত ও বরকতপূর্ণ দৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং দুই ধরনের অপরাধী [আল্লাহর একত্ববাদে অংশীদারকারী এবং অন্য মুসলমানের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ ভাব বা ঘৃণা পোষণকারী] ছাড়া বাকি অনুশোচনাগ্রস্ত সকল ক্ষমাপ্রার্থীর অপরাধ মার্জনা করেন। আল্লাহর একত্ববাদে অংশীদারকারী, মুসলমানদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ ভাব পোষণকারী ছাড়াও বান্দার হক তছরুপকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং পিতামাতার অবাধ্যদের কথাও অন্যান্য হাদিসে মহানবী (সা.) উল্লেখ করেছেন বলে জানা যায়। বর্তমানের ধ্বংসোন্মুখ মুসলিম সম্প্রদায়ের আবাল-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে প্রত্যেকের উচিত লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান উপলক্ষে নিজেদের পাপরাশি মার্জনার আশায় মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত কামনা করা।
আমাদের অন্যতম জননী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের তাৎপর্য বর্ণনাকালে বলেন, শাবানের মধ্যভাগের এক রজনীতে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) দীর্ঘক্ষণ একটি সেদজায় লুটিয়ে ছিলেন। মোহাম্মদ (সা.) এর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশিক্ষণ পর্যন্ত কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেল। হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। অগত্যা কম্পিত হস্তে আমি সেজদারত নবী (সা.) এর পা মোবারক স্পর্শ করলাম। মহানবী (সা.) তাঁর পা মোবারক সরিয়ে নিলেন এবং সেজদারত অবস্থায় আমাকে শুনিয়ে এই দোয়াটি [আল্লাহুম্মা আউজু বিরিদাকা মিন সাখাতিকা। ওয়া বিমু আফাতিকা মিন উকুবাতিকা, ওয়া আউজুবিকা মিনকা। লা উহসি ছানাআন আ’লাইকা। আনতাকামা আছনাইতা আ’লা নাফসিকা] উচ্চারণ করতে লাগলেন। দোয়াটির বাংলা পারিভাষিক অর্থ দাঁড়ায় : হে বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা, আপনার ক্রোধ বা দ্বেষ থেকে আমি আপনার সন্তুষ্টির আশ্রয় চাই। আপনার শাস্তির পরিবর্তে আমি আপনার পুরস্কার কামনা করছি। আপনাকে ভুলে থাকার পরিবর্তে আমি আপনার মাঝেই আশ্রয় খুঁজে পেতে চাই। আমি তো আপনার পর্যাপ্ত গুণগান বা মহিমা কীর্তন করতে পারি না; আপনি স্বয়ংই নিজের সবিশেষ গুণগান করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, আখেরি নবী মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্যভাগের রজনীতে বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা সর্বনিম্ন আসমানে অবতরণ করেন এবং আরবের বিখ্যাত বানু কলব গোত্রের অসংখ্য মেষ-ছাগলের রাশি রাশি পশমের চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন [ইবনে মাজাহ এবং অন্যান্য]। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত অপর এক হাদিস অনুসারে, পবিত্র রমজান মাস ছাড়া বছরের অপরাপর মাসের মধ্যে শাবান মাসেই হজরত মোহাম্মদ (সা.) সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন। পবিত্র রমজানের ফরজ রোজার প্রস্তুতি হিসেবেই আখেরি নবী (সা.) এসব রোজা রাখতেন বলে আম্মাজান আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন।
ইসলাম ধর্মবিশারদদের বর্ণনা অনুসারে, ভূপৃষ্ঠে আগমন উপলক্ষে হজরত মোহাম্মদ (সা.) প্রতি সোমবার এবং বান্দার সাপ্তাহিক আমলনামা আল্লাহর দরবারে জমাদানের দিবস হিসেবে প্রতি বৃহস্পতিবার; অধিকন্তু প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর বর্ণনা অনুসারে, রজব হচ্ছে আল্লাহর মাস, শাবান হচ্ছে হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাস এবং রমজান হচ্ছে বান্দা তথা আখেরি নবীর (সা.) উম্মতদের মাস। আর সাওমের বিনিময়মূল্য বা প্রতিদান স্বয়ং মহিমান্বিত আল্লাহই প্রদান করবেন। নিসফে মিন শাবান রজনীর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.) বলেন, নিসফে মিন শাবান রজনীর সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদের উদ্দেশে বলেন, আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি ক্ষমা করে দেব। আমার নিকট রিজিক-আশ্রয়-সাহায্য প্রার্থনাকারী এমন কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি রিজিক-আশ্রয়-সাহায্য প্রদান করব। রোগে শয্যাশায়ী এবং বর্ণনাতীত শোকে কাতর এমন কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি আরোগ্য দান এবং দুর্দশা মোচন করতে পারি [ইবনে মাজাহ]। প্রকৃত প্রস্তাবে লাইলাতুল বরাতের সূচনা থেকে ফজর পর্যন্ত বান্দাদের ক্ষমা করার, রিজিক বৃদ্ধির, রোগ-শোক মুক্তিসহ অশেষ রহমত বর্ষণের ওয়াদা মহান আল্লাহ স্বয়ং প্রদান করেছেন।
বিশ্ববাসীর অবিস্মরণীয় জীবন বিধান পবিত্র কোরআনের চতুর্দশ অধ্যায়ের সুরা নহলের অষ্টাদশ আয়াতে বলা হয়েছে : ওয়া ইন তাউদ্দু নিমতাল্লাহে লা তুহছুঅ হা, ইন্নাল্লাহা লাগাফুরুর রাহীম (আর যদি তোমরা আল্লাহ তা’লার নিয়ামতরাজির গণনা আরম্ভ করো, তবে এর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না, সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহ তা’লা অতিশয় ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু)। পবিত্র কোরআনের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ প্যারার সুরা ইউসুফের ৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে : লা তাইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে, ইন্নাহু লা ইয়াইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে ইন্নাল কাওমুল কা’ফেরুন [আল্লাহ তা’লার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় মহান আল্লাহর রহমত থেকে শুধু সে সকল লোকই নিরাশ হয়, যারা কাফের।] পবিত্র কোরআনের ২৪তম অধ্যায়ের মক্কায় অবতীর্ণ সুরা যুমার ৫৩ নং আয়াতে আরও বলা হয়েছে : লা তাকনাতুম্ মির-রাহমাতিল্লাহে, ইন্নাল্লাহা ইয়াগফেরুজ যুনুবা, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপরাধীদের অপরাধ মার্জনাকারী; বাস্তবিকই আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু)।
তাই শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বা লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান নিয়ে অহেতুক ঝগড়া-ঝাঁটি ও কলহে লিপ্ত না হয়ে প্রত্যেকেরই আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দিবাগত রাতে যথাসাধ্য নামাজ-কালাম আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। আমরা নামসর্বস্ব ও পার্থিব মোহাবিষ্ট মুসলমানরা বর্তমানে বিশ্ব মানবতার শত্রু শয়তানের প্ররোচনায় কিংবা ব্যক্তি-গোষ্ঠী-পারিবারিক-দলীয় স্বার্থে পারলৌকিক দায়বদ্ধতা ও পাথেয় সংগ্রহকে পুরোপুরি উপেক্ষা করছি। মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বকে নির্বাসনে পাঠিয়ে উল্টো ক্ষণস্থায়ী জাগতিক প্রাচুর্য, ভোগবিলাসিতা, ক্ষমতার বাহাদুরি এবং পরস্ব হরণকে প্রাধান্য দিচ্ছি। পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকার্জনের স্থলে বাম হাতের লেনদেনের সুবাদে অল্প দিনে রাশি রাশি অর্থ সঞ্চয়ের মরণখেলায় মেতে উঠেছি। মূলত আকাশ-আড়াল-করা দৃষ্টিনন্দন অস্থায়ী হর্ম গড়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে আমরা স্বেচ্ছায় জাহান্নামকে স্বাগত জানাচ্ছি। করোনা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, টর্নেডো, আকস্মিক বন্যা, মহামারি ইত্যাদি প্রাকৃতিক আজাব-গজবে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানি আমাদের বিবেককে বিন্দুমাত্র নাড়া দিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিংহভাগ বাংলাদেশি স্বদেশ-স্বধর্ম ও স্বজনদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ, স্নেহসান্নিধ্য ছিন্ন ও করুণাকাতর মুখচ্ছবি পাথরচাপা দিয়ে প্রতিনিয়ত সুখের অভিনয় করে যাচ্ছি। আমাদের পারিবারিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়টা অর্জনের চেয়ে বর্জনের পাল্লাকে আমার দৃষ্টিতে ভারী করে তুলেছে। সর্বোপরি সর্বস্তরে এবং সর্বক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিযোগিতা বর্তমানে প্রতিহিংসায় রূপ নেওয়ায় আমাদের সনাতনী সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। আবার পার্থিব ঐশ্বর্য হাসিলের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বর্তমানে নানা অজুহাতে দৈনিক ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়েও আমাদের অনীহা প্রকট আকার ধারণ করছে। তাই এবারের লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানকে জীবনের শেষ লাইলাতুল বরাত জ্ঞানে অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও সাশ্রু নয়নে সানুনয় মিনতি জানাচ্ছি, হে রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হওয়ার তওফিক দান করে বিশেষভাবে ধন্য এবং কৃতজ্ঞ করেছ। দয়া করে তুমি আমাদের পবিত্র লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের রহমত ও বরকত দান করো।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
কমেন্ট বক্স