নরসিংদীতে লালনগীতির উৎসব বন্ধ করে দিতে হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন সম্মিলিতভাবে আপত্তি জানায়, হুমকি দেয়, বিক্ষোভ করে এবং হামলা চালায়। চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ও মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট ছিল জামায়াত-শিবিরের বিক্ষোভকারীদের প্রধান সহযোগী। জেলা পর্যায়ে ক্রিয়াশীল অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠন, বিশেষ করে জেলা শহর ও আশপাশের মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে বিক্ষোভ করেন। নিরুপায় হয়ে জেলা প্রশাসন লালন উৎসব বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। জেলা প্রশাসক অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অর্থাৎ উপদেষ্টাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই পদক্ষেপ নেন। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে দরগা জিয়ারতেও বাধা দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় নরসিংদীর পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সংস্কৃতিপ্রিয় লোকজন, গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের এই ঘটনা তাদের বিচলিত করে তুলেছে। লালন অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ সংগীত রচনা করে বাঙালির মানসে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। লালনের কোনো গানে ধর্ম বিরোধিতা করা হয়নি। বরং সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসীম ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক মহল মনে করে, লালনগীতি, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীতসহ সংগীত-সাংস্কৃতিক চর্চাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে এই ঘটনা।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্মীয় শক্তি ও উগ্রবাদী ধর্মীয় শক্তির উত্থান ঘটেছে। গত ২২ নভেম্বর নরসিংদীর নরসিংহপুরের এ ঘটনা তারই স্পষ্ট প্রতিফলন। সারা দেশেই ধর্মীয় সংগঠনগুলো নবশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে। জামায়াত, ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ছাড়াও ১২টির বেশি ছোট ছোট ইসলামী সংগঠন পারস্পরিক সমঝোতায় এসেছে। জামায়াত নেতৃত্বে সব ইসলামী সংগঠনের বৃহত্তর ঐক্য, অভিন্ন প্ল্যাটফরম তোলার প্রক্রিয়া দুই মাস আগে থেকেই শুরু হয়। সব বিধর্মী, ইসলামবিরোধী সংগঠনের কার্যকলাপ, বিশেষ করে নাচ-গান, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, দরগাহ-মাজারে গান-বাজনা, ফুল দেওয়া, জিয়ারত বন্ধ করার ব্যাপারে তারা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের বিষয়ে একমত হয়েছে।
আর্মি স্টেডিয়ামে প্রতিবছরই মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সংস্কৃতিমনা বিপুলসংখ্যক মানুষ এতে শরিক হন। দেশ-বিদেশের নামী-দামি শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সামনে বিকল্প চিন্তা করছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার পক্ষেও নয়। বাঙালির চরিত্রের প্রধান দিক হচ্ছে সংস্কৃতিচর্চা। বিজাতীয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ঘোর বিরোধী ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে অতি সাম্প্রতিককালে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতা লক্ষণীয়ভাবে দেখা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত খ্যাতিসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ, সংস্কৃতি মহল, ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংগঠক, কর্মী ও শিল্পীরা এতে উদ্বেগবোধ করছেন। প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সামনে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষক মহল।