অন্তর্বর্তী সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত সর্বত্রই চলছে ওই নানা তদবির। বিগত সরকারের সময়ে একমুখী তদবির হলেও এখন সরকার সমর্থক নানা গোষ্ঠী ও দেশের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কাছ থেকে প্রশাসনে বহুমুখী তদবির হচ্ছে। তদবিরের চাপে হাঁপিয়ে উঠেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। চতুর্মুখী তদবিরের যন্ত্রণায় প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিগত সরকারের আমলে শুধু আওয়ামী লীগ, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সব ধরনের তদবির, আদেশ-নিষেধ একমুখী ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজপথে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতারাই এখন তদবির করে বেড়াচ্ছেন। বদলি, পদোন্নতি কিংবা ঠিকাদারির কাজ পাইয়ে দেওয়ার মতো সচিবালয়কেন্দ্রিক ওসব তদবির অতীতের চেয়ে বেড়েছে। বড় দলগুলোর নেতাদের প্রায়ই সচিবালয়ে দেখা যায়। বিশেষ করে, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর নেতারা প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে চলছেন। তারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় পছন্দের ডিসি-এসপি নিয়োগ দিতে তদবির করে বেড়াচ্ছেন। তা ছাড়া বদলি-পদায়ন কিংবা ঠিকাদারি কাজের পেছনে দৌড়াচ্ছেন রাজনীতিকরা। বড় দলের নেতাদের পাশাপাশি ছোট নতুন-পুরোনো দলের শীর্ষ নেতাদেরও সচিবালয়ে দেখা যাচ্ছে। এমনকি ওই নেতারা আওয়ামী লীগের শাসনামলে সুবিধা নেওয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্যও তদবির করছেন।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে বিএনপি-জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারা দাপটের সঙ্গেই চাকরি করছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকেই পছন্দের দপ্তরে পদায়ন নিয়েছেন। নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতিও পেয়েছেন। প্রশাসনে এখন তারা প্রভাব বিস্তার করে চলছেন। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের পর তারা সহকর্মী-ব্যাচমেট কিংবা স্বজনদের জন্য দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। কে কোন দপ্তরে যাবেন, তা তারা ঠিক করছেন। এমনকি বিগত সরকারের সময়ে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা কর্মকর্তাদের জন্যও অনেকে তদবির করছেন। ফলে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত অনেক কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে বড় বড় দপ্তরে বসে আছেন। ওসব কর্মকর্তার এমন নীতিবিরুদ্ধ দৌড়ঝাঁপ বর্তমান সরকারের প্রশাসনের স্বাধীনভাবে কাজ করা ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে সচিবালয়েই নয়, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তদবিরের চাপে অতিষ্ঠ। স্থানীয় রাজনীতিকেরা স্থানীয় প্রশাসনকে তদবিরের চাপ দিচ্ছেন। ফলে কর্মকর্তাদের অনেক অযৌক্তিক তদবির রাখতে হচ্ছে। স্থানীয় সাংবাদিকেরাও নানা আবদার নিয়ে যাচ্ছেন। আর সেগুলো রাখলেও বিপদ, না রাখলেও ভয়ে থাকতে হয়। কখন কে নেতিবাচক নিউজ করে দেয়! সব মিলিয়ে বিগত সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমানে প্রশাসনে তদবিরের চাপ অনেক বেড়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সরকারের উপদেষ্টা ও সচিবরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও রাজনীতিবিদের লাগামহীন তদবিরে চরম বিরক্ত। তারা বলছেন, তদবিরের চাপ এতই বেশি যে, ঠিকমতো কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু সবাই যেভাবে তদবির ও নিজেদের সুবিধার জন্য আসেন, তা শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার শামিল।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, যে লক্ষ্য নিয়ে দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, সে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সব ধরনের চাপ ও তদবির উপেক্ষা করে সৎভাবে কাজ করতে হবে। তদবিরের দোহাই দিয়ে অযোগ্য-অদক্ষদের পুনর্বাসন করা হলে তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তদবির নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমগ্র প্রশাসনের মধ্য থেকে যোগ্য ও সাহসী কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে।