ভারতের একান্ত অনুগত ও পরম বিশ্বস্ত শেখ হাসিনা ও তার সরকার চরম অমর্যাদাকরভাবে বিদায় নেওয়ার চার মাস পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসল। এর মাধ্যমে ভারত ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন ও অন্তর্বর্তী সরকারকে মেনে নিল। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের জিইয়ে রাখা সমস্যা ও নতুন করে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরে আশু সমাধান চায় বাংলাদেশ। তবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যায়ে ফেরত চায়নি বাংলাদেশ।
বৈঠকে সীমান্তে হত্যা এখনো বন্ধ না হওয়া, নতুন সরকারের চার মাসে চারজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশ। পাশাপাশি প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার না করে রাবার বুলেট ব্যবহার, অতি দ্রুত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং আগামী বছর পর্যন্ত মেয়াদকালেই গঙ্গার নতুন পানিবণ্টন চুক্তি করার জোর দাবি জানানো হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যৌথ নদী কমিশনের নির্ধারিত বৈঠক নিশ্চিত করে সেখানে তিস্তা চুক্তিসহ অভিন্ন অপর নদীগুলোর পানিবণ্টনে চুক্তি ও সমঝোতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্রে জানা যায়, ভারত বাংলাদেশের উত্থাপিত বিষয়গুলো দৃশ্যত গুরুত্বের সঙ্গে শোনে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানে পৌঁছানোর আশ্বাস দেয়। সমস্যাগুলোর সমাধানে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ তাতে সম্মত না হয়ে দ্রুত এগুলোর সম্মত সুরাহার ব্যাপারে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে। বাংলাদেশিদের, এমনকি রোগীদের ভিসা না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে দ্রুত এর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে জানা যায়। কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন ও আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর এবং নয়াদিল্লি ও চেন্নাইয়ে বাংলাদেশ-বিরোধী বিক্ষোভ-গোলযোগের ঘটনাগুলো তুলে ধরে প্রতিকার চাওয়া হয়। ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ও প্রচারমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশবিরোধী অসত্য, ভুয়া প্রচার-প্রচারণা, ধর্মীয় উসকানি দেওয়া এবং বাংলাদেশে বিদ্যমান অত্যন্ত সৌহার্দ্যময় শান্তিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করা এবং এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পরিকল্পিত তৎপরতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। জানা যায়, ভারতীয় সচিব বিষয়গুলো বাংলাদেশের প্রত্যাশিত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেননি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করার কথা বলেছেন। উল্টো বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও সাম্প্রতিককালে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় হিন্দুর বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার কথা জানান। বিষয়টি ভারতের জন্য উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করা হয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, বৈঠকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অবৈধ অস্ত্র ঢোকার অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশ এতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ গত কয়েক বছর যাবৎই এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে আসছে। বিশেষ করে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশ থেকে নিগৃহীত হয়ে ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার মতো পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি হয়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ গিয়ে থাকতে পারে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ যারা বাংলাদেশ থেকে ভারতীয়দের ভাষ্যমতে চলে গেছে, তাদের ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব করে বাংলাদেশে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদে নিশ্চিন্তে অবস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা জানানো হয়। অবৈধভাবে ভারতে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ফেরত দেওয়ার জন্য বলা হয়। ভারতে থেকে শেখ হাসিনার অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ-বিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য, নির্দেশনার প্রতিবাদ জানিয়ে এসব তৎপরতার সুযোগ না দেওয়ার জন্য বলা হয়।
তবে এ পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত দেওয়ার কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়নি। আদালতের রায় হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চাওয়া হবে এবং তখন তাকে হস্তান্তর করতে বলা হবে বলে জানা যায়। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রতিবেশী ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ কমনা করে না বাংলাদেশ।