কীভাবে কেটে যায় সময়। কোনো কিছুই থেমে থাকে না। সময় তার গতিতেই চলে। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। পৃথিবীতে অনেক কিছুই ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু সময়কে ফিরে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ যে সময় হারিয়ে যায়, সে চিরকালের জন্যই হারিয়ে যায়। সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেকের জন্যই জরুরি। এই তো মনে হয়, সেদিন পবিত্র রমজানের রোজা শুরু হয়েছিল। দেখতে দেখতে কীভাবে দ্রুত রোজার মহিমান্বিত মাসটি চলে গেল। দীর্ঘ এক মাস সিয়ামের রোজাব্রত পালন শেষে আবার সবার মাঝে ফিরে এল পবিত্র ঈদুল ফিতর। কিন্তু রমজানের রোজার মাধ্যমে মুসলমানদের তাকওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধির উন্নয়ন কতটুকু অর্জিত হলো? আমাদের ব্যক্তিগত, পরিবারগত, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের বিশুদ্ধতার পরিবর্তন কতটুকু হলো। আত্মার ব্যাধি দূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে রোজা আমাদের সামগ্রিক জীবনের শুদ্ধি (আত্মশুদ্ধি), মনন-চেতনাগত আত্মোপলব্ধির সমাজের মানবিক উন্নয়নের কতটুকু বিকাশ সাধিত ঘটল।
সবার জন্য ঈদ সমাগত। ঈদুল ফিতর উদ্্যাপনের মাধ্যমে ঈদের ঐশী মহিমায় আমাদের আত্মিক ও সামাজিক অপাচার-অবক্ষয়, মানববিধ্বংসী যুদ্ধবিগ্রহ এবং মানবিক বিকাশের ব্যাধিমুক্ত সমাজ বিকাশের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই চিরায়ত আহ্বান, ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।’ ঈদুল ফিতরের সময় এ গানটির সুর-ধ্বনিতে সকল মিডিয়াসহ সর্বত্র ঝলসে ওঠে। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব এবং সমগ্র পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সকল সামাজিক পর্যায়ে কতটুকু উন্নয়ন সাধন এবং তার প্রতিফলন ঘটছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মত্যাগের উৎকর্ষ থেকে শুরু সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের জাতি-ধর্ম ও বর্ণ-বিবদমান বৈষম্যের অবসান ঘটেনি। সবই মনে হয় চলছে আগের মতো। আমাদের সামগ্রিক জীবনের মানবিকতার কতটুকু পরিবর্তন হলো (?), সেটিও আমাদের চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে।
সত্যি বলতে কি, পবিত্র ঈদুল ফিতরের মহান শিক্ষা থাকার পরও মুসলিম বিশ্বের জনসমাজের মানবিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে।
ঈদুল ফিতরের শিক্ষা হচ্ছে মানুষের ভেতরকার বৈষম্য বিদূরিত করে সাম্য-মৈত্রীর নীতিতে মানুষের মাঝে সৌভ্রাতৃত্ব সংস্থাপন করা। সেটি বর্তমানে মানবসমাজে অনুপস্থিত। আমাদের মনে রাখা উচিত, মানবতাই হচ্ছে একজন মানুষের মনুষ্যত্বের প্রধান অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মনুষ্যত্বহীন জীবন মূলত পশুত্বেরই নামান্তর।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে মানবতা আছে এবং যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’
এ ক্ষেত্রে বেটাম্যানের উক্তি হচ্ছে, ‘যার মধ্যে মানবতাবোধ নেই, সে মানুষ নামের অযোগ্য।’
ঈদের শিক্ষায় আমরা যেন অপর মানুষকে আর অবহেলা না করি। অসহায় মানুষের হক আদায় করে তাদের ভেতরকার বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা করি। ঈদুল ফিতর এমন একটি উৎসবের দিন, যার মাধ্যমে ধনী-গরিব সব মানুষ সমানভাবে আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকতে পারেন। এই উৎসব কোনো উগ্র-উচ্ছৃঙ্খল জাহেলি উৎসব নয়; এ তো মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাম্য-মৈত্রীর বন্ধনে এক অপরকে আলিঙ্গনের উৎসব। যে উৎসবের ঝরনাধারায় আমাদের মানবিক শক্তির পরিবৃদ্ধি ঘটবে। এই উৎসবের মাধ্যমে যেন মানুষের জন্য মানববন্ধনের সঞ্জীবনী বৃদ্ধি পাবে।
নিজের সম্পদের ওপর ভর করে শুধু নিজস্ব বলয়ের মধ্যে আনন্দ করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। সমাজের সকল মানুষকে নিয়ে আনন্দ করতে পারলেই প্রকৃত সাম্যবোধ ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।
বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে মানববিধ্বংসের উন্মাদনায় রক্তাক্ত পৃথিবী। বিশেষ করে, বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা বড়ই করুণ। মধ্যপ্রাচ্যের বুকের ওপর এক ভয়ংকর দানবের পৈশাচিকতায় সমগ্র বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গেছে। আর্থসামাজিক আর আর্তমানবতার এক করুণ ও পীড়াদায়ক অবস্থা ইসলামি দুনিয়াজুড়ে। মুসলমানদের এমন কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর পাশবিকতার শিকার সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষ। সভ্যতার ওপর রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বৈরতন্ত্রীমূলক এমন আঘাত এর আগেও ছিল। কিন্তু পবিত্র রোজার মাসে এ রকম ধারাবাহিক অত্যাচার, নির্যাতন, নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর রাষ্ট্রীয় বর্বরতা সবকিছুকেই হার মানিয়েছে। ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের অত্যাচার, নিপীড়ন আর গণমানুষের ওপর দমননীতির ফলে যেকোনো দেশে সন্ত্রাস বেগবান হয় এবং নানা রকম অপরাধপ্রবণতার বৃদ্ধি ঘটে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। বিপর্যস্ত অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কর্মহীন মানুষের বেকারত্বের গ্লানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে জনজীবনের দুর্ভোগ, রাষ্ট্রপুঞ্জের বৈষম্য ও নির্যাতনের সুযোগে দেশে দেশে সন্ত্রাস আর মানববিধ্বংসী অপরাধপ্রবণতা ছেয়ে আছে।
এবারের রোজার পূর্ব থেকে অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শতাব্দীর ভয়ংকর বর্বরতা চলছে ফিলিস্তিনে। ইসরায়েলি দস্যু সৈন্যদের নিষ্ঠুরতম বর্বরতায় ফিলিস্তিনের অন্তত অর্ধলক্ষ নারী-শিশুসহ বিভিন্ন বয়সে বিগত দিনগুলোর মতো মুসলমানদের সবচেয়ে তাৎপর্যময় পবিত্র রমজান মাসেও সিরিয়ায় সরকারি স্বৈরাচারের ধ্বংসলীলা। যেখানে নৃশংসভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে বেপরোয়াভাবে। অতএব, সে দেশের গণমানুষের রোজাব্রত পালন আর পবিত্র ঈদুল ফিতর কীভাবে পালন করা হতে পারে।
পবিত্র রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, ইয়েমেনসহ অনেক দেশের মানুষ চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
বিগত দিনগুলোর মতো মুসলমানদের সবচেয়ে তাৎপর্যময় পবিত্র রমজান মাসেও সিরিয়ায় সরকারি স্বৈরাচারের ধ্বংসলীলা। যেখানে নৃশংসভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে বেপরোয়াভাবে। অতএব, সে দেশের গণমানুষের রোজাব্রত পালন এবং বিগত বছরগুলোতে পবিত্র ঈদুল ফিতর কীভাবে পালন করা হয়েছে (!), তা সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া যুদ্ধবিগ্রহ ও আগ্রাসনের শিকার আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরাক ও বিপর্যস্ত ইয়েমেনের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটেনি। ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও চিকিৎসার অভাবে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহে শিশু ও নারীরা অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করছে।
নিরস্ত্র মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বর্বর হানাদারদের বোমার আঘাতে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। এই উপত্যকার তিরিশ লাখ মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে।
ফিলিস্তিনের আর্তপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ থেকেও আরব বিশ্বে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কয়েকটি দেশের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে ভয়াবহ বর্বরতা চলছে সিরিয়ায়। সেখানকার সিংহশাবক এক উন্মাদ বর্বর শাসকের পাশবিকতায় সমগ্র পৃথিবীর বর্বরতাকে হার মানিয়ে দিয়েছে। এমনকি ফিলিস্তিনে এ-যাবৎকালে যেসব মানববিধ্বংসী বর্বরতা চলেছে, তার চেয়েও বেশি ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে চলেছে সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসকের অত্যাচার ও নির্যাতন। সেখানে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ হচ্ছে। হাজার হাজার দালান-কোঠা ধ্বংস এবং প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষ দেশছাড়া হয়ে দূরস্থিত শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে এবং মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রতিনিয়ত গণহত্যার শিকারে মর্মান্তিকভাবে মারা যাচ্ছে নারী, শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ।
কয়েক বছর আগে (রোজা শুরুর আগে) আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হাজার বছরের ঐতিহ্যময় পবিত্র জেরুজালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা ও মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়। ট্রাম্প-কন্যা ইভাঙ্কার নেতৃত্বে ওই উদ্বোধন পর্বটি ছিল স্মরণকালের উন্মাদনাপূর্ণ ও উল্লাসমুখর। ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ দুঃখ-ক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে। কিন্তু ইসরায়েলের হাতে মজুতকৃত ভয়ংকর মারণাস্ত্র প্রয়োগ করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের শত শত নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পুরো রোজার মাসেই ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বর্বরতা অব্যাহত ছিল। সে সময় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের প্রচুর মানুষ হতাহত হয়েছেন।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি আরও মারাত্মক, আরও ভয়ংকর! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত ও সহযোগিতায় ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অমানবিক আগ্রাসন ও বোমা হামলায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভূমিকা তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সকল উত্তম কাজগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে। ফিলিস্তিন ধ্বংসের পেছনে ইসরায়েলকে সহযোগিতা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় সমগ্র বিশ্বকে স্তব্ধ ও অবাক করে দিয়েছে।
সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন আর ধ্বংসযজ্ঞের কথা। জাতিসংঘ কিংবা পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রসংঘ পারেনি ইসরায়েলের পৈশাচিকতাকে রুখে দিতে। বরং পশ্চিমা দেশসমূহ এবং আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বর্তমানে ইসরায়েল বিপুল অর্থবিত্ত ও মারণাস্ত্রের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজাসহ ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূখণ্ডের পুরোটাই বলা যায় এখন ইসরায়েলের দখলে। হাজার হাজার বছর ধরে ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের ওপর স্বাধীন ফিলিস্তিন বলতে কিছুই নেই। নিজের মাতৃভূমিতে অবরুদ্ধ জীবনের ঘানি টানতে টানতে এভাবেই কত মানুষ ধুঁকে মরছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। স্বজনহারা আর্তনাদ, শোক আর দুঃখ-কষ্টই যাদের নিত্যসঙ্গী। এ অবস্থায় ঈদ অথবা কোনো আনন্দই ফিলিস্তিনের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের জীবনে নেই।
আরব বিশ্বের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী দেশ হচ্ছে ইয়েমেন। কয়েক বছর পূর্বে রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের অমানবিক বোমা হামলায় সমগ্র ইয়েমেনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তেমনি আরও অনেক আগে হাজার বছরের ইতিহাসখ্যাত পৃথিবীর এই প্রাচীনতম দেশ মিসরের অবস্থাও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। মিসরের স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা সে দেশের নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলের মাথায় উৎখাত করেছে। ২০১১ সালের প্রারম্ভে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মিসরে এক গণ-অভ্যুত্থানে সে দেশের ভয়ংকর এক স্বৈরশাসক এবং ডিক্টেটর হোসনি মোবারকের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে সর্বমহলে সমাদৃত একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাধারণ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ড. মুহাম্মদ মুরসি পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পৃথিবীর সকল দেশ এবং সর্বমহলে মিসরের পরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রচলন বেশ প্রশংসিত হয়। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ব্রাদারহুডের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী মুরসি সরকারকে মিসরের সামরিক জান্তা জোরপূর্বক উৎখাত করে এবং নির্মমভাবে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।
পবিত্র রোজার মাস কিংবা ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখেও মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে মানববিধ্বংসী হামলা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ থাকেনি। বরং কোনো কোনো দেশে তুলনামূলকভাবে আগের চেয়েও বেশি ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছিল মোটামুটি শান্ত।
মুসলিম দেশের বাইরে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চলেছে শতাব্দীর বর্বরতম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের তাদের প্রিয় জন্মভূমি থেকে চিরতরে উৎখাত করার ঘৃণ্যতম কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নির্বিচারে নারী-শিশু, আবাল-বৃদ্ধ ও যুব সম্প্রদায়কে ব্যাপকভাবে হত্যা করেছে। পবিত্র রোজার মাসেও মিয়ানমারের স্বৈরাচারী সরকারের মুসলিম বিধ্বংসী কার্যক্রমে সে দেশের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা সরকারি গুন্ডা-পান্ডাদের নাশকতামূলক অপতৎপরতা সমানভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে (!)। বর্তমান বিশ্বে ওই রকম নৃশংসতা ইসরায়েল ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায়নি। মিয়ানমার সরকারের আর্মি ও সন্ত্রাসীরা একযোগে রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুসলিমদের হাজার বছরের স্মৃতিচিহ্নসমূহ ধ্বংস করে দিয়ে রোহিঙ্গাদের ভূমিগুলোর সবই এখন বার্মিজ সরকারি দস্যুদের দখলে। প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের ভিটেবাড়ি থেকে নির্দয় ও নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। নারী, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ সর্বস্তরের রোহিঙ্গা মুসলিমদের করুণ চিত্র একটি নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বার্মিজ বর্বর সরকারের হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যেখানে প্রায় তিন লাখ শুধু শিশু, যাদের মা-বাবা মিয়ানমারের বর্বরতায় মারা গেছে। মিয়ানমারের মানববিধংসী বর্বরতাকে কেউ রুখে দিতে এগিয়ে আসেনি। মানবতার এমন বিপর্যয়ের সময়ে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা এতই করুণ যে, সংশ্লিষ্ট দেশের সাধারণ মানুষের সুখ-আনন্দ হারাম হয়ে গেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র বলতে শুধু পলিথিন আর পাতা মোড়ানো ছাউনিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অসহায় মানুষের জীবন কাটে। এ অবস্থায় ঈদ কিংবা আনন্দ কীভাবে আশা করা যায়?
এ রকম মানবেতর অবস্থায় সমগ্র পৃথিবীর অন্য সব দেশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এবার নজর দেওয়া যাক আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের প্রতি। এককথায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ভালো নেই। বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে।
প্রায় দুই যুগ ধরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা না থাকার ফলে সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযোগ অনেক। তারা বলছে, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নেই।
সরকার নিজস্ব সুবিধাবোধ আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করে নেওয়ার জন্য দেশের বিরোধী মতের রাজনীতিকে বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়েও অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে গলাটিপে হত্যা করার নীলনকশা বাস্তবায়নে অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাভাব এবং দেশের অর্থনীতির চাকা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতে চরম ঘাটতি, অরাজকতা, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশের আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বকরণ এবং গণমাধ্যমের ওপর সরকারের পেশিশক্তির নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। মিথ্যা ও সাজানো মামলার ভারে সমগ্র দেশময় এক চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজিত। রোজার মধ্যে রাজনৈতিক মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের সাজা মওকুফ করে তাদের মুক্তির পথ সৃষ্টি করলে সরকারের মহানুভবতার পরিচয় ঘটতে পারে। এ মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূরীকরণে সরকার আন্তরিক হলে ক্ষতি নেই। উন্নয়নের পাশাপাশি বরং এ ক্ষেত্রে সরকারের মহানুভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে পারে।
এবারের রোজার মাসটিও বাংলাদেশের গুটিকয়েক সুবিধাভোগী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হাতে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা জিম্মি। ফলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে অনেক কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চরম উৎকণ্ঠা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে বলে রাষ্ট্রচিন্তক ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন।
ইসলামের সর্বপ্রধান তাৎপর্যময় পবিত্র রমজানের রোজা পালন ছাড়াও নির্বিঘ্ন ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যত্যয় ঘটেছে দেশের অধিকাংশ শহর-বন্দর ও প্রত্যন্তাঞ্চলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম রোজার মাসে সরকারিভাবে ইফতার পার্টি না করার সিদ্ধান্ত আরোপিত হয়েছে। যদিও বিরোধী দল রোজার মাসে ইফতার পার্টির আয়োজন অব্যাহত রেখে ইফতারি ও তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে থাকায় অর্থনৈতিক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা আর নৈরাজ্য ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যানবাহনের নানাবিধ দুর্ঘটনায় দেশের বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এবার ঈদের আগে বাড়ি ফেরার পথে অসংখ্য মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি যেন না ঘটে, তাই আমাদের প্রত্যাশা।
পবিত্র ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিমের আনন্দ-উৎসব ও খুশির দিন। কিন্তু বর্তমান সময়ে ইসরায়েলের মানববিধ্বংসী বর্বরতায় ফিলিস্তিনের জনগণের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। লাখ লাখ মানুষ নিজস্ব বাড়িঘর হারিয়ে কোথাও ঠাঁই নিতে পারছে না। প্রতিনিয়ত দস্যু ইসরায়েলের পৈশাচিকতা ও দানবীয় বোমা হামলায় নারী-শিশুসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। অসহায় ফিলিস্তিনিরা চরম মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ অবস্থায় সমগ্র মুসলিম জাতির উচিত ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষকে সাহায্যে এগিয়ে আসা।
ফলে এমন দুঃখ-কষ্ট আর বেদনার মধ্য দিয়ে আনন্দের পরিবর্তে দুর্বিষহ জীবনগাথাই ফুটে ওঠে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ আর আর্থসামাজিক জীবনে। শান্তির বিপরীতে অশান্তি আর আনন্দের বদলে দুঃখ-কষ্ট ও শোকগাথা বেদনাই যেন আমাদের জনজীবনের নিত্যসঙ্গী।
চিরায়ত নিয়মে এবারও ঈদুল ফিতর আমাদের সামনে সমাগত। যেন সকল কষ্ট ও দুঃখবোধকে ভুলে ঈদের মহাখুশিতে সবাই উৎসবে অংশ নিতে পারেন। পুণ্য প্রেমের অবগাহনে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলে মিলে আনন্দ-ফুর্তি ও উৎসব করতে পারেন। মানবীয় গুণের অপার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে মানুষের মাঝে যেন ফিরে আসে স্বস্তি, শান্তি ও প্রাকৃতিক, সামাজিক সুশীল পরিবেশ। ঈদ আনন্দের মাধ্যমে মানবিক চেতনায় আমাদের মনের বিকাশ আকাশছুঁয়ে নেমে আসুক সুখ-শান্তি ও তৃপ্তির ফল্গুধারা। ফুলের পাপড়ির মতো মানুষের মাঝে নেমে আসুক দয়া-দাক্ষিণ্য, প্রেম ও মমতার অঝোরধারা। মন্দকে পরিহার করে আমরা যেন মনের চোখ দিয়ে মানুষ ও পৃথিবীর উত্তম নিদর্শনকে অবলোকন করি। মহাকবি ইকবালের একটা বিখ্যাত কবিতার লাইন এমন-
‘আছে এবং ছিল-র বাগানকে উদাসীন চোখে দেখো না।
এটা তো দেখবার জিনিস, বারবার চেয়ে দেখো।’
আর কবিগুরুর ভাষায় যদি বলি-
‘ঐ তো আকাশ কোশ দেখি স্তরে স্তরে পাপড়ি মেলিয়া
জ্যোতির্ময় বিরাট গোলাপ।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও বলেন,
‘প্রত্যক্ষ দেখেছি যথা
দৃষ্টির সম্মুখে হিমাদ্রিরাজের সমগ্রতা।’
আবার এল ফিরে, সকল প্রান্তের মুসলিম নীড়ে মহিমান্বিত ঈদুল ফিতর। আমরা যেন সকল প্রকার বৈষম্য ও হানিহানি বাদ দিয়ে সাম্য-মৈত্রীর বন্ধনে এক অপরকে গ্রহণ করি। একে অপরের প্রতি সহনশীল হই। মানবতার সেবায় এগিয়ে অসহায়ের প্রতি দয়াশীল হই। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর রহমত বর্ষণ করেন না।’ যে মহান বিশ্বাসের মহিমা ও দীপ্তিতে আমরা মুসলিম, সেই দীপ্তালোকে আমরা যেন অহংকারমুক্ত হয়ে অসহায় আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারি।
মহীয়সী কবি কামিনী রায়ের বিখ্যাত উক্তি :
‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’
এসব কষ্ট আর দুঃখবোধের মাঝেও ঈদ আসে মানুষের দ্বারে, যেন আমরা একে অপরকে বুঝতে পারি। দুঃখ-কষ্ট, হাসি-আনন্দ শেয়ার করতে পারি। অসহায় মানুষের স্বার্থে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারি। সবাইকে নিয়ে কিছুটা হলেও আনন্দ করতে পারি। আমরা যেন মানুষকে অবজ্ঞা নয়, হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারি। কবিগুরুর ভাষায় যেন বলতে পারি :
‘দুঃখ সুখের লক্ষ ধারায়
পাত্র ভরিয়া দিয়েছি তোমায়...।’
সেটাই তো ঈদের শিক্ষা। সবার জীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক। পবিত্র ঈদুল ফিতরের শিক্ষায় পরম তৃপ্তি ও আনন্দ ছোঁয়ায় সবার জীবনে সুখ-শান্তির আনন্দধারা নেমে আসুক। ঈদ আসুক সবার ঘরে। ঈদ আসুক সবার তরে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক