বিএনপির জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। দলের জনপ্রিয়, সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখাই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম পর্যায়ে ৮ মে ১৫২টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে গত ২ মার্চ। চার ধাপে দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে। সর্বশেষ ধাপের নির্বাচন হবে জুনে। ব্যাপক সংখ্যক প্রার্থী এবং বিপুল সংখ্যক ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে স্থানীয় সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে সরকার, সরকারি দল ও তাদের সহযোগীরা। তবে এই নির্বাচনে ভোটারদের ন্যূনতম পর্যায়ের অংশগ্রহণ দেখাতে চায় বিএনপি ও তার অনুসারীরা। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই দেশের মানুষ, ভোটাররা আগ্রহী নয়; অবাধ, নিরপেক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়-প্রমাণ করতে চায় বিরোধীরা। একই কারণ দেখিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং নির্বাচিত সরকারের বৈধতা দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে বিএনপি এবং তার বিদেশি মিত্ররা। কিন্তু ৪২ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশি-বিদেশি তৎপরতা নিষ্ফল হয়। এখন এই সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর পক্ষে অংশ নেওয়া রাজনৈতিকভাবে সম্মানজনক নয়। বিএনপিও নানাভাবে চেষ্টা করছে নির্বাচন বর্জনকারী তার সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে উপজেলা নির্বাচন থেকে দূরে রাখার।
বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী দল উপজেলা নির্বাচনে যদি অংশ না-ও নেয়, তাতে নির্বাচন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই। কারণ সরকারও কৌশলী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। অর্থাৎ দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক ছাড়াই নিবন্ধিত কোনো দলের কোনো পদাধিকারী, সদস্য, সমর্থক এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
বিএনপির আগ্রহী নেতারা এর সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয়, জনসমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অন্যদের মতো তারাও অংশ নেবেন। দলের সিদ্ধান্ত না লাগলেও দল বিরোধিতা করলে তাদের রাজনৈতিকভাবে সমস্যায় পড়তে হবে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথাও জানায়নি এখনো। বিএনপি সূত্রে জানা যায়, হাইকমান্ড অর্থাৎ লন্ডন থেকে নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত আসবে বলে তারা জানতে পেয়েছেন। লন্ডন থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়ার পরই মাঠপর্যায়ে দলীয় সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
বিএনপি হাইকমান্ড থেকে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত এলেও উপজেলা পর্যায়ের সম্ভাবনাময়, জনপ্রিয় নেতারা তা মেনে নিয়ে নির্বাচনী ময়দান থেকে দূরে থাকবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। দল থেকে বহিষ্কার করা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঝুঁকি থাকলেও অনেকে তার পরোয়া না করতে পারেন। এর আগেও দলীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং নির্বাচনে বিজয়ীদের দলে সম্মানজনক অবস্থায়ই রাখা হয়। এবারও ব্যতিক্রম হবে না বলেই তারা মনে করেন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন, চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারীদের অধিকাংশই এ নির্বাচনে অংশ নেবে। রাজনৈতিক, আর্থিক প্রস্তুতিও নিচ্ছেন অনেক প্রার্থী।
উপজেলা নির্বাচনকে সংগঠনকে তৃণমূলে শক্তিশালী করার সুযোগ নেওয়ার পক্ষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য। জেলা থেকে নিয়ে উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্বের কোন্দল রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে জেলা, উপজেলা পর্যায়ের নির্দিষ্ট নেতাদের মোবাইলে যোগাযোগ, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলাকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তারেক রহমানের মোবাইল, তার সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনার সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট নেতারা স্থায়ীভাবে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকেন। এই যোগাযোগকে স্থানীয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার, কোণঠাসা করার কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেন। স্থানীয় কমিটি, নেতৃত্ব, নিয়েও স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধ রয়েছে। কেন্দ্র থেকে তা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়নি। এই কোন্দল অমীমাংসিত থাকার ফলে একদফার আন্দোলনে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কার্যকর অংশগ্রহণ ছিল না। এতে করে তৃণমূলে সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটেনি, শক্ত সাংগঠনিক ভিত প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব হয়নি।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে সাংগঠনিক ভিত শক্তিশালী করার স্বার্থে ব্যবহার করার পক্ষে তৃণমূলের নেতৃবৃন্দ ও কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশ। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান। দলীয় মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা না থাকায় স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে কাজ করতে শুরু করেছেন তাদের অনেকেই। তারা আশা করছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত আসবে। দল ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা দলের বৃহত্তর স্বার্থে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। এতে ফলাফল ঘরে তোলা সহজতর হবে। দল ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না দিলেও অনেক জায়গায়ই জনপ্রিয়, জনসমর্থনপুষ্ট স্থানীয় অনেক নেতাই নির্বাচনে অংশ নেবেন।