আমি কেন লিখির উত্তরে সূত্র হারিয়ে ফেলা কথাটিই প্রথমে মনে এলÑযদি জিজ্ঞেস না করো, তাহলে আমি উত্তর জানি, আর যদি জিজ্ঞেস করো, তাহলে জানি না।
কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হলে যে অবস্থা হয়, আমার বেলায়ও তেমন। লেখক ভাবতে লজ্জা এসে আটকে দিচ্ছে হাত। তার পরও অস্বীকার করা যায় না, ইংরেজ রোমান্টিক কবি স্যামুয়েলের কাব্যভাবনা বা কবি ফকির লালন শাহর কাব্যভাবনার মধ্যে শিক্ষা, স্থান, কালের দূরত্ব যতই থাক; চেতনার, অনুভবের ঐক্যে তাদের অসাধারণ নৈকট্য।
ময়ূরের বর্ণাঢ্য পেখমের পাশে ছোট্ট টুনটুনির সৌন্দর্য যেমন উপেক্ষার নয় বা অনেক বর্ণিল ফুলের সমারোহে হাসনাহেনা না থাকলেও যেমন কোনো ক্ষতি হতো না, তার পরও পৃথিবীতে সবকিছুর প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত।
-গভীর রাতে কুড়িগ্রাম আর কুড়িগ্রাম থাকে না, মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ায়- এমন চিত্রকর্ম তৈরি করার মতো তৃতীয় নয়ন বা ষষ্ঠেন্দ্রিয় যাদের সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন, তাদের লেখক না হয়ে উপায় নেই।
নৃত্য ও হাঁটার মধ্যে তফাৎ অনুভবের, কেউ ছন্দের তালে হাঁটে, কেউ তালহীন। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব গল্প আছে, আছে ভাবনা, কেউ লিখে প্রকাশ করতে পারে, কেউ পারে না।
-বাদাম খাও, ঠোঙা পড়ো-টাইপের পাঠপোকা আমি। আমার জানা, দেখা জগতের বাইরে যে আরও একটা জগৎ আছেÑবই পড়ে, পত্রিকা পড়ে পড়ে সে জগতের সন্ধান আমি পেয়েছি।
আমার বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের কৃষিপ্রধান এক গ্রামে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষিতের হার ২৫%। অনেকগুলো গ্রামের জন্য থাকা একটা প্রাইমারি স্কুল, আর তা ছিল আমাদের গ্রামে। মা বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন, বাবা দীর্ঘকাল একনাগাড়ে আমেরিকাবাসী থাকার কারণে শুধু পড়তে পারতেন ইংরেজি। মায়ের কাজিনদের কয়েকজন তখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। বেগম রোকেয়ার জীবনী আমাদের স্কুলে পাঠ্য ছিল। অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় ভাইয়ের কাছে বিদ্যাভ্যাস আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাকেও রোমাঞ্চিত করত। মা চাইতেন তার কাজিনদের মতো নয়, আমি যেন শিক্ষা নিয়ে সমাজের নারীদের শিক্ষিত করার কাজে লাগি। ক্লাসে ধারাবাহিক গল্প লেখা ও দেয়াল পত্রিকায় লিখতাম। প্রচণ্ড পাঠনেশা আমাকে কঠিন বিষয়ে কৌতূহল বাড়িয়ে দিল। ফলে পরবর্তী সময়ে আমি প্রবন্ধ লেখার দিকে ঝুঁকে পড়ি।
বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু ইতিহাসবেত্তারা মানবসভ্যতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে তা বারবার এড়িয়ে গেছেন। অটোমান স্টাননি তার ‘মাদার অ্যান্ড ডটার অব ইনভেনশন’ বইতে দেখিয়েছেন, পুরুষ যখন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়েছে, তখন তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে কিন্তু নারীদের উদ্ভাবন চলে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে।
লেখা একটি সাধনার বিষয়, এ জন্য প্রচুর পড়তে হয়, ভাবতে হয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজকর্ম আর লেখা একসঙ্গে যায় না। লিখে জীবিকা নির্বাহ হবে, এমন কথা আমাদের দেশে কেউ কল্পনাই করতে পারে না।
ছোটবেলায় বা কৈশোরকালে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো বই পড়তেই আমাদের মা-বাবারা উৎসাহ দিতেন না। সংগীত, নৃত্য বা চিত্রকলার ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির কোনো স্কুল কখনোই আমাদের ছিল না। পরিবারে কেউ লেখার অনুরাগী না থাকায় আমি লেখক হয়ে উঠতে পারিনি।
কিছুটা অন্তর্মুখী মানুষ আমি কারও সঙ্গে কথা দিয়ে তুমুল ঝগড়া কিংবা তর্ক জমাতে পারি না। ভালোলাগায়Ñমন্দলাগায় উচ্ছল ঝরনা বা বৃষ্টি হতে যখন পারি না, তখন কথারা আমার ভেতরে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। তখন আমি লেখার মাঝেই আশ্রয় খুঁজি।
২০০৯ সালের নিউইয়র্ক বইমেলায় ‘কেন লিখি’র উত্তরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, লেজ আর মেধা লুকিয়ে রাখা যায় না। আমিও তা-ই বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তার দান বাড়তি ইন্দ্রিয় নিয়ে আমার ভোঁতা কলমে কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছি।
পৃথিবীতে বিখ্যাত মানুষদের সবারই কিছু অদ্ভুত শখ ছিল। তারা অদ্ভুত শখ পূরণ করে আনন্দ পেতেন, তৃপ্তি পেতেন।
ইতিহাসের কুখ্যাত অ্যাডলফ হিটলার, তার সময়ে জার্মানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভায়োলিন বাদক ছিলেন। তার অদ্ভুত শখের সঙ্গে ভায়োলিনের ছিল অদ্ভুত সম্পর্ক। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ভায়োলিন বাজিয়ে সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিÑমোনালিসার হাসির মধ্যে অমর হয়ে আছেন। বাজার থেকে বিভিন্ন জাতের পাখি কিনে বাড়িতে এনে উড়িয়ে দেওয়া ছিল তার শখ।
বিজ্ঞানী মারকনির স্বভাবের ছেলেমানুষি প্রকাশ ঘটত তার অদ্ভুত শখের কারণে। বছরের ৩৬৫ দিনই তিনি সমুদ্র উপকূলে ঘুড়ি ওড়াতেন। যদি কোনো কারণে তা ব্যাহত হতো, সেদিন তিনি ঘুমাতে পারতেন না।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর উপন্যাস ‘আমার বন্ধু’তে লিখেছিলেন, লেখার নেশা এতই কঠিন, ততই ভয়ানক হয়ে উঠেছে যে প্রথম দিকে লিখতে ভালো লাগে, তারপর হলো না লিখলেই খারাপ লাগে। আর এখন হয়েছে লিখতে ভালো লাগে না আবার না লিখলেও খারাপ লাগে। নেশাখোরের মতো চরম অবস্থা।
লেখা খুব পরিশ্রমের একটি কাজ। যার এ শখ আছে, নেশা আছে, তার না লিখে উপায় নেই।
লেখার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা আমাকে বিনা মজুরিতে কাজটা করতে বাধ্য করে। তার পরও পড়া ও লেখা আমার শখ।