Thikana News
০১ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

দুটি ভিন্ন সময়ে বেড়ে উঠেছি আমরা

দুটি ভিন্ন সময়ে বেড়ে উঠেছি আমরা



 
প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি আমি। স্কুল শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে ভাতঘুমের নিয়ম ছিল আমাদের। আমি ঘুমের ভান ধরে মড়ার মতো পড়ে থাকতাম। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে কখন পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ব, সেই অপেক্ষায় থাকতাম। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একসময় বেরিয়ে পড়তাম। রুদ্ধশ্বাসে ছুটতাম। কোথায় যেতাম? কেনই-বা যেতাম?
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ছুটতাম পাড়ার বন্ধু দীনার বাসার উদ্দেশে। তাদের ছিল বিশাল উঠোন। গাছগাছালি-ঘেরা ফুলের বাগান। সেখানে গাছে গাছে ফড়িং আর প্রজাপতি উড়ে বেড়াত। ফুলের সৌরভ, মৌমাছির ভোঁ ভোঁ আওয়াজ আমায় পাগল করে তুলত। আমি ফড়িং ধরতে চাইতাম। তার পিছু পিছু উড়তে চাইতাম। প্রজাপতির পাখার রং দেখতাম অপলক নয়নে। ভাবতাম, ইশ্‌ এমন দুটো পাখা যদি থাকত। কখনো প্রজাপতির পিছু, কখনো-বা চড়ুইয়ের পিছু ছুটতাম দুই হাত মেলে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে। সে কী আনন্দ! সে কী বিস্ময়! কখন যে সন্ধ্যা ঘনাত, টেরই পেতাম না। আচমকা দীনা চেঁচিয়ে উঠত, ‘রিমি, তোমার আব্বা আসতেছে...।’ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতাম। দেখতাম, আব্বা দূর থেকে লাঠি হাতে ছুটে আসছেন আমার দিকে। তাই দেখে আমি অন্য পথে দে-ছুট। গাছগাছালি-ঘেরা একটি ফুলের বাগানে চরাচরজুড়ে ছড়িয়ে পড়া পশ্চিমাকাশের গোলাপি আভায় ফ্রক পরা ছোট্ট এক বালিকা ছুটছে। কাঁধ অবধি নেমে আসা চুল হাওয়ায় উড়ছে। চোখেমুখে বাতাসের ঝাপটা। পিছু ছুটছে লাঠি হাতে এক বাবা, যেন দুটো সি-গালের ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া। কী দুরন্ত সময়! কী দুর্দান্ত এক শৈশব, কৈশোর ছিল আমার!
সাঁতার শিখেছি আমার বেড়ে ওঠা শহরের লেকে। ঝুপঝাপ পানিতে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, ঝুনা নারকেল কিংবা কলাগাছের ভেলায় ভেসে ভেসে। আমাদের সময়ে স্কুলে যেতাম ও ফিরতাম দল বেঁধে হই-হুল্লোড় করে পায়ে হেঁটে। টিফিন ঘণ্টা বেজে উঠলে ছুটতাম দলে দলে মাঠ অভিমুখে। দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলতাম। ক্লাসে পড়া না পারলে শিক্ষকেরা ধমক দিয়েছেন। কান ধরে বেঞ্চিতে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। কিংবা বেত দিয়ে ঠাসঠাস মেরেছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে শিক্ষকের নামে অভিযোগ করা ছিল দুঃসাহসী ব্যাপার। শিক্ষক ধমকে দেবেন, মারবেন, অন্যায় করলে শাসন করবেন। সবই তো আমার ভালোর জন্যে। সুতরাং কোনো অভিযোগ করা চলবে না। করলেও বাবা-মায়েরা তা আমলে নিত না। তবে সবচেয়ে বড় যে সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তা হলো বইপড়ার ক্ষেত্রে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো বই পড়া ছিল রীতিমতো কঠোরভাবে নিষেধ। তবু এই একটি নিষেধ অমান্য করতাম প্রায়ই। পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে পড়তাম শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা যেকোনো গল্পের বই। লিখতাম কবিতা, গল্প। লুকিয়ে রাখতাম। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মামাকে চিঠি লিখতাম, ‘শ্রদ্ধেয় মামা, আমি এবার ক্লাসে নবম হয়েছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।’ মামাও প্রত্যুত্তরে লিখতেন, ‘স্নেহের রিমি, আমি দেশে আসার সময় তোমার জন্য ভালো ফলাফলের পুরস্কার হিসেবে একখানা হাতঘড়ি আনিব।’ আহা সে কী আনন্দ! এই সংবাদ স্কুলের সবাইকে গর্বের সঙ্গে জানাতে উদ্্গ্রীব হয়ে থাকতাম। কেননা, তাদের কারও মামা বিদেশে ছিল না।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমাদের একমাত্র বিনোদনের জায়গা ছিল গাঁয়ে নানা-দাদার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। সমবয়সী কাজিনদের সঙ্গে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, নানান ফল-ফুল-পাখি, পাখির বাসার সঙ্গে তখনই পরিচয় আমার। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা, পাখি শিকার করা, গাছ থেকে নারকেল, বরই, খেজুরের রস সংগ্রহ করাসহ কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হওয়া! সন্ধ্যার উঠোনে চাঁদের আলোয় লুকোচুরি খেলা, আকাশের তারা গোনা, কী দুর্দান্ত আনন্দের দিন ছিল। আমাদের আরেকটি বিনোদনের জায়গা ছিল রেডিও শোনা ও পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়ে মাসের কোনো একদিন অধীর হয়ে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখা। অন্য সময়গুলোতে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সংবাদ আর ছোটদের ‘এসো গান শিখি’ দেখার অনুমতি ছিল কেবল।
উৎসবের সময়গুলোতে ঢাকা থেকে আত্মীয়রা গ্রামে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে আমাদের মফস্বলের বাসায় দুদিন যাত্রাবিরতি করতেন। কেননা তখনকার সময়ে এখনকার মতো যাতায়াত-ব্যবস্থা এত সহজ ছিল না। বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছিল। পর্যায়ক্রমে নৌকা, ফেরি আর টেম্পো ছিল বাহন। সেই দিনগুলো ছিল সীমাহীন আনন্দের, উদ্্যাপনের। বাড়িভর্তি মেহমান। লেখাপড়ায় কড়াকড়ি নেই। শুধু খেলা, মজাদার খাবার খাওয়া, আর রাত জেগে বড়দের গল্প শোনা। স্বজনদের আদর, ভালোবাসায় মোড়ানো এক অপার ভালো লাগা দিন ছিল।
আমি যখন আমার সন্তানদের এসব ফেলে আসা দিনের গল্প বলি, তাদের কাছে তা রূপকথার গল্প মনে হয়। কেননা তাদের শৈশব-কৈশোর এতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। খুব ভোরে ঘুম থেকে তুলে তৈরি করে, সকালের খাবার খাইয়ে তবেই স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি। ফিরে এলে টেলিভিশনে কার্টুন দেখেছে। হোমওয়ার্ক করেছে। রাতে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ে শুনিয়েছি। শীতপ্রধান দেশ বলে বছরের অধিকাংশ সময়ই ঠান্ডা এবং দিন ছোট হওয়ায় এই নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। বছরের বাকি সময়টা বিকেলে পার্কে ছোটাছুটি খেলেছে। অর্থাৎ ইটপাথরের এই নগরের যান্ত্রিক জীবনে তাদের শৈশব, কৈশোর হারিয়ে গিয়েছে বলা চলে। তবু স্কুল থেকে প্রত্যেক অভিভাবককে উৎসাহিত করা হয় সন্তানদের প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে। স্কুল-ট্রিপে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যাওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। একবার আমাকেও সঙ্গে যেতে হয়েছিল সন্তানের আকুল আবদারে। সেই সুবাদে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের শিক্ষাপদ্ধতির আংশিক। কোনো একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে শিক্ষক। মুখোমুখি শিক্ষার্থীরা। তারপর তাদের চেনানো হয় কোনটি ম্যাপল, ওক কিংবা পাইনগাছ। হেমন্তে পাতার রং হলুদ-লাল-খয়েরি হয়ে ওঠার কারণ। কখনো-বা খুদে শিক্ষার্থীদের চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পশুপাখি দেখানো এবং চেনানোর উদ্দেশ্যে।
আমার প্রায়ই মনে হতো, এই যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমরা নানা-দাদার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি, বনে-বাদাড়ে ঘুরেছি কিংবা বাসায় প্রায় সারা বছরই অতিথি-স্বজনের সান্নিধ্যে একবুক আনন্দ নিয়ে বেড়ে উঠেছি; আমার সন্তানেরা ভিনদেশে হয়তো সেই পরিবেশ পাবে না। এসব দুঃখবোধ আর অপার বেদনা বুকের ভেতর জলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, আমার বেদনা বা হাহাকার কোনোটিই প্রবাসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমার সন্তানদের ছুঁতে পারেনি। যদিও আমরা বেড়ে উঠেছি দুটি ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সময়ে তবু এই জায়গাটিতে আমাদের দারুণ মিল। প্রায় সারা বছরই বাড়িতে মামা-খালা, চাচা-ফুপু পরিবেষ্টিত থাকছে তারা। তারাও আমার মতো স্থান সংকুলানের অভাবে মেঝেতে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত। আমার শৈশব-কৈশোরে যেমন আলাদা কোনো রুম ছিল না, তাদেরও নেই। অর্থাৎ সব রুম সবার। আমার বন্ধুরা বলে এটি একটি বিরল বিষয়। ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসরত আমার স্কুলজীবনের বন্ধু মাঝে মাঝেই ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ‘ছুটির দিনে শখ করে সন্তানদের জন্য পোলাও, কোরমাসহ নানান মুখরোচক পদ রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রাখি। কিন্তু দিন শেষে সেসব খাবার ফ্রিজে তুলে রাখতে হয়। কেননা, সন্তানেরা অনলাইনে তাদের পছন্দের খাবার অর্ডার করে খেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।’ এরপর কিছু সময় আমরা আমাদের শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিচারণা করে কাটিয়ে দিই। তখকার দিনে ছুটির দিনগুলোতে বাড়িতে পোলাও-মাংস রান্না হলে সেই ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। দিনটি ঈদের দিনের মতো মনে হতো। খেতে বসে মনে হতো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারটিই খাচ্ছি আমরা। এবার আসি বইপড়া প্রসঙ্গে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই আমি হয়তো পড়তে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছি। কিন্তু সন্তানদের সব রকম বই পড়তে আগ্রহী করে তুলতে আমার প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। তাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি ছুটতাম নিকটস্থ পাবলিক লাইব্রেরির উদ্দেশে। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে রংবেরঙের আকর্ষণীয় ছবিসংবলিত শিশুদের উপযোগী ফিকশন, নন-ফিকশন বই সংগ্রহ করতাম। অবসরে বা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তাদের সেই সব পড়ে শোনাতাম, যাতে তারা একাধারে জ্ঞানার্জন ও বইপড়া উপভোগ করতে পারে। কেননা, তাদের তো আর আমার মতো দাদি-নানির গা ঘেঁষে রূপকথার গল্প শোনার সুযোগ মেলেনি।
আমার সন্তানেরা পুকুরে লম্ফঝম্ফ দিয়ে, কলাগাছের ভেলায় চড়ে সাঁতার শেখেনি হয়তো। কিন্তু শিখেছে। অন্যভাবে। সুইমিং পুলে, চায়নিজ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কঠোর নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে। ওরা হয়তো পোনা, বাইলা, টেংরা মাছ চেনে না। কিন্তু স্যামন, শ্রিম্প, ক্যাটফিশ চেনে। তাদের হয়তো প্রকৃতির আলিঙ্গন, চোখেমুখে বাতাসের ঝাপটার অনুভূতি নেই। নেই আকাশ দেখার অসুখ, মাটির সংস্পর্শ, আবহমান বাংলার শৈশব-কৈশোর। তবু এই ভিনদেশে আমরা তাদের গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতে নিয়ে যাই বহুদূরের আমিষ ভিলেজে। যেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই, শহুরে যান্ত্রিকতা নেই। মোমবাতির আলোয় সন্ধ্যা নামে। শহর আর গ্রামের পার্থক্য বোঝাতে আমিষদের জীবনযাপন ব্যাখ্যা করি। তারা হয়তো জানে না কৃষ্ণচূড়া, হিজল কিংবা কদম, বেলি, শিউলি। কিন্তু ম্যাপল, ওক, পারসিমন, উইপিং উইলো সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানা-দাদার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়তো আমার সন্তানেরা পায়নি। কিন্তু প্রতি ছুটিতে, গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনে পরিবারের সঙ্গে কদিনের জন্য পাহাড়, অরণ্য কিংবা সমুদ্রের ধারে সময় কাটায়। তাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়কাল শৈশব-কৈশোরকে সুন্দর ও স্মৃতিময় করে তুলতে আমাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা থাকে। তবু এত কিছুর পরও আমাদের সময়ের পারিবারিক বন্ধন তাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে কি? এটি একটি ভাবনার বিষয়। সত্যি বলতে কি, আমাদের সন্তানদের জীবনবোধে গভীরভাবে শেকড় গেড়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, যা অজগরের মতো গিলে খেয়েছে তাদের মূল্যবান সময়কাল।
আসলে দুটি ভিন্ন সময়ে বেড়ে ওঠা আমাদের দুই প্রজন্মের সবকিছুতেই বিস্তর ফারাক। আমাদের দর্শন ভিন্ন। চিন্তা, চেতনা, জানা, সবই ভিন্ন। আমরা অতীত আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসি। নতুনকে সহজভাবে নিতে চাই না। তবু আমাদের মেনে নিতে হয়, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পৃথিবীতে পরিবর্তন হচ্ছে, হবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। Ñনিউইয়র্ক
কমেন্ট বক্স