Thikana News
০১ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

ঠিকানা : আমার আনন্দ আশ্রম

ঠিকানা : আমার আনন্দ আশ্রম



 
 ১৯৯৫ থেকে ২০২৫। মাঝখানে ৩ বছর বাদ। ২৭ বছর ঠিকানার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে আমার শাশুড়ি-মা বলেছিলেন, ‘বাবা ফজলু, তুমি যে দেশে যাচ্ছ, সে দেশে যদি এখানকার মতো কোনো চাকরি পাও, তবে তুমি সেটাই করো।’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশে যেরকম সাংবাদিকতা করতে, ও দেশেও পারলে সাংবাদিকতাই করো।’ তিনিই ছিলেন সে সময় আমার একমাত্র মুরব্বি। শৈশবে মাতৃহারা হওয়ায় বিয়ের পর তিনি আমাকে মাতৃস্নেহ দিয়ে এসেছিলেন। যখন এ দেশে আসব বলে নিশ্চিত হই, তখন থেকেই ভাবনায় ছিল কলম আর ধরব না। কিন্তু মুরব্বির দোয়া বুঝি কবুল হয়ে যায়। তাই ইচ্ছা না থাকুকÑএ দেশে আসার পর এটা-ওটা করার একপর্যায়ে ঠিকানাতেই প্রথম আমি সাংবাদিকতা করার প্রস্তাব পাই। তখন পারিশ্রমিকের কথা না ভেবে যোগ দিয়ে ফেলি ঠিকানায়। অর্থের কথা মনে আসে না।
ঠিকানায় কীভাবে প্রস্তাব পাই, তার একটা ছোট্ট প্রেক্ষাপট আছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পা রাখি লস অ্যাঞ্জেলেসে, তারপর আসি নিউইয়র্কে। নিউইয়র্কে তখন সবকিছুই অচেনা। মালেককে জানতাম ঢাকা থেকেই। মালেক ঠিকানায় কাজ করেন, তাও জানতাম। নিউইয়র্কে আসার পরদিনই ছেলেকে নিয়ে যাই ঠিকানা অফিসে। আমাকে রেখে ছেলে ফিরে যায়। আমি মালেকের সঙ্গে গল্প করতে থাকি। ওঠার কথা বলতেই মালেক বলেন, ‘বসেন, গল্প করি। বিকেলে ব্রুকলিনে একটি বই নিয়ে আলোচনা আছে, সেখানে যাব। আপনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে। আপনাকে আমরাই দায়িত্ব নিয়ে পৌঁছে দেব। অনেকের সঙ্গে আলাপ হবে। আপনার ভালো লাগবে।’ একপর্যায়ে তখন ঠিকানার সম্পাদক এবং মালিকও সাঈদ-উর-রবের সঙ্গে আলাপ হয়। চমৎকার একজন মানুষ মনে হয়।

ব্রুকলিনে যে বাসায় গেলাম, সেটা বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মোজাম্মেল হোসেন মিন্টুর বাড়ি। তারই লেখা একটি উপন্যাস নিয়ে আলোচনার আয়োজন। স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকসহ সাহিত্যানুরাগী অনেক সুশীল মানুষের সমাবেশ। আলোচনা বেশ রাত পর্যন্ত চলল। সেখানে আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিয়ে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারপর খাওয়াদাওয়া শেষে বাসায় ফেরা। এরপর নিউইয়র্ক কিছুটা চেনা হয়ে যায়। নিউইয়র্কে চলাফেরার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাবওয়েতে যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করি। মোটামুটি আয়ত্তে এসে যায়। নিজে নিজে অনেকটাই চলতে পারি।
একদিন হঠাৎ মালেকের ফোন- দেখা করি যেন, কথা আছে আমার সঙ্গে! কী কথা! বুঝে উঠতে পারি না। যা-ই হোক, পরের দিন ঠিকানা অফিসে যাই। মালেক আমাকে অফিসের সামনের পার্কে নিয়ে আসেন। আমাকে প্রস্তাব দেন, আমি ঠিকানায় কাজ করব কি না? আমি প্রথমে হতবাক! কিছুটা স্থির হয়ে বলি, কাল জানাব। বাসায় ফিরে রাতে ঢাকায় ফোন করে বলি ঠিকানার প্রস্তাবের কথা। শাশুড়ি-মা তো বেজায় খুশি। হাসি নিজে দায়িত্ব না নিয়ে আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার যেটা ভালো মনে হয়, সেটাই করো।’ কিন্তু ওর কণ্ঠেও কেমন যেন একটা সম্মতির আভাস মেলে। আমি পরদিন মালেককে আমার সম্মতির কথা জানিয়ে দিই।
সেই সময়টা ঠিকানার জন্যও একটি ক্রান্তিকাল। একসঙ্গে তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, কম্পিউটার-প্রধান ঠিকানা ছেড়ে চলে যাবেন। অনেকেই এটাকে সে সময়ে ঠিকানার বিরুদ্ধে বড় একটা চক্রান্ত বলে মনে করতে শুরু করেছেন। মালেকের অনুরোধে ক’দিন আগে থেকেই ঠিকানায় যেতে শুরু করি-মাহবুবুর রহমানের কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে। ক’দিন যেতে না যেতেই তারা ঠিকানা ছেড়ে দিয়ে নতুন আরেকটি পত্রিকা প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে যান। আমি তখন ঠিকানার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি।
এরপর ইতিহাস এগোতে থাকে। ঠিকানা এবং আমার উভয়েরই বয়স বাড়তে থাকে। এর মধ্যে আটলান্টিক দিয়ে কত পানি গড়িয়ে যায়। ঠিকানায় কাজ করার সুবাদেই প্রবাস-জীবনে আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডার স্ফীত হতে থাকে। মানুষের কত রূপÑতাও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ঠিকানার কল্যাণে। জীবনের এই সন্ধ্যাবেলাতে ঠিকানায় যেতে পারছি, সেটাও কম আনন্দের নয়। কত চড়াই-উতরাই পার হয়ে শত্রু-মিত্র চিনতে চিনতে আজ ৩৬ বছরে পা রাখছে ঠিকানা। ঠিকানার মিত্ররা চিহ্নিত। শত্রুরা মনে হয় ক্লান্ত। ঠিকানার জানালা দিয়ে কত বিচিত্র কিছু দেখলাম। আজকের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভক্ষণে অশুভ কোনো কিছু মনে আনতে চাই না।
ঠিকানায় ক’দিন গেলাম, না গেলাম, বড় কথা সেটা নয়। বড় এই পশ্চিমে হেলে পড়া জীবনেও যে ঠিকানার সঙ্গে আছি, আমার কাছে সেটা অনেক বড় কিছু। ঠিকানায় কেন কাজ করি, তা নিয়ে কত রকম কথা, কত সমালোচনা। ছেড়ে দিয়ে বেকারত্বের কাতারে যদি দাঁড়াইÑসেটা দেখতেও অনেকের অনেক সুখ থাকতে পারে। কিন্তু আমার শুভাকাক্সক্ষী, শুভার্থীরা আমাকে এখনো তাদের আদরের ছায়ায় রেখেছেন। যা আমাকে শক্তি জোগায়, সাহস জোগায়। এখনো যখন ঠিকানায় যাইÑতখন মনে হয়, এই তো আমার আনন্দ আশ্রম। ঠিকানায় যখন যাই, তখন সবাই পরম যত্নে আমাকে স্বাগত জানায়। মনে হয়, আমার স্বজন সবাই। কেউ বড় ভাই, কেউ ছোট, পরম স্নেহের, আদরের। ঠিকানার সৌন্দর্য তার কর্ম-পরিবেশে। নিজের আদর্শ, দর্শন ঠিক রেখেও কাজ করা যায়। কাজের জন্য সেটা খুব বড় সহায়ক।
একটা কথা আমরা শত সমালোচনার পরেও যদি মনে রাখিÑঠিকানা একুশের জাতক। যারা একুশের অঙ্গীকারে অটল, তারা এখনো অজেয় এবং অটুট সামনে চলার পথে। ঠিকানার ঈর্ষণীয় সাফল্যও তার একুশের শিক্ষার ফসল। একুশ আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে অটুট অনাপসী। ঠিকানা সে পথেই চলছে শত সীমাবদ্ধতা নিয়েও। তাই তো ঠিকানা মানুষের ভালোবাসা, আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না।
কিন্তু আজকের সময়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে যে গণধারণা, তাতে সাংবাদিকতা নিয়ে শ্লাঘাবোধ করার চেয়ে কষ্টবোধই বেশি হয়। যখন অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে সাংবাদিকতায় আসি, তখন পেশা নিয়ে যে অহংবোধ ছিল, এখন আর সেটা এত হয় না। এখন তোষামোদি করে সিদ্ধিলাভের কথা শোনা যায়। এও শোনা যায়, তোষামোদি এমন এক পর্যায়ে চলে যায়, সরকার পতনের পর কিছু সাংবাদিককেও পালিয়ে যেতে হয়। এ যেমন কষ্টের, তেমনি লজ্জারও। প্রবাসেও অনেক রকম কথা শোনা যায়, যা মোটেও কাক্সিক্ষত নয়। ‘টেক কেয়ারের’ কালচার থেকে আমরা যেন বের হয়ে আসতে পারি।
ঠিকানার প্রতিষ্ঠাকালের এই শুভক্ষণে আমাদের প্রার্থনা হোক, আমরা সবাই মিলে পেশার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কাজ করি। হারানো গৌরব ফিরে পেতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। শেষ করি এ কথা স্বীকার করে, ঠিকানার কাছে, কমিউনিটির কাছে আমার অনেক ঋণ। এ ঋণ পরিশোধ করার সাধ্য আমার নেই। আর সব ঋণ শোধ করাও যায় না। ভালো-মন্দ নিয়ে সবাই আমরা ভালো থাকার চেষ্টা করি। ঠিকানা দীর্ঘজীবী হোক। ঠিকানার সব সহকর্মীকে শুভেচ্ছা। তাদের সহযোগিতা না পেলে আমার কাজ করা হয়তো হতনা। প্রবাস-স্বদেশের সবাইকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির শুভেচ্ছা-ভালোবাসা। স্বাগত ঠিকানা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা।
 
 
কমেন্ট বক্স