চেতনা হচ্ছে কোনো কিছু স্পর্শ করা কিংবা কারও প্রভাবে সাড়া দেওয়ার শক্তি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, অনুভূতি-উপলব্ধি, আবেগ-উত্তেজনা, আশা-আকাক্সক্ষা, চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। চেতনার বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আত্মসচেতনতা ও একধরনের আত্মবিশ্বাস ও অনুভূতিশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যার প্রভাবে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং পৃথিবীর পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেকে জাগ্রত রাখা যায়, যাতে মানুষ ও সমাজের কল্যাণে পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হয়।
প্লেটো অবশ্য চেতনাকে বুদ্ধি ও জ্ঞান লাভের উপায় হিসেবে দেখিয়েছেন। চোখে দেখে, কানে শুনে এবং পঞ্চেন্দ্রিয়ের অনুভূতির মাধ্যমে আস্বাদন করে, আমরা যেভাবে জ্ঞান অর্জন করি সেটিকে একটা সাধারণ ধারণা লাভের উপায় হিসেবে তিনি অসম্পূর্ণ মনে করছেন। কার্ল মার্ক্সের থিওরিতে চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে বাংলা ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহান ভাষা আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। তার মধ্য দিয়ে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার মূলেও ছিল চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কাছে জোরালো দাবি পেশ করার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন ক্ষিপ্রতর হয়ে ওঠে। তার পরবর্তী সময়গুলোতে কী পরিমাণ নিপীড়ন চলেছে এবং বাংলা ভাষার স্বাধিকারের দাবিতে আমাদের গর্বিত সূর্যসন্তানদের শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে এক অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে।

একুশের চেতনা ধারণ করেই বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সকল অত্যাচার আর শোষণের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ও প্রেরণা জোগায়। একুশের চেতনা আমরা মনেপ্রাণে ধারণ করি বলেই বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার পরিচিতি-মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলা পৃথিবীর অন্যতম পঞ্চম ভাষার একটি।
বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায়জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ ফাল্গুনের একটি শীতকালীন ফাগুনঝরা দিন। মায়ের মুখের ভাষার স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলার কয়েকজন সূর্যসন্তান তাদের বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তার নজির বিশ্বের ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। অমর একুশে তাই আমাদের জাতীয় জীবনে বেদনাবিধুর এক গৌরবগাথা উপহার। জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে এই দিনটির তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিনেই আমাদের সূর্যসন্তানদের তাজা রক্ত ঝরিয়ে অর্জিত হয়েছে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার।
বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিবসে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালোবাসার প্রেরণা রয়েছে, তেমনি অন্যান্য জাতির মাতৃভাষাকেও সমানভাবে মর্যাদা প্রদান করার শিক্ষা পাওয়া যায়।
আমরা জানি, একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করে না, শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন ও চর্চার মাধ্যমে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের আরও বেশি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা জাগ্রত করার পথ সুগম করে তুলবে। পৃথিবীর সব জাতির ভাষার প্রতি যেমন অন্যের শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে, তেমনি প্রতিটি ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীরও তাদের ভাষার উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্প্রসারণ এবং ভাষার অধিকার আদায়ের বলিষ্ঠ সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। একুশের চেতনায় যেমন বাংলা ভাষার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের পথ সম্প্রসারিত হয়েছে। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই মহান ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রাম বেগবান হয়।
বাংলা ভাষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষার উন্নয়ন এবং বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটানো। যার ফলে বাংলা ভাষার প্রচলন বাড়বে, সর্বপ্রকার সাহিত্যের পথ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রসমূহ ক্রমাগত উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ পাবে। আনন্দের বিষয়, বর্তমানে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, দেশে-বিদেশে অবস্থানরত সবাই আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের পথ সুগম করবেন।
একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। একইভাবে চব্বিশের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের নেপথ্যে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হয়েছে। দেশের জনগণ স্বৈরাচারী অপশক্তির বিরুদ্ধে সব সময় যেভাবে তৎপর ছিল, তেমনি আগামীতেও আত্মসচেতন হয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার এবং দেশের শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন বলে সকলের প্রত্যাশা। অতীতের বিভিন্ন সফল আন্দোলন ও সংগ্রামের পথে একুশের চেতনায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
মহান ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্প্রসারণ ঘটেছে।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এই পেশায় জড়িত থাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সত্যনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতার নিরিখে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। যেকোনো ঘটনাপ্রবাহের সঠিক তথ্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করাই হচ্ছে সাংবাদিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। সত্যের বিপরীতে মিথ্যা কিংবা কোনো অসত্য খবরকে বাড়িয়ে-কমিয়ে, রস মাখিয়ে কেউ কেউ সংবাদ পরিবেশন করে থাকেন! সাংবাদিকতায় সেটি গর্হিত কাজ এবং সেটিকে হলুদ সাংবাদিকতা কিংবা অপসাংবাদিকতা বলা হয়ে থাকে। সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট হয়ে প্রকৃত ঘটনার পরিবর্তে মিথ্যা ও বিকৃত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে একজন নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সত্যিকারের সাংবাদিককে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। প্রকৃত ঘটনার বিপরীতে যেকোনো প্রভাবশালী কর্তৃক মিথ্যা খবরটিকে সত্য হিসেবে প্রকাশ করার যেকোনো প্রয়াসই অপসাংবাদিকতা।
বর্তমান বিশ্বে সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করা কঠিন, কণ্টকাকীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যেও সাংবাদিককে অনেক কঠিন ও দুর্বোধ্য পথ অতিক্রম করতে হয়। এমনকি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকগণ তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং একই সঙ্গে মিডিয়ার মালিকদের চাপিয়ে দেওয়া প্রভাবও অনেক সময় সত্যনিষ্ঠ খবর পরিবেশন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে নিরপেক্ষ থাকার উপায় থাকে না। বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করার ঝুঁকির মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা বিশ্বের অন্যতম মহান পেশারূপে স্বীকৃত। সত্যের পরিবর্তে মিথ্যার দৌরাত্ম্য গোটা পৃথিবীতে। বর্তমান বিশ্বে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের সঠিক পরিবেশন করা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ। সত্য খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়কে সাংবাদিকদের গুরুত্ব দিতে হয়Ñনিরপেক্ষতা, সাহসিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা, সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে নিঃস্বার্থভাবে সংবাদ পরিবেশন করা। শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ রক্ষা করা। বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজ পেশার দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ও সুদৃঢ় থাকা।
পৃথিবীতে তথ্য মিডিয়া এবং সংবাদপত্রের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তেমনি বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্প্রসারণে বাংলা সংবাদপত্রের ভূমিকা বিদ্যমান। প্রবাসে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ অনেক ভালো। প্রবাসে কমিউনিটি-ভিত্তিক পত্রপত্রিকা স্বল্প পরিসরে হলেও এসব দেশে সাংবাদিকতায় তেমন ঝুঁকি নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনবহুল শহর নিউইয়র্কে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র রয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও কয়েকটি টেলিভিশন ও অনলাইন পত্রিকায় অনেক সাংবাদিক যুক্ত রয়েছেন। এতে যেমন তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজনের মাঝে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’। প্রবাসে এই পত্রিকাটির যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা, সুনাম ও ঐতিহ্য রয়েছে। মহান ভাষাশহীদদের প্রতি সম্মান রেখে মহান একুশের চেতনায় ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেওয়া ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ সেই শুরু থেকেই প্রবাসে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে ‘ঠিকানা’ ৩৬-এ পা দিয়েছে। অফসেটে ছাপানো সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’ নিউইয়র্কে সর্বাধিক প্রচারিত বহুল জনপ্রিয় পত্রিকা। বাংলা ভাষার জাগরণে ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ বিরাট ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে ঠিকানার অনলাইন ভার্সনের কাজটিও বেশ স্বচ্ছ-নিখুঁত ও তথ্যসমৃদ্ধ। অনলাইন ভার্সনে নিউজ প্রকাশের ফলে দেশে-বিদেশে সাপ্তাহিক ঠিকানার পাঠক ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। সেটি অবশ্যই সবার জন্য আনন্দের বিষয়।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সাংবাদিকতা পেশা আজও দেশের সিংহভাগ জনশক্তির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি। এ জন্য সাংবাদিকতা পেশাকে প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সাংবাদিকতার পরিচয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত মেধাহীনতা ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রদর্শন করা হয়। অনেকে আবার প্রশিক্ষণ ছাড়াই সাংবাদিকতায় পেশায় যুক্ত হন।
বাংলাদেশের মিডিয়া প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে প্রতাপশালী ব্যক্তি মালিক দ্বারা। তাদের প্রধান শক্তির উৎস হচ্ছে অর্থবিত্ত এবং সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা। তাদের অর্থবিত্তের আয়ের উৎস কতটা বিশাল (?), তা অনেকেরই জ্ঞানের বাইরে। মালিকপক্ষের বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রভাবে নিজেদের স্বার্থের বাইরে সত্য খবর পরিবেশনে বাধাগ্রস্ত হয়। এই সুবিধাভোগী চক্রটির অনেকেই সরকারের লেজুড়ভিত্তিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন এবং সরকারের গুণগ্রাহীর ভূমিকা পালন করেন। তারা কখনোই সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক খবর প্রচার করেন না! সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পথে এ ধরনের হীনম্মন্যতামূলক সাংবাদিকতা অনভিপ্রেত। আসলে যারা বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের মধে্যও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা পেশায় টিকে থাকেন এবং সঠিকভাবে সংবাদ পরিবেশন করেন এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকেন, তারাই শ্রেষ্ঠ মানুষ।
আশার দিক হচ্ছে, পৃথিবীতে বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হয়নি এবং কখনো রুদ্ধ হবে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমানে যোগ্য ও সৎ-সাহসী সাংবাদিকের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। তবু অনেক সত্যাশ্রয়ী সাংবাদিক জীবনবাজি রেখে এবং মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতায় সাহসী ভূমিকা রাখেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়-অনাচারের সঠিক ঘটনা প্রকাশের মাধ্যমে মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করেন।
বিশ্বের অনেক দেশে সত্য-সঠিক সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বহু সাংবাদিক জেল-জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন। অনেকে গুলি, বোমা হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীতে এমন ঘটনা অনেক এবং সর্বদাই নির্যাতন, নিপীড়ন ও বর্বরতার সম্মুখীন হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা না থাকলে এবং অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করতে পারলে রাষ্ট্র ও সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। বস্তুনিষ্ঠতা অর্থ সত্যিকার যা ঘটেছে, তা-ই অকপটে প্রকাশ করা। সত্যকে সত্য বলা এবং মিথ্যাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা। অর্থাৎ কোনো ঘটনা অথবা কোনো বিষয়কে বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে না বলা। রিপোর্টারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যা-ই থাকুক না কেন, কোনো রিপোর্টে নিজস্ব মনগড়া মন্তব্য থাকবে না। বস্তুনিষ্ঠতা মানে কোনো বিশেষ দল-মত কিংবা লোভ-লালসা ও সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।
তবে কালের বিবর্তনে বর্তমান বিশ্বে খবরের সবকিছুকেই সত্য বলা যাবে না। অনেক খবরের কিছু সত্য কিছু মিথ্যার উপাত্তসহ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে মিডিয়ায় অনেক খবর পরিবেশিত হয়ে থাকে। ফলে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই বিশ্বের অনেক দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সংবাদপত্রসমূহ সগৌরবে প্রকাশিত হচ্ছে। আবার অনেক ফ্যাসিস্ট, একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও স্বৈরশাসিত রাষ্ট্রের সঠিক খবর পরিবেশন করা কঠিন এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অনেক একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে নামমাত্র। মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসক এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এবং ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রকৃত ঘটনা সঠিকভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নেই। সেখানে সাংবাদিকতা করা অর্থ জীবনের ঝুঁকিতে পড়া। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সঠিক খবর পরিবেশন করার ফলে যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের অনেক সাংবাদিকের প্রাণহানি ঘটেছে। বিগত দিনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের খবর পরিবেশন এবং ইসরায়েলি গণহত্যার সঠিক তথ্য প্রদানের অপরাধে ইসরায়েলি সৈন্যদের বর্বরোচিত বোমা হামলায় রয়টার্স, বিবিসি, এএফফি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার অর্ধশতাধিক সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন মিডিয়ার দুই শতাধিক সাংবাদিকের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া খোদ ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও সঠিক সংবাদ পরিবেশনের কারণে কয়েকজন সাংবাদিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেই নয়, ইসরায়েলের সোশ্যাল মিডিয়ার ওপরও সংশ্লিষ্ট দেশের গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই সব নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করা হয়।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন সরকারের আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রতি অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে। বিগত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে অনেক সাংবাদিক সঠিক সাংবাদিকতা করতে গিয়ে মামলা-হামলা ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। অনেকে প্রতিহিংসায় নাজেহাল এবং নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন! অনেককেই আয়না ঘরের মতো বন্দিশালায় ভয়াবহ অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করা হতো! যদিও দেশের সুবিধাভোগী স্বার্থান্ধ মালিক কর্তৃক পরিচালিত ও সরকার-নিয়ন্ত্রিত বেশ কিছু সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চালু রেখে সরকারি গুণকীর্তন করার ব্যবস্থাও বিদ্যমান ছিল।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাংবাদিকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রবাসে অবস্থানরত অনেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সংবাদমাধ্যমে অপরিসীম অবদান রেখে চলেছেন।
এই বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করেই ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ প্রবাসে সংবাদ পরিবেশনে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, বাংলা সাহিত্য ও ভাষার উৎকর্ষ এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে পত্রিকাটি বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। এখানে সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকা সুদৃঢ় অবস্থান সৃষ্টির পেছনে বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি তাদের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সেটিকে পুরোপুরি রক্ষা করার জন্য তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও সঠিক খবরাখবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’র পাঠকপ্রিয়তা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ ও প্রবাসের মানুষের সাম্য-মৈত্রীর সঙ্গে সেতুবন্ধ জোরদার করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে।
একসময় নিউইয়র্কে বাংলা ভাষায় কথা বলার মানুষ ছিল খুব কম। পত্রপত্রিকাও তেমন ছিল না। বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য ব্যাকুলভাবে বাংলাভাষীদের খুঁজতে হতো। বর্তমানে সে রকম নয়। সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বাংলাদেশি। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রবাসে সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ একটি মাইলফলক এবং ইতিহাসের অংশ। হাজারো সংকট ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘ঠিকানা’ উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্কে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা রক্ষা করছে এবং পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে চলেছে। সাংবাদিকতায় ‘ঠিকানা’র অগ্রগতি ও বলিষ্ঠ ভূমিকার বিষয়টি অবশ্যই সবার জন্য আনন্দের এবং গৌরবের। কোনো তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি হচ্ছে তার পাঠক। পাঠকসংখ্যার ওপরই একটি পত্রিকার জনপ্রিয়তা ও সার্থকতা পরিমাপ করা সহজ হয়। সেই হিসেবে প্রবাসে ‘ঠিকানা’ পত্রিকার জনপ্রিয়তা শীর্ষে রয়েছে।
একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে, সেটি অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে। একুশের চেতনায় বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতায় সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’র অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঠিকানার প্রতি ভালোবাসা এবং অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট