বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঙালির জীবনে মার্চ একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় মাস। বাঙালির বীরত্বগাথার মাস, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার মাস। এই মাস বাঙালির জীবনসত্ত্বা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের মাস। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণ, বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণার মাস।
স্বাধীনতার প্রতি আকাক্সক্ষা মানুষের সহজাত এশটি প্রবৃত্তি হলেও এই স্বাধীনতার স্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম শত শত বছর ধরে। প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের আগেও আমরা বাঙালিরা স্বাধীন ছিলাম না। আমাদের একসময়ের শাসক বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবেরা বাঙালি ছিলেন না। তবে এটা সত্য যে, এসব শাসকরা বাঙালি না হলেও তারা বংশপরম্পরায় এ দেশে বাস করে এদেশের ভূমিপুত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের এ দেশেই জন্ম, এ দেশেই বেড়ে ওঠা, এদেশেই মৃত্যু। উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রায় দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে পরাধীনতা মুক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গ মিলিয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রে আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম, তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচার, বৈষম্য-বঞ্চনার কারণে পরাধীনতার শামিল ছিল- তা ছিল দুঃখজনক এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে স্থানান্তরের মতো। ১৯৪৭ সালে আমরা যে তথাকথিত স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম, তা ছিল গান্ধী-প্যাটেল-নেহেরু এবং সহযোগী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র ধর্ম ও জাতিকে একাকার করে দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক অবাস্তব চিন্তার ফসল। আমি বিনয়ের সাথে বলবো, এই মহান নেতাদের মাথায় ঢোকেনি মুসলমান কোনো জাতি নয়, একটা সম্প্রদায়। বাঙালি একটা জাতি। তাছাড়া লাহোর প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল- ভারতবর্ষ বিভক্তিতে একদিকে ‘ভারত’ নামে একটি রাষ্ট্র, অন্যদিকে ‘বঙ্গস্থান’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি রাষ্ট্র। জিন্নাহ কারসাজি করে ‘বঙ্গস্থান’ বাদ দিয়ে ইংরেজদের থেকে একক পাকিস্তান গঠন করে নিয়েছিলেন। ফলত দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক অবাস্তব পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যের শিকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গ কালক্রমে স্বাভাবিকভাবে আলাদা হয়ে যায় এবং বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়, যা লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবমুখী ‘বঙ্গস্থান’ বাস্তবায়নের রূপায়ণ বলেই ধরে নেয়া যায়।
পরম পরিতাপের বিষয়, কেউই মহান ভাষা আন্দোলনে বুকের তাজা রক্তে প্রাণ বিসর্জনে জাতীয় আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার চেতনা এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ প্রাণ উৎসর্গ, আত্মবিসর্জন, আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণে দেশ শাসন করেননি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ব পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দল বা সরকারই ক্ষমতায় এসেছিল, সব সরকারই এক কেন্দ্রিক ও জবাবদিহিতার বাইরে। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল ক্ষমতার লোভ, প্রতিহিংসার রাজনীতি, নীতিহীন রাজনীতি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ৫৩ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলÑ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে। ২০০৮ সাল, ২০১৩ সাল, ২০১৮ সাল এবং ২০২৪ সালের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পর পর প্রশ্নবিদ্ধ জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটানা ১৫ বছরেরও অধিককাল ক্ষমতায় থাকে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং দুর্নীতি দমণের নামে মুখে মুখে শুদ্ধি অভিযানের কথা বলে বাস্তবে স্বজনপ্রীতি ও নিজে দুর্নীতি করে এবং প্রভাবশালীদেরও দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়। শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মাত্রা বিবেচনায় তাকে ‘লেডি হিটলার’ বলা অত্যুক্তি হবে না।
শেখ হাসিনার আমলের সরকারি সিদ্ধান্তে চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও উত্তরসূরীদের জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকায় চাকরিপ্রার্থী যুবসমাজ বৈষম্যের শিকার হয় এবং শিক্ষার শেষে অনেক মেধাবীও চাকরি বঞ্চিত হয়। এ কারণে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চাকরিতে কোটা বৈষম্যের আন্দোলনে সোচ্চার হয় শিক্ষার্থীরা। আপিল বিভাগের সংশোধিত আদেশে চাকরির কোটায় শিক্ষার্থীদের কিছুটা সুবিধা দেয়া হলেও তা কার্যকর করতে শেখ হাসিনার সরকার গড়িমসি শুরু করে এবং দমননীতির আশ্রয় নিয়ে নৃশংসভাবে অসংখ্য ছাত্র হত্যা করে। এতে শিক্ষার্থীরা কোটা বৈষম্য আন্দোলনে কঠোরভাবে ফেটে পড়ে। শেখ হাসিনার শাসনামলে তার প্রধানমন্ত্রীত্বে এক ব্যক্তি তার আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, মোসাহেব ও লাঠিয়ালদের নিয়েই দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ বঞ্চনার শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু প্রকাশের সাহস পাচ্ছিল না। এ অবস্থায় চাকরিতে কোটা বৈষম্যের আন্দোলনে সোচ্চার শিক্ষার্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে সাধারণ জনগণ ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায় এবং আন্দোলন জোরদার করে। শেষ অবধি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন, পদত্যাগ ও দেশত্যাগ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। তারপর দেশ শাসনে অন্তর্বর্তীকালের সরকার গঠিত হয়। নির্বাচন কমিশনসহ সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের জনদরদী, পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সাপেক্ষে। অতীতে দীর্ঘদিন বাংলাদেশের নির্বাচন হয়েছে। অকার্যকর নির্বাচনী ব্যবস্থায় অবৈধভাবে কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার ও জেতার জন্য পক্ষপাতপুষ্ট নির্বাচন কমিশনের সহায়তায়। জনগণ আশা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করে জনগণের আস্থা অর্জন করবে।
গরিব জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে সমাজে ধনীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বার্থরক্ষা করে অতীতের দুঃশাসন আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে বড় অন্তরায় বিবেচিত। তাই অর্থনৈতিক অবৈধ উপায়, ঘুষ, লুটতরাজ, দুর্নীতিসহ রাজনৈতিক অপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যারা রাতারাতি ধনী ও বড়লোক হয়, তাদের লাগাম টেনে ধরার সময় এসেছে। তাদের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। এভাবে দেশ চালাতে অপশাসন শুরু হয়, ক্ষমতা ও অর্থের অপব্যবহার হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নিয়ে দেশের গণতন্ত্রের ভিত ভেঙে পড়ে। এমতাবস্থায় শ্রেণি-বৈষম্য দূর করার মানসে গরিবের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে গুরুত্বারোপ করে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করতে দেশপ্রেমিক. সৎ, গুণী, ন্যায়নিষ্ঠ ও জনদরদী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ চায় ধনী-গরিব বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণে দেশ পরিচালিত হোক।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচনের পর আকাক্সিক্ষত পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক দলের সরকারের কাছে জনগণের এই প্রত্যাশা। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও অধিকারহারা মানুষ এখন একটি স্বাধীন, নিরাপদ ও মর্যাদার জীবনের প্রত্যাশায় উন্মুখ। এ অবস্থায় যে গণতান্ত্রিক সরকার এখন ক্ষমতায় আসে তাদেরকে জন-প্রত্যাশা পূরণের জন্য একটি নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পতিত স্বৈরশাসক পেছন থেকে বাংলাদেশেকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পদত্যাগী, দেশত্যাগী ও তাদের নতজানু সরকারের শেখ হাসিনাকে ভারত রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সাথে বৈরী আচরণ শুরু করেছে এবং আধিপত্য বিস্তার ও বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ভারতীয় গণমাধ্যমসহ অন্য কিছু দেশের গণমাধ্যম, সংস্থা ও ব্যক্তি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে জাতীয় ঐক্য বিশেষ জরুরী। দলমত নির্বিশেষে মতভেদ ভুলে গিয়ে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে ভারতের বা অন্য কোন মহলের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট।