বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্মব্যস্ত চার দিনের সফরে। এ সময়টাতেই প্রতিবেশী দেশ ভারত ঘর্মাক্ত দিল্লিতে দুদিনের ন্যাশনাল কনফারেন্সে। বিষয় ‘ইম্পলিকেশন অব দ্য পলিটিক্যাল টার্মোয়েল ইন বাংলাদেশ’। শিরোনামেই পরিষ্কার বাংলাদেশকে কোন চশমায় দেখছে ভারত। এখানে ‘রাজনৈতিক গোলযোগ’ দেখছে তারা। গোলযোগ বাংলাদেশে, আর এর তাৎপর্য নিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স আয়োজন ভারতের। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো এবং এর ব্যবচ্ছেদ ভারতীয়দের কাছে তাদের ঘরোয়া ব্যাপার। আর বাংলাদেশ-বিষয়ক এই কনফারেন্সের সময়টা নির্ধারণ করা হয়েছে ঠিক ড. ইউনূসের চীন সফরের সময়সূচির সঙ্গে মিলিয়ে।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক যে ভাবনা-তাড়না, নিজ দেশ নিয়েও ততটা নয়। ১৪, ১৮, ২৪ মিলিয়ে বাংলাদেশের গত তিনটি নির্বাচন নিয়ে ইনক্লুসিভের কথা ভাবেনি। এবার ভাবছে শোনাচ্ছে। গেলাচ্ছেও। কথার বাহারও আহামরি। বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী জনরোষ সম্পর্কে ভারত জানত, কিন্তু ওই পর্যায়ে আর করার কিছু ছিল না- এমন মন্তব্য করে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আরেক রাজনীতি-কূটনীতি চালিয়েছেন। নিজ দেশের পার্লামেন্ট সদস্যদের আরও বলেন, শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকায় তাকে শুধু ‘পরামর্শ’ দেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করার পরিস্থিতিতে ভারত ছিল না।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্কের সাম্প্রতিক মন্তব্যের কথা উল্লেখ করেন তিনি। জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেওয়ায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে উত্তেজনা রয়ে গেছে। সংসদে কয়েকজন সদস্য ‘বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায়’ উদ্বেগ জানান। এসব ঘটনায় ভারত কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চান তারা। জবাবে জয়শঙ্কর জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাগুলোর কারণ রাজনৈতিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হওয়ায় নয়। এখন এভাবে বলা ছাড়া গতিও নেই জয়শঙ্করসহ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের।
২০১৪ এর নির্বাচনের আগে জয়শঙ্করের পূর্বসূরি শ্রী সুজাতা সিংকে দিয়ে শুরু করে ১০ বছরে যা যা করা হয়েছে, সেগুলো শুধু পরামর্শ ছিল না। ছিল সরাসরি হস্তক্ষেপ। পরিণতি হিসেবে এখন কিছুটা হলেও ধুঁকতে হচ্ছে। বাংলাদেশে দেখছে ভারতবিরোধী মালদ্বীপ সিনড্রম। তা রুখতে মন্ত্র, পথ্য, দাওয়াই ছাড়ছে একের পর এক। টুকটাক সাফল্যও দেখছে। ঐক্যের বাঁধনে এরই মধ্যে কূটকচালি ফাটল ধরাতে পেরেছে। চব্বিশের গণ-আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারদের বিভেদে ফেলতে পেরেছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ফ্রন্টলাইনার ছাত্রদের নতুন সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) গোলমাল এবং দলটির নেতাকর্মীদের মাঠে-ঘাটে মার খাওয়ানোর আয়োজনও ব্যাপক। সেই সঙ্গে জমাতে পেরেছে গুজবের হাট। বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি, শেখ হাসিনার রাতের মধ্যে চলে আসা, ড. ইউনূসের রিজাইন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার বরখাস্তসহ হেন গুজব নেই, যা না ছড়ানো হচ্ছে। ৫ আগস্টকে ঘিরে জনতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিস্ময়কর যূথবদ্ধতার মাঝে টোকা দিয়ে সফলতার বাতাবরণ ঘটাতেও সফল হয়েছে ভারত। রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ গঠনের শোরগোল সেই মিশনেরই ফল। তবে আয়োজনটা দ্রুত ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
সেনাপ্রধান দ্রুত রাজনীতিকদের সঙ্গে হিডেন টক করেছেন। যথাসময়ে বসেছেন বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে। তাদের নিষ্ঠা, পেশাদারত্ব ও ধৈর্যের প্রশংসা করেছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর পরিশ্রমের জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এ ছাড়া পবিত্র রমজান মাসে সেনাসদস্যদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচারের আশঙ্কা রয়েছে। এই সংকটময় সময়ে সবাইকে শান্ত থাকতে হবে। ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ নামের এই আয়োজনে সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অন্য সব সেনা স্থাপনায় কর্মরত কর্মকর্তারাও ভার্চুয়ালি এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হন। সেনাপ্রধানের এ বক্তব্য ঘিরে আগের রাত থেকে ব্যাপক গুজব ছড়ায়। সেনাশাসন, জরুরি অবস্থা ইত্যাদি আসছে- এমন গুজবে কিছুটা অস্থিরতার আলামতও দেখা যায় সাধারণের মধ্যে। অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে কোনো প্রভোকেশনে রি-অ্যাক্ট না করতে বলেছেন বাহিনীর সবাইকে। জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতে ইউএন মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদানের জন্য ভূয়সী প্রশংসাসহ ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন সেনাপ্রধান। একই সঙ্গে ৫ আগস্ট দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর অনন্য ও পেশাদারি ভূমিকার প্রশংসাও করেছেন বলে জানান। ‘সংশয়, অনুমান, সন্দেহ রেখো না- এ আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ যেকোনো সংকটে ধৈর্যধারণ করে কাজ করে যেতে বলেছেন। সেনাপ্রধানের বক্তব্যটি মোটামুটি ম্যাজিকের মতো কাজে দিয়েছে। আপাতত উৎকণ্ঠার অবসান ঘটানো গেছে। তবে রণেভঙ্গের মতো হাল ছাড়েনি ভারতসহ অ্যাক্টিভিস্টরা। এর বিপরীতে গণ-অভ্যুত্থানের পর যখনই ঐক্য দুর্বল হয়ে এসেছে, তখনই একেকটা ইস্যু এসে ঐক্যকে ফের সুদৃঢ় করেছে, এবারও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। একইভাবে হাসিনা সবখানে ষড়যন্ত্রের ছায়া দেখতেন, আর তার শাসনামলে যারা নিয়মিত সেনা অভ্যুত্থানে আর বিদেশি চাপে হাসিনার পদত্যাগের গল্প শোনাতেন, প্রতি মাসে হাসিনার পতনের তারিখ ঘোষণা করতেন, তারা এখনো সেই পুরোনো ফ্যান্টাসিতে ভুগছেন।