ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত সিরিয়া, ইস্তাম্বুল ও সোমালিয়ার লাখো মুসলিম জনতা, মানবেতর জীবনযাপনকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গা, রক্তবন্যায় প্লাবিত গাজা উপত্যকা, খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী হাজার হাজার ইউক্রেনীয়, বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিসহ বিশ্ব মুসলমানদের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সুমহান বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান সূচিত হয়েছিল ১ মার্চ শনিবার। আরবি ভাষার রমজ শব্দ থেকে উদ্ভূত রমজানের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরের যাবতীয় কলুষতা এবং ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় পাপাচারকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নস্যাৎ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি বা তাকওয়া অর্জন করা। আমাদের কাছ থেকে পবিত্র মাহে রমজান শাওয়ালের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে বিদায় নিচ্ছে (যথাসম্ভব) ২৯ মার্চ শনিবার। আর এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে বিশ্ব মুসলিমের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরাও ৩০ মার্চ রোববার ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ ও যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করবেন পবিত্র ঈদুল ফিতর।
ঈদুল ফিতর উদযাপনে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানই যথাসর্বস্ব ত্যাগ স্বীকারে সর্বদা তৈরি থাকেন এবং ইনশা আল্লাহ এবারও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। ইসলাম মানবতা ও বিশ্বজনীন ধর্ম। তাই ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিত্তশালী মুসলমানদের ওপর জাকাত ও ফিতরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই সুবাদে ঈদুল ফিতরের দিবসে ধনীদের পাশাপাশি দরিদ্র-নিঃস্ব মুসলমানদের ঘরেও আনন্দের ঢেউ সমানভাবে বয়ে যায়। সুদূর আটলান্টিকের অপর পারেও পবিত্র ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে মেহেদি লাগানো এবং নানা ধরনের বর্ণাঢ্য আয়োজন মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তাকে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে তুলে ধরে। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মুসলিম তরুণ-তরুণী ছাড়াও আমোদ-আনন্দপ্রিয় ভিন্ন সম্প্রদায়ের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরাও হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠায় প্রবাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন আমেজ ও পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেনাকাটার ধুম পড়ায় ভিড়বাট্টা সৃষ্টি হয় এবং স্বাভাবিক চলাফেরায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও পথচারীরা তেমন বিরক্তি বোধ করেন না। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এবারও খোলা ময়দানে বা উন্মুক্ত সড়কে পবিত্র ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের সুযোগ থাকবে। ঈদের সালাত, খুতবা এবং বিশেষ মোনাজাত শেষে যাবতীয় বিভেদ-বিসম্বাদ ভুলে গিয়ে উপস্থিত মুসল্লিরা পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সহমর্মিতার চিরায়ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। সাদামাটা ভাষায় বলা যায়, বরাবরের মতো এবারের ঈদুল ফিতর ও মুসলমানদের জাতীয় উৎসব পবিত্র ঈদের চিরায়ত সংস্কৃতি ও আমেজে আমাদের জীবনকে নতুনভাবে আলোড়িত করবে ইনশা আল্লাহ। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমরা অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও সাশ্রু নয়নে মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত ও যাবতীয় আসমানি গজব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সন্ত্রাস ও হানাহানিমুক্ত শান্তিপূর্ণ বিশ্ব কামনা করছি।
জুমাতুল বিদা : ২৮ মার্চ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের জুমাতুল বিদা। অনেকের জীবনে এটি শেষ জুমাতুল বিদা হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। তাই এই নশ্বর বিশ্বচরাচরে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে হলেও এবারের জুমাতুল বিদার সালাত আদায় করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
ঈদুল ফিতর রজনীর গুরুত্ব : আমাদের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আত্মোপলব্ধির অভাবে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আমরা অনেকেই প্রাত্যহিক ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল ইত্যাদি পালন করি না। বরং শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ দিবসের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করে থাকি এবং দিবসগুলো পালনে যথাসাধ্য ত্যাগ স্বীকার করি। অথচ মুসলমানদের জীবনে ঈদুল ফিতরের রজনী বা চাঁদ রাত শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা ইত্যাদির মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের পরিত্রাণের জন্য যে পাঁচটি বিশেষ রজনীর কথা পবিত্র হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ঈদুল ফিতর রজনী তার অন্যতম। অথচ পরিপূর্ণ ধর্মীয় জ্ঞান এবং মূল্যবোধের অভাবে আমরা এই পরম গুরুত্বপূর্ণ রজনী হেলায়-ফেলায় ও আনন্দ-কৌতুকে কাটিয়ে থাকি। মূলত ইবাদত-বন্দেগির স্থলে শুধু হাসি-আনন্দে ঈদের রজনী কাটিয়ে দেওয়া ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। উন্নতমানের জীবনযাপন এবং জীবিকার তাগিদেই স্বজনদের স্নেহসান্নিধ্য ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে আমরা প্রবাসী হয়েছি এবং আটলান্টিকের এ পারে বসতি গড়েছি। কিন্তু স্বদেশপ্রেমের অন্তঃসলীলা ফল্গুধারা সতত প্রবহমান আমাদের হৃদয়ের গভীরে ও মনমন্দিরে। তাই স্বজনদের স্নেহকাতর মুখচ্ছবিটি মানসপটে ভেসে ওঠামাত্রই নিজেদের অজান্তে আমরা অশ্রুসজল হয়ে উঠি। তাই আমাদের মতো ভাগ্যবিড়ম্বিতদের উচিত হবে যেকোনো মূল্যে ঈদের রাত জেগে সালাত আদায় করা এবং নিজেদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা, পরলোকগত পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের আত্মার চিরপ্রশান্তির জন্য অশ্রুসিক্ত নয়নে বিশ্বপ্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করা।
ঈদ : আরবি ভাষার ঈদের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে আনন্দ বা উৎসব। বস্তুত ঈদ হচ্ছে বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় খুশি ও আনন্দের উৎসব। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক জাতিরই উৎসবের দিন রয়েছে। আর আমাদের উৎসব হলো ঈদ (বুখারি ও মুসলিম)। বিশ্ব মুসলিম প্রতিবছর একবার ঈদুল ফিতর এবং একবার ঈদুল আজহাÑএ দুটি ঈদ উদ্্যাপন করে থাকেন। আর ঈদুল ফিতর হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীদের প্রথম জাতীয় উৎসব। ঈদের পারিভাষিক অর্থ আনন্দ আর ফিতরের অর্থ সাওম ভঙ্গ করা। তাই এককথায় বলা যায়, ঈদুল ফিতরের অর্থ হচ্ছে সাওম ভঙ্গের আনন্দ। বিশ্বপ্রতিপালকের বিশেষ রহমত, সন্তুষ্টি অর্জন ও তাকওয়া অর্জনের খাতিরে কায়মনোবাক্যে একনাগাড়ে এক মাস সাওম পালন শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিবসে মুসলমানগণ ঈদুল ফিতর উদ্্যাপন করে থাকেন। বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর ওপর রমজান মাসের যে ইবাদত নির্ধারিত করেছেন, তা যথাসাধ্য পালন করার তওফিক দানের জন্য বিশ্ব মুসলিম ঈদুল ফিতরের দিবসে অশ্রুবিগতিল নয়নে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। বিশ্ব মুসলিম প্রতিবছর যথাসাধ্য হাসিমুখে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করে থাকেন। ঈদের দিবসে মুসলমানগণ নিজ নিজ এলাকার মসজিদ বা ঈদগাহে সমবেত হয়ে দুই রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেন। ঈদের সালাত আদায় করা ওয়াজিব। অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে এই সালাত আদায় করতে হবে।
গুরুত্ব : বিশ্ব মুসলিমের জীবনে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। ধনী মুসলমানদের ওপর এ দিবস উপলক্ষে সাদকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করা হয়েছে। গরিব, অসহায় ও মিসকিন মুসলমানগণও যেন পবিত্র ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হন, সে জন্য ধনী মুসলমানদের ওপর ফিতরকে ওয়াজিব করা হয়েছে। ঈদের সালাতের আগেই ফিতর আদায় করার জন্য ধর্মীয়ভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ঈদুল ফিতরের দিবসে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই সবার খোঁজখবর নেন এবং সবার সঙ্গে সালাম বিনিময় করে থাকেন। ঈদুল ফিতরের ওয়াজিব দুটি। ক. ফিতরা আদায় করা এবং খ. ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করা। ঈদের দিনের সুন্নতের মধ্যে রয়েছে : ক. গোসল করা, খ. খোশবু বা আতর লাগানো, গ. পরিষ্কার জামাকাপড় পরিধান করা, ঘ. নামাজ আদায়ের পূর্বে মিষ্টিজাতীয় কিছু ভক্ষণ করা ঙ. ময়দান বা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করা এবং চ. ঈদগাহ বা মসজিদে যাওয়ার সময় ধীরে ধীরে তাকবির উচ্চারণ করা। [সম্ভব হলে ঈদগাহ বা মসজিদে এক পথে যাওয়া এবং নামাজ শেষে ভিন্ন পথে বাড়ি ফেরা।] ঈদের তাকবির : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
ঈদের সালাত আদায়ের নিয়ম : ঈদের দিন সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঠিক মাথার ওপর আসা পর্যন্ত সালাত আদায় করা যায়। সারিবদ্ধ হয়ে সালাত আদায় করতে হয় বিধায় প্রথমেই কাতার বা সারি করে নিয়ত করতে হয়। [নিয়ত জানা না থাকলে আমি কেবলার দিকে মুখ করে ইমামের পেছনে ঈদুল ফিতরেরদুই রাকাত নামাজ অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি বললেই চলবে।] নিয়তের পর তাকবিরে তাহরিমা বলে হাত বাঁধতে ও সানা পড়তে হবে। এরপর ইমামের সঙ্গে অতিরিক্ত তিনবার তাকবির বলার সময় প্রথম দুবার কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে এবং তৃতীয় বার অন্যান্য সালাতের মতো হাত বাঁধতে হবে। এরপর ইমাম স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাতের রুকুতে যাওয়ার পূর্বে অতিরিক্ত তিনটি তাকবির বলবেন এবং উপরিল্লিখিত নিয়মে তাকবির বলে ও হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে ছেড়ে দিতে হবে এবং চতুর্থ তাকবিরে রুকুতে যেতে হবে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে সালাত শেষ করে ইমাম খুতবা দেবেন। ঈদের খুতবা শোনাও ওয়াজিব বিধায় মুসল্লিগণকে মনোযোগসহকারে তা শ্রবণ করতে হবে। খুতবা শেষে বিশ্ববাসী, বিশেষত বিশ্ব মুসলিমের সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হবে। তারপর যাবতীয় ভেদাভেদ ও হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা ভুলে গিয়ে চিরায়ত রীতি মোতাবেক পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরে সৌভ্রাতৃত্ব প্রদর্শন করবে। মূলত ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট (ক্ষমা করে দাও এবং ভুলে যাও)-ঈদের এই চিরায়ত আবেদনের অভাবই বর্তমানে বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববোধে ফাটল ধরিয়েছে এবং সর্ববিধ সংঘাতে জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমরা এই বিষবাষ্প থেকে পরিত্রাণের জন্য দয়াময় আল্লাহর কৃপা ভিক্ষা করছি।
স্মর্তব্য, যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ এবং বুকে বুক মিলিয়ে আমরা গত বছরের ঈদুল ফিতর উদ্্যাপন করেছিলাম, তাদের কেউ কেউ হয়তো-বা ইতিমধ্যে বিশ্ববিধাতার আদেশে পার্থিব জীবনের ইতি টেনে কবরবাসী হয়েছেন। আগামী বছরের পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে কে বা কারা কবরবাসী হবেন, একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তাই এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমরা অতীতকালীন যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা ভুলে যাব এবং পরস্পরকে ক্ষমা করে দেব। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঠিকানা পরিবারের পক্ষ থেকে সকল লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাকে জানাচ্ছি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা এবং রক্তিম অভিবাদন। আর স্বজনহারাদের প্রতি রইল সুগভীর সহমর্মিতা এবং লোকান্তরিতদের আত্মার মাগফিরাত ও জীবিতদের দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ঈদ মোবারক।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।