Thikana News
০২ অগাস্ট ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫

কালিমালিপ্ত ও বেদনাবিধুর শোকের মাস আগস্ট

কালিমালিপ্ত ও বেদনাবিধুর শোকের মাস আগস্ট
শোকের মাস আগস্ট। এই মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড। তাই ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণা ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালে এই দিনে মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, বিশ্বের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা, বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, বাঙালির চিরন্তন প্রেরণার উৎস, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির অহংকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
সেদিন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল্লাহ নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নৃশংসভাবে নিহত হন।
এই শোক যদিও বলা হয় বাঙালি জাতির জন্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তবু ১৫ আগস্ট এলে শোকের মাতম ওঠে জাতীয় জীবনে। বাঙালি জাতির পক্ষে এ শোক কখনো ভুলে থাকা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। ১৫ আগস্টের ঘটনা বাঙালি জাতিকে ধারাপাতের হিসাবে ২২ বছর পিছিয়ে দিলেও চেতনাগতভাবে পিছিয়ে দিয়েছে এতটাই যে, আজও আমরা ১৫ আগস্টের সেই অভিঘাত বয়ে বেড়াচ্ছি এবং হয়তো অনাদিকাল বয়ে বেড়াতে হবে। কেননা এ শোক সান্ত্বনাহীন।
১৯৭৫ সালের ওই রাতে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা কেউ কখনো ভাবতে পারেনি। তবু কেন অবিশ্বাস্য এই ঘটনা ঘটে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর আজও বাঙালিরা খুঁজে পায়নি। কোনো অঙ্কই এ প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারে না আজও। মুক্তি দিতে পারে না জাতিকে তার জনক হারানোর কষ্ট থেকে উদ্্গত বেদনাকেও। দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত দেশ। একদিকে সেই ক্ষতের চিহ্ন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ পুনর্নির্মাণের আরেক কঠিন লড়াইয়ে নিমজ্জিত বঙ্গবন্ধু। তখন পর্যন্ত সব দেশের স্বীকৃতি মেলেনি। সব দেশ বাংলাদেশের পুনর্নির্মাণে তখন পর্যন্ত তার পাশে নেই। সে পরিস্থিতিতেও স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সেটাও আরেকটি রণক্ষেত্র। সুযোগ খুঁজছে অনুকূল সময়ের। চারদিকে অসন্তোষ, আত্মকলহ, অপপ্রচার। বৈরী বিদেশিরাও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ওত পেতে আছে সবাই। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত মিত্র ছিলেন, তাদের কেউ কেউ এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর লিখলেন, ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো।’ কিন্তু বাঙালিরা আর কত জীবন কাঁদবে, কত রক্ত দেখবে, কত অশ্রু ঝরাবে? বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিল, প্রিয়জন হারানোর বেদনায়, স্বজনের কান্নায় বাংলার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। এখনো ১৫ আগস্টের দুঃস্বপ্ন সামনে এসে দাঁড়ালে বুকের কষ্টটা চেপে বসে। ১৫ আগস্টকে ভুলে থাকা বাঙালি জাতির পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। যত দিন বাংলাদেশ এবং বাঙালি থাকবে, তত দিন বাঙালির বুকে ১৫ আগস্টের শোক চেপে থাকবে। বাঙালিকে শোক বয়ে বেড়াতে হবে। তবে ১৫ আগস্টের হত্যা, ষড়যন্ত্রই প্রথম বা শেষ নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সেই ষড়যন্ত্র একটা রূপ নেয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। এরপর প্রায় ৫৩ বছর কেটে গেল, সেই ষড়যন্ত্র শেষ হলো না। এখনো চলছে।
তবে বিশেষভাবে বক্তব্য, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ ৬০ জন গভর্নরের শপথ ও দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে সারা দেশের সর্বস্তরের আওয়ামী লীগাররাই সশরীরে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। অথচ সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর কারও পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়নি। নিয়তির নির্মম পরিহাস হিসেবে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারে বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকজন চিরবিশ্বস্ত বন্ধু ও ডাইসাইটে মন্ত্রীও হাসিমুখে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
নিচে বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে বিষয়টি আলোচনা করতে চাই। তা হলো যিশুখ্রিষ্টের ১২ জন শিষ্যের মধ্যে যুদাস একজন। তার পরিচয় আমরা জানি। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে মোশতাক একজন। তার পরিচয়ও আমরা জানি। যে রাতে যিশুকে ধরিয়ে দেওয়া হবে, তার আগে যুদাস ইহুদিদের বলেছিল, যেহেতু আমরা সকলেই দেখতে একই রকম, তোমাদের সামনে আমি যার গালে চুমু দেব, বুঝে নিয়ো তিনিই যিশু। ঠিক এ রকম চিত্র দেখি মোশতাকের বেলায়ও। আমরা দেখি, এই মোশতাক মুজিবের গালে চুমু দিচ্ছে অর্থাৎ মোশতাক জানত যুদাসের কথা। একদিন তার হাতেই মুজিবের পরিণতি হবে যিশুখ্রিষ্টের মতো। তারই বাস্তব নিদর্শন রেখেছে সে।
যিশুখ্রিষ্ট হলেন মানুষের আত্মিক মুক্তিদাতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত করেছিলেন। তো যিশুখ্রিষ্ট এবং বঙ্গবন্ধু মুজিব দুজনই হয়েছিলেন রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। তাঁদের উভয়কেই নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। তাঁদের হত্যা করার জন্য যারা চূড়ান্তভাবে ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসেবে কাজ করেছে এবং সফল হয়েছে তারা যুদাস ও মোশতাক। ইতিহাসে তারা ঘৃণিত হয়ে আছে এবং মানবসভ্যতা যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন মানুষ তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন ও ধিক্কার দিয়েই যাবে।
মোশতাকের চরিত্র জানতেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। তাঁরা অনেক সময় মোশতাক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিতও করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরল বিশ্বাসে এই মোশতাককেই তাঁর পাশে রেখেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলার প্রবাসী সরকার যখন ভারতে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সফলতার দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াসে ব্যস্ত, তখন মোশতাক ইয়াহিয়ার সঙ্গে কনফেডারেশনে পৌঁছানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এমনকি জাতিসংঘে স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, তথাকথিত পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলার প্রবাসী সরকারের বুদ্ধিমত্তায় এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অকুণ্ঠ সমর্থনে মোশতাকের ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ভারতের অবস্থানকারী প্রবাসী সরকারের সবাই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সে সময় মোশতাকও বাংলাদেশে আসে। একাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও কলকাতা হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এলে আওয়ামী লীগের নেতারা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নিয়ে আসার সময় গাড়িবহরে বঙ্গবন্ধুর পাশে জিন্নাহ টুপি পরিহিত এই মোশতাককে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিসভায় মোশতাককে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এমনকি তিয়াত্তরে জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা থেকে মোশতাককে জিতিয়ে আনার জন্য হেলিকপ্টারে ব্যালট পেপার ভর্তি ব্যালট বাক্স নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ মোশতাকের ষড়যন্ত্র তখন চূড়ান্ত পরিণতির পর্যায়ে এগিয়ে যায়।
ফারুক রশিদ গং তাদের কিলিং মিশন সফল করতে খন্দকার মোশতাককে বেছে নিয়েছিল। তারা মোশতাকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল। এই মোশতাকই অবলীলায় হয়ে পড়ে তাদের হাতের পুতুল। মোশতাকের প্রতি অন্ধ স্নেহ-ভালোবাসার মাশুল দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ মোট ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে এবং পরিবারকে রক্ষা করতে তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে আহ্বান জানালেও তিনি এগিয়ে আসেননি। এমনকি রক্ষীবাহিনীও নিষ্ক্রিয় ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যত দিন এ রাষ্ট্র থাকবে, তত দিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। তাইতো এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে ক্রমেই তিনি সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। রাজনীতি যদি মানুষের জন্য হয়, বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সেই মানুষের রাজনীতি করেছেন। জীবনের ১৪টি বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকারের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু কখনো বিশ্বাস করতেন না, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করবে।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে আঘাত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। মোশতাক ও ফারুক-রশিদ-ডালিম খুনিচক্রের লক্ষ্য শুধু বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল না, ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেওয়া। ১৫ আগস্টের পরস্পরায় পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন রাজনৈতিক সহচর চার জাতীয় নেতাকে। এসব হত্যাকাণ্ড বাঙালির ইতিহাসে যোগ করেছে এক কালো অধ্যায়। এখান থেকে বাঙালি ও বাংলাদেশ আর কোনো দিন গ্লানিমুক্ত হতে পারবে না।
জাতীয় শোক দিবসে সর্বস্তরের বাঙালির সঙ্গে আমরাও গভীরভাবে শোকাহত। ১৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে জেল হত্যাকাণ্ডসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত হত্যাকাণ্ডে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করি। লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক, কলাম লেখক ও সমাজবিজ্ঞানী। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি (ফেলো)।
কমেন্ট বক্স



9