অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিটে যোগ দিয়ে এক অধিবেশনে আবারও বলেছেন, তার সরকার যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজন করবে। এটা এ বছরের ডিসেম্বরেও হতে পারে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও ডিসেম্বরকে ধরে নিয়েই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।
এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। দলগুলো নিজেদের মতো করে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিয়ে ছুটছে মাঠে। করছে গণসংযোগ, সম্ভাব্য প্রার্থীরা যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে। দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আশা করছে, ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে যদি ডিসেম্বরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে, তাতে তাদের আপত্তি নেই। নির্বাচন সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির নতুন একটি রাজনৈতিক দলও ঘোষণার অপেক্ষায়। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আসতে পারে আরও কয়েকটি নতুন দল। সেসব দলের চাহিদা এখনো স্পষ্ট নয়।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী চলতি মাসের মধ্যেই বাকি জেলাগুলোতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। জেলা পর্যায়ে সমাবেশ কর্মসূচি শেষ হলে বিভাগীয় ও মহানগরে সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররাই বড় ফ্যাক্টর। ভোটারের মন জয় ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার অন্য রাস্তা নেই। তাই ভোটারের আস্থা অর্জন করতে হবে। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে হবে, পাশে থাকতে হবে।
ইতিমধ্যে সারা দেশের ৬৭ সাংগঠনিক জেলায় ধারাবাহিকভাবে সমাবেশ শুরু করেছে বিএনপি। সমাবেশগুলো থেকে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন দলটির নেতারা। ভোট সামনে রেখে তৃণমূলে ছুটছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। সভা-সমাবেশ, কর্মীসভা, উঠান বৈঠকসহ নানা কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দলটি। বিএনপি ৩১ দফা নিয়ে সারা দেশে কর্মশালা করছে। আসনভিত্তিক প্রার্থীরা নিজেদের মতো করে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। ভোটারের আস্থা অর্জনে কাজ করছেন। পাশাপাশি মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে যেতে কেন্দ্রে ইতিবাচক কাজ দেখানোর চেষ্টা করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রদের সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক দল, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নাগরিক ঐক্য, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোও বসে নেই। প্রতিটি দল নিজেদের মতো করে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। নিজ নিজ আসনে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা। কেন্দ্রীয় নেতারা প্রতিদিন তৃণমূলে যাচ্ছেন। সভা-সমাবেশ করছেন।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জোটগত নির্বাচন না করলে তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। ইতিমধ্যে তারা শতাধিক আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট গঠনেরও জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা একটি জায়গায় আনতে চায়। সে ক্ষেত্রে জোট না হলেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো মিলে আসনভিত্তিক একজন প্রার্থী দেবে। এর মধ্য দিয়ে এই বলয়ের সব ভোট এক বাক্সে আনার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর এমন চেষ্টায় অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দলের সায় রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
ওদিকে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। সে লক্ষ্যে সারা দেশে সাংগঠনিক কাজ করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে। আত্মপ্রকাশের পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও ভাবছে তারা। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জানিয়ে আসছে, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করছে ইসি। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। নির্বাচন নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জও দেখছে না ইসি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে যদি ডিসেম্বরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। মাস আমাদের কাছে ফ্যাক্টর না। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে মাস লাগে, সেই মাসের জন্য আমরা প্রস্তুত।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, আমরা বলেছি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হওয়া যাবে না। সেই নির্বাচন চলতি বছরের জুন বা ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের জুন- যখনই হোক না কেন। আমরা দেখতে চাইব সংস্কারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। সংস্কার বা গণঅভ্যুত্থানের যে দাবি, সেগুলো বাস্তবায়ন ছাড়া শুধু রাজনৈতিক দলের চাপে নির্বাচন দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সংকটও কাটবে না। তিনি বলেন, আমরা স্বতন্ত্রভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছি। নির্বাচন নিয়ে আমাদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি রয়েছে। আরও প্রস্তুতি নিচ্ছি। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি আছে আমাদের।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমাদের একধরনের প্রস্তুতি আছে। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা যেসব আসনে প্রার্থী দিয়েছিলাম, তার অধিকাংশ আসনে এবার নির্বাচন করব। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এর বাইরেও বেশ কিছু আসনে নির্বাচন করার লক্ষ্য আছে আমাদের। আমরা মোট ১০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। পাশাপাশি জোটগত নির্বাচন নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিএনপির সঙ্গে আমরা কথা বলব। আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু বলেন, ‘সরকার আন্তরিক হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। আমরা নিবন্ধনের জন্য কাজ করেছি। নির্বাচনের জন্য আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা চেষ্টা করব ম্যাক্সিমাম আসনে প্রার্থী দেওয়ার। কাজ মোটামুটি গুছিয়ে এনেছি। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে নির্বাচন করব। প্রস্তুতি এখনই নিয়ে রেখেছি, বিষয়টি তেমনও নয়। যখন নির্বাচন হবে তখন করতে হবে। আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি। যখনই ঘোষণা আসবে, তখনই আমরা নির্বাচন করব।