‘কিংস পার্টির গোপন প্রস্ততি’- এমনটিই ছিলো শীর্ষ শিরোনাম। প্রকাশিত হয়েছিলো ছাত্র-গণ-অভুত্থানের মাসেই, গত ২১ আগস্ট ২০২৪। বিষয়টি সারাবিশ্বেই বিস্ময় জাগিয়েছিলো। কারো কল্পনাতেই ছিলো না- নতুন সরকার দল গড়বে। কিন্তু মাত্র ৬ মাসের মাথায় থলের বিড়াল বেরিয়ে এলো। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করছে নতুন দল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ঘোষণা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসও সমর্থন দিয়েছেন। ফলে ক্ষমতার রাজনীতিতে সূচনা ঘটেছে নতুন হিসাব-নিকাষের।
কিংস পার্টি : বাকশাল, বিএনপি, জাপা থেকে চব্বিশের ছাত্রশক্তি : রাষ্ট্রক্ষমতার অনুকূলে গঠিত রাজনৈতিক দলের প্রতীকী নাম ‘কিংসপার্টি।’ ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি প্রথম তা গঠন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদে ঢোকেন। সংসদনেতা হিসেবে বক্তব্য দেন সরকার বদলের। বাকশাল বা ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। এটি ঘোষণার মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়। শেখ মুজিব নতুন দলের চেয়ারম্যান হন। সরকার পদ্ধতি অনুসারে তিনি ‘প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্ট’ হন। এজন্য গণভোট বা জনগণের কোন সম্মতি নেননি। জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী এমপিদের সমর্থনেই ‘বাকশাল’ গঠন করেন।
দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রথমবারের মতো রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। পদাধিকারবলে সেনাপ্রধান, বিমান-নৌবাহিনী প্রধানও বাকশালের সদস্য। এছাড়া পুলিশপ্রধান, এনএসআই, ডিজিডিএফআই, বিডিআর প্রধানও সদস্য। তৎকালীন ৬২ জেলায় বাকশাল গভর্নর নিয়োগ করা হয়। ৫ জন জেলা প্রশাসকও প্রশাসন ক্যাডার থেকে গভর্নর হন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবি-সচিব মোফাজ্জল করিমও গভর্নর হয়েছিলেন। রাজনৈতিক গভর্নরদের মধ্যে জীবিত আছেন আরো চারজন। যথা- তোফায়েল আহমদ, আমির হোসেন আমু, অধ্যাপক আবু সাঈয়িদ। এছাড়া বঙ্গবীর-খ্যাত কাদের সিদ্দিকী, বীর-উত্তম।
উপ-সেনাপ্রধান হওয়ায় বাকশালের সদস্য হতে পারেননি জে. জিয়াউর রহমান। তবে ৬২ জন নবনির্বাচিত গভর্নরকে শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়েছিলেন। বাকশালের প্রথম কাউসিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫-এর ৭ জুন। তাতে বেগম খালেদা জিয়াসহ তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭৮-এর ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা পায় ‘বিএনপি’। প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় জে. জিয়া দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটিকে বলা হতো বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় কিংসপার্টি।’ এর কর্মসূচি ও দলীয় সঙ্গীতটি ব্যাপক জনপ্রিতা পায়। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’। ১৯ দফা কর্মসূচির দলটি বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন।
১৯৮৬-এর ১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘জাতীয় পার্টি’। প্রেসিডেন্ট জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এটির প্রতিষ্ঠাতা। দেশের ‘তৃতীয় কিংসপার্টি’ হিসেবে এটি এখনও সক্রিয়। এর দলীয় শ্লোগান ও সঙ্গীতের রচয়িতা স্বয়ং জে. এরশাদ। ‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম’।
উল্লেখ্য, মৃত্যুর পূর্বে ‘বাকশাল’ গঠন করেন শেখ মুজিব। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে এটির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু পরবর্তী নেত্রী মুজিবকন্যা হাসিনা ‘বাকশাল’ রাজনীতি নেননি। পিতার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে তাই নীরব বিতর্ক রয়েছে।
ছাত্র-আন্দোলনের ‘সেকেড ওয়েভ’- দেশের ভাবিষ্যৎ কান্ডারী : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রায় দেড়শ ‘সমন্বয়ক’ উপহার পায় দেশ। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানটি রাজনৈতিক হওয়ায় আন্দোলনকারীরা রাজনীতির পথেই হাঁটে। ১৫৪টি দাবি-দাওয়া মোকাবিলা করতে হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে। আক্রমণাত্মক উদ্যোগ ব্যর্থ করতে ছাত্রশক্তি সমন্বিত ভূমিকা রাখে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আক্রমণাত্মক রাজনীতি প্রতিহতকরণও জরুরি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অনলাইন ভাষণের ঘোষণা দেন পলাতক দলনেত্রী। ভারতে বসে অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্রশক্তিকে কটাক্ষ করতে থাকেন। হ্যান্ডবিলে ড. ইউনূস সরকারকে অবৈধ, অসাংবিধানিক বলা হয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে প্রতিহতকরণের উদ্যোগ চলে। সেক্ষেত্রে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ নামে নতুন উদ্দীপনা প্রদর্শিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২-এর বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সারাদেশে আওয়ামী লীগের বিতর্কিত ১৮ নেতার বাড়ি ভাংচুর ও লুঠ হয়। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ও সামরিক বাহিনী ছিলো নির্বিকার। বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, ছাত্রশক্তিটিই দেশের প্রধান কান্ডারী। অতএব আগামীদিনের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই শক্তি সহায়ক হতে পারে।
নতুন ছাত্রনেতারা একেকজন তোফায়েল, রব, রাজ্জাক, আমু, শাহজাহান সিরাজ : ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ছাত্রনেতারা রাজনীতিতে যুক্ত হন। তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আমু, আব্দুর রউফ বা আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ। আসম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া। ‘মধুর ক্যান্টিনে’র কুশীলবেরা সরকারে বা বিরোধী দলের আসন নেন। একই কায়দায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রশক্তির নেতারা আসন খুঁজছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তিনজন তরুণ মন্ত্রী পদমর্যাদায় উপদেষ্টা হয়েছেন। অপরাপর নেতাদের পেশাজীবন রাজনীতির নিয়তিতে বাঁধা। ফলে তাদের পদ-পদবীর প্রয়োজনে ‘রাজনৈতিক দল’ অনিবার্য। তারাই আগামীদিনের তোফায়েল, আমু, রাজ্জাক, ইনু, মাখন, রব প্রমুখ।
তরুণ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম হচ্ছেন প্রস্তাবিত দলের আহ্বায়ক। নেন্দ্রীয় নেতৃত্বে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, আখতার ইতোমধ্যে সক্রিয়। পদ-পদবী নিয়ে নিজেদের মধ্যে মান অভিমানও ঘটছে। নতুন দলের নামকরণ, গঠনতন্ত্র, প্রতীক চূড়ান্ত প্রায়। মাতৃভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই ঘোষিত হচ্ছে সবকিছু।
বিএনপিতে হতাশা, জামায়াতে উচ্চাশা, ড. ইউনূসের প্রত্যাশা : ছাত্রশক্তির দলগঠনে হতাশ হয়ে উঠেছে প্রধান দল বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তা আঁচ করেছেন। লন্ডনে বসে দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাষ। বলেছেন, আসন্ন নির্বাচন সহজতর হবে না। বিএনপিকে কঠিনতর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। ‘কিংস পার্টি’ গঠনের মধ্য দিয়ে সেই আশংকাই মুখ্য হলো।
বিএনপি নেতাদের মতে, ক্ষমতাসীনদের পাতানো খেলায় দল হচ্ছে। ‘কিংস পার্টি’ মানে চলমান ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছাড়ছে না। অতীতের ‘কিংস পার্টিগুলোও বৈধতার জন্যে দল গড়েছে। ক্ষমতা দখলের পর সংসদে তা পাশ করানোই মূল উদ্দেশ্য। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে ম্যান্ডেট নেয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে ছাত্রশক্তির নতুন দল প্রধান সহায়ক হবে। বিএনপির মতে, নতুন দলের বিকাশের স্বার্থে নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে। সংস্কার, অপরাধী আওয়ামী নেতাদের বিচারের নামে সময় ক্ষেপণ চলছে। বিএনপির পর্যবেক্ষণেÑ আগে দ্রুত সংসদ নির্বাচন। পরে স্থানীয় সরকার বা ইউনিয়ন, উপজেলা-জেলা, মেয়র নির্বাচন। তা না হলে সরকারপক্ষ আগে তৃণমূলে নিজেদের মানুষ বসিয়ে দেবে। এজন্যে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। একই সুরে নেতারাও বলছেন, আগে এমপি নির্বাচন এবং তা অতিদ্রুত আয়োজন করতে হবে।
জামায়াত অবশ্য ‘কিংসপার্টি’ বিষয়ে উচ্চাশা পোষণ করছে। নতুন দলে জামায়াতের অনেক ক্যাডার নেপথ্যে কাজ করছে। সূত্র মতে, ‘কিংসপার্টি’র সঙ্গে জোট বাঁধতেও তারা আগ্রহী। ফলে অনায়াসে দলটি ক্ষমতার অংশীদার হতে পারবে।
অন্তর্বর্তী সরকার-প্রধান ড. ইউনূস ‘কিংসপার্টি’কে স্বাগত জানিয়েছেন। ২০০৭ সালে নিজে দল বানাতে গিয়ে বিফল হন। এখন ছাত্রশক্তির মাধ্যমে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চান। তিনি, ‘তারুণ্যশক্তির বাংলাদেশ’ উপহার দিতে বদ্ধপরিকর। আসছে এপ্রিলে বিশ্ববিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করছেন ঢাকায়। বিশ্বখ্যাত ধনকুবেরদের মেলা বসাতে উদ্যোগ নিয়েছেন। যা এক কোটি তরুণকে উদ্যোক্তা বানাবে বলে প্রত্যাশা। সেক্ষেত্রে দেশের ‘কিংসপার্টি’র নেতারা পাবেন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। দলটি তৃণমূলে শক্ত ভিত্তি গড়তে পারবে বলে প্রত্যাশা। ফলে, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতকে নিয়ে সরকারপক্ষ ততোটা ভাবিত নয়।