Thikana News
১৬ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪


 

ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং নৃশংস বর্বরতা    

ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং নৃশংস বর্বরতা    


পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদের উত্থানপর্ব কিংবা ধারাবাহিকতা মূলত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়। সাধারণত রাষ্ট্রীয় শোষণপ্রক্রিয়া এবং একনায়কতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধবাদীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়ে থাকে। তবে বার্বারিয়ান যুগ থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত গণমানুষই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। ক্ষমতার উগ্রায়ন ও রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ পরিত্রাণ পেলেও সর্বদা সাধারণ মানুষের ভাগ্যেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিপদ নেমে আসে।
ফ্যাসিজমের উৎপত্তি হয়েছে ইতালীয় শব্দ ভধংপরংসড় ভধংপরড় থেকে, যার অর্থ ‘লাঠির বান্ডিল’। ইতালির রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে দেওয়া নাম, যা ফ্যাসি নামে পরিচিত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন গোষ্ঠীগুলোকে অনেকটা গিল্ড অথবা সিন্ডিকেটের মতো বোঝায়।
ইতালীয় স্বৈরশাসক ফ্যাসিবাদী ‘বেনিটো মুসোলিনি’র নিজস্ব বিবরণ অনুসারে, ১৯১৫ সালে ইতালিতে বিপ্লবী অ্যাকশনের ফ্যাসেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফ্যাসিবাদ শব্দটি সর্বপ্রথম সর্বগ্রাসী ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী শাসনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯১৯ সালে মুসোলিনি মিলানে ইতালীয় ‘ফ্যাসিস অব কমব্যাট’ প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তী সময়ে সেটি জাতীয় ফ্যাসিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। ইউরোপের সরকার এবং সামাজিক সংগঠনের কর্তৃত্ববাদী এবং সর্বগ্রাসী জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী ব্যবস্থাপনার নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের সম্প্রসারণ ঘটে। ফলে ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স এবং অন্যান্য রাষ্ট্রপুঞ্জে তা সম্প্রসারিত হয়। এই ধারাবাহিকতায় কোনো কোনো দেশের ক্ষমতাসীনদের চরম ডানপন্থী, অসহিষ্ণু কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন করা হয়। কট্টর ডানপন্থী ছাড়াও বামপন্থী কিংবা সমাজতান্ত্রিক সরকারের ব্যবস্থাপনার নামেও কোনো কোনো রাষ্ট্রে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উগ্র শাসনে জনগণের ওপর শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও বর্বর হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
পৃথিবীর অধিকাংশ গবেষকের মতে, তখনই ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটে, যখন একজন শাসক নিজেকেই সর্বসেরা ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ফ্যাসিবাদে কেবল নিজের ক্ষমতা, আমিত্ব, আভিজাত্য নিজস্ব স্বার্থকেই মুখ্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। রাষ্ট্রের সমগ্র জাতিসত্তাকে নিজস্ব ক্ষমতার নিয়মকানুন চাপিয়ে দিয়ে খেয়াল-খুশিমতো চালানোর জন্য প্রবৃত্ত হয়। একজন রাষ্ট্রনায়ক শুধু নিজেকেই পরম ও চরম জ্ঞানীরূপে ভাবে এবং বাকি সবার আত্মপরিচয়কে নাকচ করে দেয়। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বৈরশাসক তার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যা খুশি তা-ই করবে, তাতে নাগরিক সমাজ এবং প্রান্তিক জনপদের কোনো কিছু বলার থাকবে না।
ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক নির্বিচারে গণমানুষকে হত্যা করে থাকে। পৃথিবীর মানববিধ্বংসী বর্বর শাসকদের বিষয়ে এতটুকু বলা যায়, স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনায় তারাই মানবতা-পরিপন্থী যুগ যুগ ধরে স্বৈরশাসন এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে থাকে। ফ্যাসিস্ট শাসক তার চতুর্দিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের কবজায় রাখে। এভাবে ফ্যাসিস্টের মনোবৃত্তি থেকে মানবতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধগুলো মুছে যেতে থাকে। সেখানে কতিপয় সুবিধাবাদী, মেরুদণ্ডহীন মানববিদ্বেষী দাস-দালালের অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপুঞ্জে ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সম্প্রসারিত হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত, খুনোখুনির ইতিহাস আমাদেরকে ফ্যাসিবাদের উত্থান-পতনে তাদের ভ্রমাত্মক মতাদর্শের ভয়াবহ পরিণতির কথা প্রতিবার মনে করিয়ে দেয়। ফ্যাসিবাদ এমন এক দানবীয় শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণ নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত হবে। মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপনে বাধাগ্রস্ত থাকবে। জননিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মৌলিক অধিকার নিয়ে জীবনযাপন করার সুযোগ থাকবে না।
১৯৩০ সালে জার্মানরা যখন হিটলার-গুয়ারিঙের বানানো ফ্যাসিস্ট আয়নায় নিজেদের দেখেছিল, তারা মানবহত্যা ও তাদের প্রতি চরম নিপীড়নের নীতিমালা ঠিক করেছিল। শুধু জার্মানিই-বা কেনÑমুসোলিনির ইতালি, ফ্রাঙ্কোর স্পেন, সালাজারের পর্তুগাল, হোর্থের হাঙ্গেরি কিংবা রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ইসরায়েল এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাজতান্ত্রিক ও একতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ফ্যাসিজম চালু রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, শুধু কম্বোড়িয়ার পতিত স্বৈরশাসকের আমলে বহু বছর ধরে জনতার ওপর বর্বর হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অত্যাচার, নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ২০ লাখ মানুষকে হত্যা করার পর ২০ হাজার গণকবরস্থানে গভীরতর গর্তে পুঁতে রাখা হয়।
বর্তমানে ফ্যাসিবাদ কেবল হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো কিংবা ইসরায়েলে সীমাবদ্ধ নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ ছড়ানো আছে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর দানবীয় চেহারা দেখা গেছে। বিশ্বব্যাপী বর্ণবিদ্বেষী ফ্যাসিবাদের সংক্রামণে এশিয়া, ইউরোপ এবং কয়েকটি আফ্রিকান দেশে বলবৎ ছিল এবং এখনো আছে। ইতালীয় দার্শনিক, নন্দনতাত্ত্বিক উমবার্তো একো যথার্থই বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদ ছদ্মবেশে নতুন অবয়বে ফিরে আসে।
বিশ শতকের শেষ থেকে শুরু বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বাস্তবতার মাঝেও বর্তমান দুনিয়ায় ফ্যাসিবাদী শাসন এবং একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দানবীয় চেহারা ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠেছে। এসব দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ অর্থনীতি, শিক্ষা ও জুডিশিয়ারি আইনাঙ্গনের ন্যায়নিষ্ঠ বিচারব্যবস্থার ওপর কুঠারাঘাত করা হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কলুষিত করা হয়। কেননা ফ্যাসিবাদীরা সরকারের প্রশাসনিক স্তরের সর্বত্র তাদের অনুগত লোকদের স্থলাভিষিক্ত করে থাকে। একই কারণে সেসব দেশের শিক্ষার মানও থাকে নিম্নগামী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর শিক্ষার মান কমে যায়। কোনো কোনো ফ্যাসিস্ট শাসক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা অপছন্দ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থা ঘৃণা করে। 
এ প্রসঙ্গে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়, কী কারণে ফ্যাসিস্টরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অপছন্দ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘৃণা করেন। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা উদাহরণস্বরূপ দুই ফ্যাসিস্ট শাসকের বর্ণনা দেয়। তাদের একজন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর আরবান, আরেকজন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রথম সেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। নিচে তার কিছুটা তুলে ধরা হলো :
‘বাংলাদেশে উল্লেখ করার মতো কিছু ঘটনা ঘটে গেল। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে প্রাথমিকভাবে আন্দোলন শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বড় পরিসরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ক্রমেই স্বৈরাচার হয়ে ওঠা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে তা গায়ে লাগাননি। বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার পরিবর্তে তিনি এমন সব পদক্ষেপ নেন, তাতে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
‘জুলাই মাসের মাঝামাঝি শেখ হাসিনার সরকার বিক্ষোভ দমনে চূড়ান্ত রকমের সহিংসতার আশ্রয় নেয়। পুলিশের গুলিতে মারা যান অনেক শিক্ষার্থী, নারী-শিশু এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষ। দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট যোগাযোগ। পুলিশের নৃশংসতার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই মাসের শেষ নাগাদ বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
‘প্রকাশ থাকে যে, একটি সরকার যখন গণবিচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন তার একমাত্র অবলম্বন থাকে প্রশাসনিক নির্ভরতা। ঘটনাক্রমে সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিলে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এভাবেই দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলন একজন সহিংস স্বৈরশাসককে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়। বলা যায়, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা জয়ী হয়েছেন।’ (সূত্র : প্রথম আলো অনলাইন, বাংলা ভার্সন, ৭ সেপ্টেম্বর)।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ভয়ংকর বিধিনিষেধ ছিল। বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ওপর। অথচ একসময় এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে এই দুটি প্রধান দল কঠোর আন্দোলন সংঘটিত করে এবং এরশাদ সরকারের পতন হয়। কী কারণে শেখ হাসিনার সরকার বিএনপির ওপর এমন কঠোরভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করল, তা অনেকের বোধগম্য নয়।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে সকল দলের কার্যক্রমের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ ছিল। মিডিয়ার ওপর ছিল কঠোর সেন্সরশিপ। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি চরম নিপীড়ন ও অবিচারমূলক সাজা প্রদান করা হয়। বিএনপির নেতা তারেক রহমানের কোনো বক্তব্য ও ভাষণ প্রচার ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশের সহিংস আন্দোলনের প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতেও পড়ে। কলকাতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে একাধিক মিছিল-মিটিং সংঘটিত হয়। ভারতের ছাত্র-জনতা মিছিল-মিটিং থেকে হাসিনা সরকারের নির্দয় আচরণ তথা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। সেসব খবর ভারতের গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা হয়। তেমনি পাকিস্তানেও সেই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খান প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে বন্দী। একই সঙ্গে সে দেশের বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা সরকারি নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে বিদেশি মদদপুষ্ট দেশটির সামরিক বাহিনী এবং পাকিস্তানের বর্তমান সরকার। শেখ হাসিনার মতো পাকিস্তান সরকারও ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করার জন্য নানা রকম দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ফলাওভাবে প্রচার করা হয়।
বিস্ময়ের ব্যাপার, ইতিমধ্যে পাকিস্তানে বাংলাদেশের মতো ছাত্র-জনতা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ দখল করছে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার স্টাইলে সে দেশের জনপ্রিয় মজলুম নেতা ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে অসংখ্য মিছিল-মিটিং ও বিক্ষোভ করে যাচ্ছে। পাকিস্তানের লাখো জনতার বিক্ষোভে বাংলাদেশের পতাকা বহন করছে মিছিলকারীরা। এই দৃশ্য বিশ্বব্যাপী চমক সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শুরু করা আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের স্টুডেন্টস ফেডারেশন গত ৩০ আগস্টের মধ্যে ইমরান খানকে মুক্তি দিতে সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল। তাকে মুক্তি না দিলে দেশজুড়ে ছাত্র-বিক্ষোভ শুরু করার কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ জানায়, বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং পাকিস্তানে যা ঘটতে পারে, তা প্রতিটি স্বৈরশাসকের জন্যই দুশ্চিন্তা ও দুঃস্বপ্নের কারণ। কর্তৃত্ববাদীরা ও সম্ভাব্য কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকেরা জানেন, তাদের সমালোচক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রাথমিক ঘাঁটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্থিত আন্দোলন তীব্রতর হয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়ার অনেক ঘটনা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হামলা করা ফ্যাসিবাদের জন্য বিপদের আগাম সতর্কবার্তা। তাই সরকার সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বিশেষ নজরদারিতে রাখে এবং সরকারের অনুগতদের দ্বারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত করে।
এ ছাড়া ভারতের হিন্দু মৌলবাদী ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সাল থেকে দেশটি শাসন করছেন। ‘ভারত-বিরোধিতার’ অজুহাতে দেশটির বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের বিশেষ নজরদারি ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় একইভাবে হাঙ্গেরির স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের উল্লেখ করা যায়। বুদাপেস্টে সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সে দেশের স্বৈরতন্ত্রী সরকার ফ্যাসিবাদের দর্শনমতো তাদের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে।
গার্ডিয়ান জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি অনেকটা একই রকমের। ভিন্নমতের লোকদের দমনে সম্ভাব্য কর্তৃত্ববাদীরা ও একদলীয় কট্টর রাজ্যগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়কে নিশানা করছে। তারা সংখ্যালঘু ভোটারদের প্রতি কঠোরভাবে দমন-প্রক্রিয়া চালিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফ্লোরিডার রিপাবলিকান গভর্নর ও সরকারের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বৈষম্য বিরোধের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিক উভয় দলের রাজনীতি কট্টরপন্থা অবলম্বনকারীরা সর্বদাই তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখে চলেন।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী ধ্বংসযজ্ঞ ও একতরফা যুদ্ধের প্রতিবাদে গণহত্যাবিরোধী বিক্ষোভ গোটা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের পুরোভাগে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি শিক্ষার্থীও অংশ নেন। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিসহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল পেশাজীবী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভরত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর ধরপাকড়, দমন-পীড়ন ও পুলিশি নির্যাতনমূলক শারীরিকভাবে আক্রমণ চালানো হয়। ইসরায়েলের একক ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিধ্বংসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনস্থ হোয়াইট হাউস ও ক্যাপিটল হিলের সামনে প্রায়ই লক্ষ জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্র আন্দোলনে প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির বিপক্ষে অবস্থান তো আছেই, উভয় দলেই কর্তৃত্ববাদের প্রভাব রয়েছে। বিগত দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেটি আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
গার্ডিয়ান জানায়, তেমনই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের মনোবল ও অপরিসীম সাহস এবং দৃঢ়তর সংকল্প নিয়ে বাংলাদেশে বিপ্লব সংঘটিত করে তোলে এবং হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়। যেখানে ফ্যাসিবাদীদের সব কৌশল ভেস্তে যায়।
পরিশেষে বলতে হয়, বর্তমান বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে জনগণের প্রতি ভয়াবহ দমন-পীড়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া। ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের সাধারণ নাগরিকের প্রতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এবং নির্দয়-নির্মম, নৃশংসতার মাধ্যমে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটানো। সেটিই মূলত ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যের চূড়ান্ত লক্ষ্য। যুগে যুগে এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদের শাসনের নিকৃষ্টতম বর্বরতা হিসেবে গণ্য হয় এবং ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
 

কমেন্ট বক্স