Thikana News
১৬ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪


 

বিদেশযাত্রার প্রাক্কালের ঘটনাবলি ও বিড়ম্বনা

বিদেশযাত্রার প্রাক্কালের ঘটনাবলি ও বিড়ম্বনা


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরিরত অবস্থাতেই আমি তখনকার সরকারি জনশিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত উচ্চশিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্ত অন্যতম মনোনীত প্রার্থী। বৃত্তির মেয়াদকাল মোট তিন বছর এবং এর মূল লক্ষ্য ছিল বিষয়ভিত্তিক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। বিভিন্ন বিষয়ের জন্য মোট ৫৪ জন প্রার্থী সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২৬ জনকে বিদেশে পাঠানো হবে।
আমি তখন স্রোতে ভেসে বেড়ানো শেওলার মতো আজ এক আশ্রয়ে তো কাল আরেক আশ্রয়ে সওয়ার হচ্ছি। কখনো-বা কাঁঠাল বাগান বাজারের মধ্যে অবস্থিত বন্ধু শাহজাহানের ভাড়া বাসায়, আবার তল্পিতল্পা গুছিয়ে শাহজাহানের আব্বার ক্রয়কৃত দয়াগঞ্জে একটা জরাজীর্ণ হিন্দুদের দোতলা বাড়িতে অবস্থিত মেসে ছোট ভাই নুরুল হকের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছি। হঠাৎ পদার্থবিদ্যার প্রভাষক মো. নূরুল ইসলাম আমাকে একটা প্রস্তাব দিলেন : ‘এনায়েত সাহেব! আপনি কোথায় থাকছেন ইদানীং? আমি তো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস করছি। আমার একটা রুম খালিই থাকে। আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন।’
এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! নূরুল ইসলামকে আমি আগে তেমন একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সে ঢাকা হলের আর আমি এসএম হলের ছাত্র। তা ছাড়া সে আমার এক বছরের সিনিয়র! সুঠাম দেহের অধিকারী, দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল-শ্যাম রঙের নূরুল ইসলাম নাকি ‘ডাইল ইসলাম’ নামেই সবার কাছে সুপরিচিত। কারণ, আবাসিক হলগুলোতে তখন ডাইল আর গামলা-ভর্তি ভাত ছিল সবার ফ্রি! আর এরই বদৌলতে নূরুল ইসলাম তার দেহটিকে বানিয়েছিল একজন বডিবিল্ডারের মতোই। এ কথা ইসলাম ভাই অকপটে স্বীকার করত।
দয়াগঞ্জ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য সরাসরি কোনো বাস সার্ভিস না থাকায় আমাকে প্রায়ই রিকশায় চড়ে কিংবা হাঁটার পথ বেছে নিতে হতো। যাতায়াত সমস্যা এবং পুরান ঢাকার পুরোনো বাড়ির জীর্ণ পরিবেশের কথা চিন্তা করে আমি ইসলাম ভাইয়ের প্রস্তাবটি সাগ্রহে গ্রহণ করলাম।
নূরুল ইসলামের সংসারে তখন একটি কন্যাসন্তান এসেছে সবে। ভাবির ব্যবহার সত্যিই চমৎকার। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই সাদরে গ্রহণ করলেন। পরস্পর জানতে পারলাম, নূরুল ইসলাম ও ভাবি উভয়ের বাবার বাড়ি ফেনী জেলায়। ভাবি তাদের সংসারে সবচেয়ে বড় সন্তান, ইসলাম সাহেবের শ্বশুর রেলওয়েতে গার্ডে চাকরিরত।
মাসখানেক পরই দেখলাম, হঠাৎ ইসলাম ভাইয়ের শ্বশুর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কোয়ার্টারে এসে উপস্থিতি। ফরসা, ছোটখাটো এবং লম্বা দাড়িওয়ালা সজ্জন ব্যক্তি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা। মাথায় একটা গোল টুপি। নূরুল ইসলাম আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল তার শ্বশুরের সঙ্গে। বলল, ‘এনায়েত সাহেব! ইনি আমার শ্বশুর সাহেব। আজই তানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছেন। একটু পরই আবার ওনাকে চাকরির কাজে চলে যেতে হবে। গার্ডের কাজ তো। খুবই দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ।’ আমি ইসলাম ভাইয়ের শ্বশুরকে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে দোয়া করতে বললাম। ওনার বিদায়ের সময়ে ইসলাম ভাইয়ের শ্যালিকা তানিয়াকে দেখতে পেলাম। ফরসা, রোগা-পাতলা শরীরের এক অগ্নিকিশোরী। ইসলাম ভাই তাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আমার আধা-স্ত্রী, অত্যন্ত প্রিয় শ্যালিকা, তানিয়া! ফেনী স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। এখন তো গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ। তাই বাপের সাথে এসেছে বড় বোনকে টুকিটাকি সাহায্য করতে। বিশেষ করে, তোমার ভাবির প্রথম সন্তানটি হয়েছে সিজারিয়ান হয়ে!’
আমি কোনোরূপ কথাবার্তা না বলে শুধু ইসলাম ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সকালের নাশতা এবং দুই বেলার খাবারদাবার টেবিলে পরিবেশনের ভার পড়ল তানিয়ার ওপর। ইসলাম ভাই ও ভাবির প্রচ্ছন্ন লালিত আশা ছিলÑতানিয়া ও আমার মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার! কিন্তু ভবিতব্য, তা ছিল না। তানিয়ার প্রতি আমার সামান্যতম আকর্ষণ বা আগ্রহ জাগেনি। পক্ষান্তরে তানিয়া কেন যেন প্রথম থেকেই আমার প্রতি বিরক্তি ভাব প্রকাশ করে আসছিল!
যাহোক, ইসলাম ভাইয়ের বাসার এ অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে অনতিবিলম্বেই আমি মুক্তি পেলাম। ভাগনি ‘হাসি’ ও ভাগনিজামাই জনাব শামসুজ্জামান খান খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে বদলি হয়ে ঢাকার আইডব্লিউটিএতে পদোন্নতি পেল। ওদের সংসারে তখন একটা ছোট মেয়ে ‘ঈভা’ জন্ম নিয়েছে। ওরা ভাড়া বাসা নিল পুরানা পল্টনে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের উত্তর-পশ্চিম কোণে। হাসি ও জামান সাহেব আমাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাল তাদের সঙ্গে থাকতে। আমি এ সুযোগ হাতছাড়া করিনি। কারণ, ইসলাম ভাইয়ের পেয়িং গেস্ট থেকে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ হতে যেন আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ঢাকায় চাকরি করতে হলে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই যে কতটা দরকার, তা আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। ভাগনির বাসায় অবশ্য বলতে গেলে জামাই আদরেই কাটছিল। হাসির মেয়ে (মাত্র দুই বছর) কথা বলতে শুরু করেছে : ‘মা! আমার শাড়ি কই? আমি নানাকে বিয়ে করব!’ অতটুকু মেয়ে কীভাবে এ কথা উচ্চারণ করল! মায়ের শেখানো বুলি মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাহোক, এ নিয়ে ভাগনি ও ভাগনিজামাই বেশ টিপ্পনী কাটা শুরু করল। মেয়ের আবদার মেটানোর জন্য হাসি বাজার থেকে একটা টুকটুকে লাল রঙের বাচ্চাদের শাড়ি-লিপস্টিক কিনতে কসুর করল না। তবে পুরানা পল্টনের এ ভাড়া বাসায় আমার বসবাস ছিল মাত্র এক বা দুই মাসের!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম অনেক আগেই। সরকারি বেতন চালু রাখতে এবং মায়ের মাসোহারার টাকাটা যাতে ঠিকমতো চলতে থাকে, এ জন্য কুমিল্লার জনতা ব্যাংকে একটা আবেদনপত্র ও নির্দেশ রেখে সেপ্টেম্বর ’৬৭ নাগাদ ঢাকায় এসে বিদেশযাত্রার অপেক্ষায় দিন কাটছে।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দিনক্ষণ ঠিক হলো বিমানযাত্রার। পকেট মানিস্বরূপ জনশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাত্র পাঁচটি পাউন্ড হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। তখন দেশে কোনো কার্ব মার্কেট বলতে কিছুই ছিল না। সুতরাং, বাইরে থেকে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা কিনব, তারও উপায় ছিনা না। জনশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানানো হলো, লন্ডনে পৌঁছে ওখানকার পাকিস্তান হাইকমিশন অফিসে গেলেই আমরা আমাদের বৃত্তির প্রথম মাসের কিস্তি পেয়ে যাব।
অক্টোবর ’৬৭ এর ২ তারিখে আমার জীবনের প্রথম বিদেশ সফরে যাওয়ার কথা। যথাসময়ে ভাগনি হাসির বাসা থেকে ভুরিভোজন শেষে তেজগাঁও বিমানবন্দরে উপস্থিত হলাম যাত্রার তিন ঘণ্টা আগে। আমাকে বিদায় জানাতে শামসুজ্জামান খানের অফিশিয়াল বড় একটা গাড়িতে সঙ্গে এলেন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আগত আমার মেজবু, ছোট ভাগনি মুশি। আর ঢাকায় বসবাসরত ভাগনি হাসি, তার মেয়ে ঈভা এবং ভাগনিজামাই শামসুজ্জামান যান স্বয়ং। তা ছাড়া বন্ধু শাহজাহান ও তার স্ত্রীও কষ্ট করে উপস্থিত হয়েছে বিমানবন্দরে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমাদেরকে জানানো হলো, আজ পিআইএর বিমানটি করাচি থেকে ঢাকায় আসছে না! তাই আজ লন্ডন ফ্লাইটটি বাতিল বলে ঘোষণা করা হলো।
আমরা সবাই হতাশ মনে বাসায় ফিরে এলাম। জানা গেল, ফ্লাইটটি তিন দিন পর সক্রিয় হবে। তিন দিন পর আবার প্রস্তুতি নিয়ে যথাসময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। এবার মেজবু ও খুশি সঙ্গে নেই। শাহজাহানও কী যেন অজুহাতে বিদায় জানাতে এল না! কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়। পিআইএ বিমানটি আজও করাচি থেকে ঢাকায় এল না! আমাদেরকে জানানো হলো, লন্ডন ফ্লাইটটি ৯ অক্টোবর ১৯৬৭-তে ঠিকই চলবে।
অবশেষে তিনবারের সময় পিআইএ বিমানটির দেখা মিলল ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে। হাসি ও জামাই আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। ভাগনি হাসির চোখ দুটো ছলছল করছিল।
টিকিট কাউন্টারে গিয়ে আমার জন্য একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল! দেখলাম, আমার মতো নূরুল ইসলাম ভাইও একই যাত্রাপথের সঙ্গী। তবে ইসলাম ভাইয়ের মনটা বিমর্ষ। চোখে-মুখে কান্নার রেশ সুস্পষ্ট। কারণ, তার স্ত্রী ও কয়েক মাসের শিশুকন্যা ‘পপি’কে গ্রামের বাড়িতে রেখে তাকে বিদেশে যেতে হচ্ছে।
পরিচিত ইসলাম ভাইকে যাত্রাসঙ্গী পেয়ে মনে যেন অনেক সাহসের সঞ্চার হলো। কথা বলে জানতে পারলাম, তিনি গ্লাসগোতে আর আমি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করব। দুটিই যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে অবস্থিত।

 

কমেন্ট বক্স