আগের দিন রাতে হক ভাই আমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, বইমেলায় নাকি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এসেছেন? উত্তরে বলি, হ্যাঁ হক ভাই, এই মুহূর্তে তিনি বইমেলার অডিটরিয়ামেই আছেন।
আমি কি আগামীকাল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি? হক ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ বিনম্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন।
এই সূত্র ধরেই পরের দিন বিকেলে পিএস ৬৯-এ বইমেলায় তিনি এলেন। মধ্য-আশির হক ভাই বেশ আগেই নিউইয়র্কের সেন্ট জন’স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়েছেন। ডক্টর আব্দুল হক, আমার পড়শি, অসামান্য বিনয়ী ও মিতবাক একজন মানুষ। অনেক দুর্লভ গুণের অধিকারী হয়েও তিনি নিরহংকার। সমাজসচেতন ও হিতৈষী। আমরা বেশ কিছু বছর ধরে ওঁর সঙ্গ পেয়ে আসছি। বললাম, আমি তো সকালে বইমেলায় গিয়ে রাতে ফিরব, আপনি কি এতক্ষণ মেলায় থাকতে পারবেন?
না, না। ওসব নিয়ে ভাববেন না। তিনি আগামীকাল কখন বইমেলায় আসছেন জানলেই চলবে। আমাকে কেউ না কেউ নিয়ে যাবেÑবিকেলে স্যারের প্রোগ্রাম আছে। তখন আসলে নিশ্চিত দেখা হবে। আমি হক ভাইকে বলি। যোগ করে বলি, আপনি মেলায় পৌঁছে আমাকে কল করে জানাবেন যে আপনি এসেছেন। আমি একটু চিন্তিত হয়েই বলি। হক ভাই তখন নানা অসুখে ভুগছেন।
পরের দিন আমি সকাল সকাল মেলায় যাই। তখন থেকেই মেলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের শুরুতেই নাশতাসহ বাঙালির আড্ডা ধরনের একটি আসরের আয়োজন ফি বছর নিয়মিত হয়ে উঠেছে। আর এই আসরের প্রাণ দিতে আমাদের সকলের প্রিয় আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, আহমদ মাযহারদের আগমন বইমেলাকে নানাভাবে আলো, আনন্দ, মুগ্ধতা ও জাগরণ দেয়। হাসি-ঠাট্টার মোড়কে এঁদের কথায় মেধা ও সৃজনশীলতার দ্যুতি সারা বইমেলা প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে। মনে পড়ে, একবার ছড়া নিয়ে তাঁদের যাত্রার অভাবিত ও মনোজ্ঞ আড্ডা-প্রায়-আলোচনার কথা। আমি বিস্মিত হয়ে সেদিনের সেই আলোচনা শুনেছিলাম। সেদিন অনুধাবন করি, এঁরা একেকজন সাহিত্য-সাধক; জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, বাঁকে, মানবকুলের প্রতি এঁদের ধ্যান-ধারণা ঝুঁকে আছে।
সেদিন সকাল সকাল এসে দেখি স্কুলের সামনের সড়কের পাশের বেঞ্চে এঁরা তিনজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
বাইরে কেন? ভেতরে আড্ডা! আমি বলি।
আসছি, একজন উত্তর দিলেন।
সেই যে সকালের আড্ডা, নানা অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে কখন বিকেল হলো, টের পাইনি। দোতলায় মূল মঞ্চ ও নিচে প্রকাশকদের বইয়ের স্টল। উপর থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমেই হাতের ডান পাশে বইয়ের স্টলগুলোতে যাওয়ার আগে অল্প একটু পরিসর। দেখি, দেয়ালঘেঁষা একটি চেয়ারে হক ভাই বসে আছেন। আড্ডা আর নানাবিধ সব অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়ে কখন বিকেল হয়েছে জানি না। বেমালুম ভুলেই ছিলাম হক ভাইয়ের কথা। ওঁকে দেখে নিজেকে একটু অপরাধী মনে হলো। জিজ্ঞেস করি, কখন এলেন?
এই তো কিছুক্ষণ হলো। তিনি যোগ করলেন, তিনি আসেননি?
না এখনো আসেননি। এসে যাবেন। বলি, আসুন, ভেতরে আসুন।
হক ভাই বললেন, না এখানেই ঠিক আছি, এই পথ দিয়েই ঢুকবেন তো তিনি? আগের মতো তো হাঁটাহাঁটি করতে পারি না!
আচ্ছা। তিনি আসলেই খবর দেব। এই বলে আমি অন্যত্র অন্তর্নিহিত হই।
স্যারের সেদিন আসতে দেরি হয়। হঠাৎ করেই স্যার সেদিন অসুস্থবোধ করছিলেন। অসুস্থ শরীরেই তিনি এলেন। চারপাশে ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে মুহূর্ত খরচ না করে তিনি সরাসরি মঞ্চে উঠলেন। হলভর্তি দর্শক-শ্রোতাদের তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ করে রাখলেন। আমি নিচে যাই। গিয়ে দেখি, হক ভাই নেই। জানতে পারি, তিনি অপেক্ষা করে করে তাঁর লং আইল্যান্ডের বাড়িতে ফিরে গেছেন। আমার ভীষণ মন খারাপ হলো, নিজের ওপর নাখোশ হই। বেচারা সারাক্ষণ অপেক্ষা করেও স্যারের দেখা পেলেন না। আমার মনটা বিষণ্ন হয়ে রইল।
ভেতরে গিয়ে এক ফাঁকে স্যারকে বললাম, স্যার, হক ভাই এসেছিলেন। স্যার একটু চমকে উঠলেন মনে হলো। বললেন, চলে গেলেন? এটা তো খুব খারাপ হয়ে গেল! না না এটা ঠিক হয়নি, যেন স্বগত বলছেন, একটু থেমে বললেন, সাজেদীন, তুমি আমাকে এখন হক ভাইয়ের কাছে নিয়ে যেতে পারো?
স্যারের ব্যস্ততার পর রাত ন’টার দিকে হবে, আমি, স্যার আর আমার ঢাকা কলেজেরই এক বন্ধু, আমার মতোই স্যারের প্রাক্তন ছাত্র তৌহিদ আর তাঁর স্ত্রী বাবলী, যে আমার আর আমার স্ত্রীরও বন্ধু, বেরিয়ে পড়ি হক ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে।
হক ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন স্যার। সে এক অভাবিত দৃশ্য! হক ভাইয়ের চোখেমুখে সে কী চোখে-দেখার খুশি, নিজ চোখে না দেখলে তার পর্যাপ্ততা অনুমান করা যাবে না! আমরা তিনজন অন্য পাশের সোফায় বসে বহু বছর পরে একদার অত্যন্ত কাছে থাকা দুটি মানুষের মায়া আর ভালোবাসার, স্নেহের আর শ্রদ্ধার চিত্রল দৃশ্য অবাক হয়ে উপভোগ করি। আমাদের প্রিয় শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর একদার শিক্ষক ডক্টর আব্দুল হককে অনেক দিন পরে দেখলেন। স্যার সারা দিনের ক্লান্তি, শারীরিক অসুস্থতা থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও মুক্ত হয়েছেন, আমি অনুভব করি।
হক ভাই নিজ হাতে সেদিন ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে, সেসব মাইক্রোওয়েভে গরম করে স্যারকে পরম যত্নে ও মমতায় রাতের আহারের জন্য দিলেন। আমরাও তার ভাগ পাই। প্রায় মধ্যরাতে আমরা হক ভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হই।
অনেক স্মৃতি বিস্মৃত হয়, আবার অনেক স্মৃতিই জ্বলজ্বল করে জীবনের ছায়া হয়ে রয়। আমাদের নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার আনাগোনাও, অজস্র স্মৃতির মিছিলে দেখি, সম্মুখ কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের সেই রাতের দুটি মানুষের মধুর-অতীতে ফিরে যাওয়ার উন্মোচন-মুহূর্তের-ছবি দেখার সৌভাগ্য ছিল বিরল।
হক ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী থেকে কিছুকাল আগে বিদায় নিয়েছেন।
জীবন মোহরতুল্য; আমি ছিলাম সেদিন, সেই রাতে।
লেখক পরিচিতি : ফেরদৌস সাজেদীন : গল্পকার, নিউইয়র্ক
জুন ২০, ২০২৩