নিউইয়র্ক ‘বাংলা বইমেলা ও বাংলাদেশ উৎসব’ আজ বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই উৎসবের। এর শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালেÑছোট আকারে বইমেলা হিসেবে। এখন ‘নিউইয়র্ক বইমেলা ও বাংলাদেশ উৎসব’ বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া বহির্বিশ্বে সর্ববৃহৎ উৎসব-আয়োজনে রূপ নিয়েছে। ২০১৯ সালে এই উৎসবের ২৮তম আয়োজনে আমি অংশগ্রহণ করেছি। সেবারের মেলার সেøাগান ছিল ‘মননে বই জীবনে বই’। ঢাকা থেকে আমরা অনেকে গিয়েছিলাম বইমেলার ২৮তম আয়োজনে। সেদিন ছিলেন সেলিনা হোসেন, আবুল হাসনাত (মাহমুদ আল জামান), হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ফরিদুর রেজা সাগর, আনিসুল হক, সৈয়দ আল ফারুক, আমীরুল ইসলাম, সৌরভ সিকদার, জাফর আহমদ রাশেদ, হুমায়ূন কবীর ঢালী, হোসাইন কবীর প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ। কবি-সম্পাদক আবুল হাসনাত (মাহমুদ আল জামান) ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁদের স্মৃতি বেশ মনে পড়ছে আজ।
সেবার ‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী শ্রী বিশ্বজিত সাহা আমাকে আগাম আমন্ত্রণ জানান যে, বইমেলায় এলে আমি যেন তাঁর বাসায় উঠি। এর আগেও ২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আমি তাঁর বাসায় উঠেছিলাম। সেবার বাফেলো থেকে নিউইয়র্ক বেড়াতে গিয়ে তাঁর বাসায় উঠি। আমাকে পেয়ে তাঁর যেন অপার আনন্দ ছিল! সাক্ষাতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি আমরা। ‘মুক্তধারা’ নিউইয়র্কে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের জন্য বড় কাজ করে যাচ্ছে। শ্রী বিশ্বজিত সাহা ১৯৯১ সালে নিউইয়র্ক এসে ‘নিউইয়র্ক মুক্তধারা’ শুরু করেন। এটি মূলত বই বিপণন প্রতিষ্ঠান। আমেরিকায় বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে জ্ঞান ও বিনোদনের বই সরবরাহ করে ‘মুক্তধারা’। বিশেষ করে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক বই-পত্রপত্রিকা বাঙালি পাঠকের কাছে সহজলভ্য করে দিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এ যেন ঊষর ভূমিতে অঝোরধারায় বৃষ্টিপতন! এটি ইতিমধ্যে বেশ প্রসার করে নিয়েছেÑব্যবসায়িক সততা ও পরিচালন গুণপনার জন্যই। বিশ্বজিত বাবুকে আমি দেখেছিÑকাজ থেকে আনন্দ খুঁজে নিতে এবং তার জন্য অক্লান্ত শ্রম দিতে। দেশের প্রতি; দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় টান না থাকলে এভাবে কাজ করা ও এ কাজে সফল হওয়া সহজ নয়।
এমনও দেখেছি, আমরা দুজন গল্প করছিলামÑতখন কোনো ব্যবসায়িক ফোন এল, ফাঁকে ব্যবসার কাজ সেরে ফেললেন। বন্ধুর সঙ্গে বেশ আন্তরিক তিনি। তাঁর সঙ্গে থাকাটাÑবেশ আনন্দের হয়! আমিও বেশ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। সকালে ঘুম থেকে উঠে কখনো তাঁর কর্মদপ্তরে, নয়তো কোনো বন্ধু-আড্ডায় চলে যেতাম। বিশ্বজিত বাবু খবর রেখেছেনÑকখন কোথায় থাকছি। নিজের অতিথির প্রতি এটাও বড় দায়িত্ব পালন-তাঁর মধ্যে দেখেছি। রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ গল্প, তারপর যার-যার মতো ঘুমুতে যেতাম। তিনি খুব সকালে ওঠেন। যখন বেরিয়ে যেতেন, তখনো আমি ঘুমে। একবার ডাক দিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। আমার সময়মতো আমি উঠে বের হতাম।
ভাবতে ভালো লাগে-নিবেদিতপ্রাণ এই বাঙালি কর্মবীর ও দূরদর্শী বিশ্বজিত সাহা ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। একই বছর শুরু করেন নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা, প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। উদ্দেশ্য ছিল ভাষার গুরুত্ব ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবাসী বাঙালি প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। সেই লক্ষ্যে বইমেলার আয়োজনÑযাতে বাংলা ভাষার সেরা লেখকদের সমাবেশ ঘটে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয় ২০০৭ সালে। তখন থেকে এই সংস্থা একটি নির্বাহী কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। ফাউন্ডেশন বিগত ৩১ বছর যাবৎ বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি ও বাঙালির ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালি ও এর তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কাজটি করে আসছে। একই সঙ্গে উত্তর আমেরিকার বাংলাভাষী বিশিষ্টজন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজও করে যাচ্ছে।
নিউইয়র্ক বইমেলা ও বাংলাদেশ উৎসবের আলোচনা, স্মৃতিচারণা ও সাহিত্যপাঠের যে আয়োজন, তার মধ্য দিয়ে মোটা দাগে বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হচ্ছে। প্রবাসী বাঙালি প্রজন্ম যাতে নিজের সত্তাকে ভুলে না-যায়, যেন নিজের শিকড়মুখী থাকে-বইমেলা ও বাংলাদেশ উৎসবের সেটাই উদ্দেশ্য। ২০১৯ সালে বইমেলায় আমি যোগ দিয়েছিলাম। বইমেলার আয়োজন ছিল ১৫ থেকে ১৮ জুন। আমি সস্ত্রীক ফ্লোরিডা এসেছিলাম ১৮ মে কন্যার কাছে বেড়াতে। জুনের প্রথম দিকে ফিলাডেলফিয়ায় ছোট মেয়ের কাছে চলে আসি, সেখান থেকে নিউইয়র্ক খুব দূরে নয়। বাসে সহজে চলে এলাম। এসব ভ্রমণ আনন্দের হয়। যোগাযোগ হলো নিউইয়র্ক প্রবাসী কবিবন্ধু মাহবুব হাসানের সঙ্গে। মাহবুব হাসান বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বিশিষ্ট কবি। আমি যে-কদিন নিউইয়র্কে ছিলাম, মাহবুব হাসান আমাকে আনন্দময় সঙ্গ দিয়েছিল। আড্ডায় বাংলাদেশি অন্য বন্ধুরাও কেউ কেউ যোগ দিত। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকা যেন খুদে বাংলাদেশ। বইমেলায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বেশ কয়েকজন প্রকাশক অংশগ্রহণ করেন। বইমেলার পরিসর ছোট হলেও পাঠক-ক্রেতার উপস্থিতিতে প্রবাসী বাঙালিরা এতে দেশের আমেজ ফিরে পায়।
২০১৯ সালের বাংলা বইমেলা ও বাংলাদেশ উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন ড. নজরুল ইসলাম। চার দিনব্যাপী এই বইমেলায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লেখক-পাঠক ভাবনা বিনিময়, পুরস্কার বিতরণী ইত্যাদি নানান কর্মের সম্যক আয়োজনে বাংলার সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছিল। আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে আমিও অংশগ্রহণ করেছি। মেলায় দেখা হয়েছিল ড. নুরুন নবী, ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, হাসান ফেরদৌস, জামালউদ্দিন হুসেইন, ফাহিম রেজা নূর, রোকেয়া হায়দার, ফেরদৌস সাজেদীন, গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, আদনান সৈয়দ, কৌশিক আহমেদ, আহমদ মাযহার, বেলাল বেগ, জীবন চৌধুরী, শাম্স আল মমীন, ফারুক ফয়সাল, আবেদীন কাদের, তমিজ উদ্দীন লোদী, ড. হুমায়ূন কবির, ফকির ইলিয়াস, ফারহানা ইলিয়াস তুলি প্রমুখের। আয়োজনের আরেক বড় আকর্ষণ পুরস্কার। সেবার কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য মুক্তধারা ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন দিলারা হাসেম। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য মুক্তধারা লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড পান ডা. ওয়ালেদ চৌধুরী ও সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য ফরিদুর রেজা সাগর। এ ছাড়া ২০১৯ সালের চিত্তরঞ্জন সাহা সেরা প্রকাশক পুরস্কার পায় বেঙ্গল পাবলিকেশনÑঢাকা এবং সেরা বুক স্টল পুরস্কারও পায় বেঙ্গল পাবলিকেশন-ঢাকা।
নিউইয়র্ক স্টেট সিনেট ২০১৯ সালে ২৫ সেপ্টেম্বরকে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ হিসেবে অনুমোদন দেয়। প্রতিবছর নিউইয়র্ক স্টেটে দিনটি যথামর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। এ-ও বাঙালির এক বড় অর্জন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। সেই বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী বিশ্বজিত সাহা স্টেট সিনেটে আবেদন করেছিলেন। দিনটি বাঙালির জন্য আনন্দের ও গৌরবের।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পর বিশ্বজিত সাহা ছাড়াও এর সঙ্গে আর যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা হলেন জ্যোতির্ময় দত্ত, হাসান ফেরদৌস, আলোকিতা মুখার্জি, ড. নুরুন নবী, ড. সৌরি পি ভট্টাচার্য, নুরুল আমিন চৌধুরী, ড. সমর সরকার, ড. এম রফিকুজ্জামান. দিলারা হাসেম, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, সাউদ চৌধুরী, নাসিমুন ওয়াহেদ, জামালউদ্দিন হুসেইন, ফাহিম রেজা নূর, ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, রোকেয়া হায়দার, ফেরদৌস সাজেদীন, ড. নজরুল ইসলাম, গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, তানবীর রাব্বানী, আদনান সৈয়দ, রানু ফেরদৌস, শামসাদ হুসাম, ড. জিনাত নবী, ড. ফাতিমা আহমেদ, কৌশিক আহমেদ, আহমদ মাযহার, নুসরাত সাহা আজাদ, জাকিয়া ফাহিম, ওবায়দুল্লাহ মামুন, সাবিনা হাই উর্বি, ইউসুফ রেজা, হারুন আলী, শুভ রায়, মুরাদ আকাশ, সীমন্তী ওয়াহেদ প্রমুখ। বহির্বিশ্বে এঁরাই ধরে রেখেছেন বাঙালিসত্তাকে। ভাবতে গর্বে বুক ভরে যায়, বাঙালিরা পারে। তাঁরা নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিতে শেখেনি, প্রকৃত বাঙালিরা নিজের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করতে পারে না, করেও না। বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে আমরা চলেছি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরেÑএ আমাদের অহংকার। পৃথিবীর বুকে বাঙালিরা আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ভাষাশহীদ দিবস ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছেÑযা বাঙালির বীরত্বের প্রতীকরূপে প্রতিভাত এখন। বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।
লেখক পরিচিতি : কবি, বাংলাদেশ। কবিতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত হয়েছেন।