আমি প্রথমবার নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় যাই ২০১৮ সালে, সম্ভবত জুন মাসে। তারপর ২০১৯ ও ২০২১ সালে। বইমেলায় গিয়ে দেখি ছোটখাটো একটা ঢাকা, একটা বাংলাদেশ। বইমেলায় আসা প্রায় প্রত্যেকে প্রত্যেককে চেনেন। ঢাকার সঙ্গে নিউইয়র্কের পার্থক্য হলো, ওখানে সবাই এককাতারে নেমে আসেন। তাতে কারও কোনো সমস্যা হয় না। ২০১৮ সালে আমার বাম পাশে বাংলা একাডেমির স্টলে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আমরা যখন কলেজে পড়ি, আবুল হাসনাত ছিলেন কিংবদন্তির মতো। প্রথম আলোতে কাজ করার সময় তাঁর সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতা হলেও কথাবার্তা বেশি হতো না। নিউইয়র্ক বইমেলায় যাওয়ার পর তিনি বিশ্বজিত দাদাকে বললেন, আমাকে (অর্থাৎ বেঙ্গল বইকে) রাশেদের প্রথমার পাশে দাও। তাঁকে দেওয়া হলো আমার ডান পাশে। তিনিও দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নিজ হাতে বই বিক্রি করেন। এর মধ্যে নানা টোনে চলে আড্ডা। ওখানে সবাই যেন স্বেচ্ছাসেবক। কোথাও যেতে হলে কাউকে যদি বলি একটু বসুন, সঙ্গে সঙ্গে সাড়া মেলে। ঘুরে এসে দেখি ৫০ ডলার বেচে ফেলেছেন। আমাদের প্রতি তাঁদের গভীর আন্তরিকতা আমাকে উদ্বেলিত করেছে।
খুব কি বিক্রি হয়? তা না হয়তো। কিন্তু অনেককে দেখেছি, আমরা যেন স্বস্তি পাই সে জন্য প্রয়োজন না হলেও বই কিনেছেন। কাজের কারণে হয়তো খেতে যেতে পারিনি, কেউ একজন খাবার নিয়ে এসেছেন। কেউ বাড়িতে নিয়ে খাইয়েছেন। নিজের কিছু কেনাকাটার জন্য কাউকে অনুরোধ করেছি, সঙ্গ ও সহযোগিতা দিতে কেউ দ্বিধা করেননি। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন নিউইয়র্কের মতো জায়গায় যে বইমেলা করে, তার অনন্যতা ঠিক বাণিজ্যে নয়, গভীর আন্তরিকতায়। যেকোনো উদ্যোগের কিছু না কিছু অসম্পূর্ণতা থাকে। এই বইমেলায়ও আছে, থাকে। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার অসম্পূর্ণতাটুকু আন্তরিকতার চাদরে চাপা পড়ে যায়।
২০১৭ সালে আমি প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক আর প্রথমা প্রকাশনের চিফ কো-অর্ডিনেটর। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান উদ্যোগী হয়ে তাঁর নিজের, আমার আর সেলিম খানের ভিসার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার ভিসা চাওয়া হয়েছিল মুক্তধারার নিউইয়র্ক বইমেলায় যাওয়ার জন্য। ভিসার আবেদনের সঙ্গে আমন্ত্রণপত্র জমা দিয়েছিলাম। সেখানে মেলার তারিখ ছিল। কিন্তু ইউএস এমবাসি যেদিন আমাদের ভিসা দেয়, সেদিন ছিল বইমেলার শেষ দিন। ফলে আমার প্রথম যাওয়া ২০১৮ সালে। ২০২২ সালে আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ভিসা নবায়নের আবেদন করেছিলাম সেই এপ্রিলে। এতে ১৫ দিনের বেশি লাগে না। ঘোরাঘুরিও করতে হয় না সাধারণত। আমাকে করতে হলো এবং অবশেষে এমন সময় ভিসা পেলাম, যখন আমার সামনে দিয়ে বন্দরের শেষ জাহাজ বিদায় নিয়েছে। ২০২২ সালের বইমেলায় তাই যাওয়া হলো না।
বইমেলায় গিয়ে অনেক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়াÑকত রাজ্য কত জনপদেই না ঘুরেছি। সবই বন্ধুদের কল্যাণে। এই বইমেলায় আমি তিনবার গিয়েছি। গিয়ে কী পেয়েছি সেটা মুখে বা লিখে বলা প্রায় অসম্ভব। যদি শুধু একটা পাওয়ার কথা বলি, সেটা হলো বন্ধু। নিউইয়র্ক আমার জন্য সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গা। অতলান্তিকের ওপারে। এই অচেনা সুদূরে আমি এমন কিছু বন্ধু পেয়েছি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে-বন্ধুত্বের কোনো তুলনা হয় না। ফলে আমি যখন নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার কথা ভাবি, নিজেকে যেন এর সঙ্গে যুক্ত দেখতে পাই। ২০২২ সালের বইমেলায় আমি ছিলাম না। কিন্তু ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’।
তখন আমার মনের গোপন বাঁশিটা মগ্ন হয়ে রাতভর দিনভর বেজে চলেছে, আমাকে করুণা করেছে... আমাকে তো অনেকে ভালোবাসে, করুণা করে হলেও বাসে, হয়তো অনেক দূরে, তবু আমি তাদের দিকে আমার দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছিলাম। এবার কিন্তু যাচ্ছি নিউইয়র্ক বইমেলায়। বইমেলার জন্য, বন্ধুদের জন্যও।
লেখক পরিচিতি : কবি, সম্পাদক এবং বর্তমানে বাতিঘর প্রকাশনীর সঙ্গে জড়িত, বাংলাদেশ।