প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনার পরিবারের ছয়জনকে পূর্বাচলে ১০ কাঠা করে দেয়া প্লট বাতিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। আরো যাদের তিনি মুক্তহস্তে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলেন সেগুলোর কী হবে? সেখানে কি অন্যায় হয়নি? বিশেষ কোটা, দেশের জন্য ‘অসামান্য অবদান’ দেখিয়ে প্লট বাগিয়ে নেয়া ৮৩০ প্লটের কী হবে এখন?
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এভাবে রাজউককে দিয়ে জমি দখল করিয়ে উত্তরা-পূর্বাচলে আওয়ামী পল্লী বানিয়েছিল। তা নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু, কারো শাস্তি বা বিহিত হওয়ার খবর নেই। ২০০৮ সাথে আবার ক্ষমতায় এসে সেই কাজ আরো বেশি করেছে আওয়ামী লীগ। এবার কী হবে, এখনও কি নিশ্চিত? শুধু শেখ হাসিনার পরিবারের প্লট বাতিল এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা কি বৈষম্য হয়ে গেলো না?
রাজউকের প্লটের আয়তন ৩, ৫, ৭, সাড়ে ৭ ও ১০ কাঠা। সংরক্ষিত কোটায় প্লট পাওয়া কেউ কেউ তা বিক্রিও করে দিয়েছেন। পূর্বাচল নতুন শহর, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প ও ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের প্লটগুলো তারা পেয়েছেন কাঠাপ্রতি মাত্র ২ থেকে ৩ লাখ টাকায়। যদিও এসব প্লটের বাজারমূল্য তখনো বহুগুণ বেশি ছিল। এখন এসব প্লটের কাঠাপ্রতি বাজারমূল্য কোটি টাকার বেশি। শেখ হাসিনার নিজের নামে, পরিবারের সদস্যদের নামেও প্লট বরাদ্দ হয়েছে। হাসিনার নামে বরাদ্দ হয়েছে পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট। তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ এবং ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী ১০ কাঠা করে প্লট পেয়েছেন পূর্বাচলে। সব মিলিয়ে এই পরিবারের ছয়জন মোট ৬০ কাঠা জমি পেয়েছেন। তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ নেয়ায় হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ছয়জনের নামে সম্প্রতি মামলা করেছে দুদক। শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে ও যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশও পূর্বাচলে প্লট পেয়েছেন। আরো অনেকেই পেয়েছেন। তা হলে প্রশ্ন কেন? প্রশ্ন অসামান্য অবদান নিয়ে। সেটা কী? কেমন?
রাতের ভোট করার কাজে অসামান্য অবদান ২০১৮ সালের নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীনের তো ছিলই। অবদান রাখার জন্য ভোটের পাঁচ মাস আগে পূর্বাচলে রাজউকের সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট দেয়া হয়। তার এখন দিন কাটছে কারাগারে। ২০১৪ সালে নবম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনের পর সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন পিনু খান। তাঁর ছেলে বখতিয়ার আলম ওরফে রনিকে ২০১৩ সালে জাতীয়ভাবে ‘অসামান্য অবদানের’ জন্য রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে একটি প্লট দেয়া হয়। ২০১৫ সালে বখতিয়ার আলম রাজধানীর ইস্কাটনে যানজটে আটকা পড়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে দুই রিকশাচালককে হত্যা করেন। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় ২০১৯ সালে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কী অসামান্য অবদান?
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন নবম, দশম ও একাদশ সংসদের এমপিরা। এর বাইরে ’অসামান্য অবদান’ রাখা ব্যাক্তিদের মধ্যে ৩০ জন সাংবাদিক, ৩০ জন শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্ম্ওী রয়েছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা, এই ঘরানার ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, বিচারপতি, প্রবাসী, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো থাকবেনই। শেখ হাসিনার অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত সহকারী বা গাড়িচালকরাই বা থাকবেন কেন?
রাজউক ১৯৬৯ সালের ‘অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলসের’ আওতায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বিধিমালাটি ১৯৮৬ সালে সংশোধন করে একটি নতুন উপবিধি (১৩/এ) যুক্ত করা হয়। সেখানে ‘অসামান্য অবদানের’ জন্য প্লট বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ রাখা হয়। ২০০৯ সালে উপবিধিটি সংশোধন করে ১২টি পেশা/শ্রেণি নাম উল্লেখ করা হয়, যাঁরা প্লটের জন্য অসামান্য অবদান কোটায় আবেদন করতে পারবেন। ওই ১২ পেশা/শ্রেণি হলো- মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, সরকারি চাকরিজীবী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবী, সশস্ত্র বাহিনী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বেসরকারি চাকরিজীবী; শিল্পী, সাহিত্যিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব; বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এবং অন্যান্য। অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কৃত করার রেওয়াজ সব দেশেই আছে। কোনো ব্যক্তিকে অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কার হিসেবে প্লট-ফ্লাট বা কিছু দেয়া হলে অবদানের একটা ব্যাখ্যা দরকার। অবদানটাই না জানলে কেমনে কী?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন, ঢাকা।