Thikana News
২৫ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

স্বৈরাচারের দেড় দকশ

২০২০ থেকে ২০২২ শুধু এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকায় দুবাই, আবুধাবিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশিদের দ্বারা অন্তত এক লাখ প্রতিষ্ঠানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
স্বৈরাচারের দেড় দকশ



 
অনিয়মের অনাচার
(পূর্ব প্রকাশের পর)

শেখ হাসিনা একটা বিষয়ে খুব সততার পরিচয় দিয়েছিলেন, আর তা হলো তার অধীনদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো তিনি নিজের মতো করেই বিবেচনায় এনে তাদেরকে সমানতালে সুযোগ করে দিতেন। এবং সেটা করে গেছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে, যেমন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা সরকার দেশের অর্থনীতির দিকে চূড়ান্ত মাত্রায় ঝুঁকে পড়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন করে ১২টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিলেন তখন। সেই অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ‘দেশের অর্থনীতি কিংবা ভৌগোলিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই কথাটা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক বিচেনায় লাইসেন্স দিচ্ছি।’ এই রাজনৈতিক বিবেচনার স্বরূপ হলো সরকারের মদদপুষ্ট একটি অসৎ গোষ্ঠীর হাতে অর্থনীতির চাবিকাঠি তুলে দেওয়া। যার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার সূচনা ঘটে এবং মূল নেতৃত্ব চলে আসে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর হাতে। সেই গোষ্ঠীর অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী রাজনৈতিক বিবেচনায় যে চারটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ছাড়পত্র দিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন, তার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল শেখ হাসিনা ও জয়ের তাগিদ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ লাভ করেছিলেন ড. আতিউর রহমান। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ব্যাংকে তার চার বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ২০১২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো গভর্নর পদে আবার তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার আমলেই ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। ঘটনাটা জানতেন জয়। তাকেই জানানো হয়েছিল বিষয়টা, কারণ তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা পদে দায়িত্বরত ছিলেন এবং তার পরামর্শেই ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যদিও ওই বিষয়ে অর্থের একটা লেনদেন ছাড়া আর কোনো অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। ওই আতিউর রহমানের দায়িত্ব পালনকালীন বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালে একসঙ্গে ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছিল। যার জন্য সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশ ছিল বলে একাধিক সূত্রের তথ্য ছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো গভর্নর আতিউর রহমান এবং সজীব ওয়াজেদ জয়ের সখ্যকালীন ওই সময়টাতেই বেসিক ব্যাংক লুট, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটেছিল। আসলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কিছুরই নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করতেন সজীব ওয়াজেদ জয়। আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর যখন অন্য গভর্নর দায়িত্বে আসেন, তখনো একই অবস্থা ছিল। ২০১৬ সাল থেকে একের পর এক বেসরকারি ব্যাংকের ওপর ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস রচনার পর্যায়ে এসে এস আলম গ্রুপের কবলে পতিত হয় ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক। একইভাবে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক দখলে নেয় আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান বাবুর পরিবার। আইএফআইসি ব্যাংকের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন সালমান এফ রহমান এবং এনআরবি ব্যাংক দখলে নেন মাহতাবুর রহমান নাসির। এসব ব্যাংক দখলে সহযোগিতা করেছে খোদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের তখন অনেকটা দলীয় নেতাদের মতো সেবাদানের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। ব্যাংক লুটেরাদের মধ্যে এস আলম গ্রুপ একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই লুট করে নিয়ে গেছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে সালমান এফ রহমানের কাছে সাত ব্যাংকের ঋণ ছিল ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তাকে বলা হতো দেশের আর্থিক খাতে ধস নামানোর কুখ্যাত কারিগর। বিগত ১৫ বছরে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট আর জালিয়াতির নজির সৃষ্টিকারী এই ব্যাংক ডাকাত শেখ হাসিনার ডান হাত নামে পরিচিত ছিলেন। যেসব ব্যাংকে তার ঋণ আছে, তা হলো জনতা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। এর ভেতরে রয়েছে সরকারি ব্যাংক চারটি এবং বেসরকারি তিনটি। এই মানুষটি আশির দশক থেকেই শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন-বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় দায়িত্ব পালনের সূত্রে শেখ হাসিনার খুব নিকটজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রথম তার নাম উচ্চারিত হয়েছিল। ২০১১ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির বক্তব্য ছিল বিতর্কিত। এর আগে ২০০৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি অপরাধ এবং দুর্নীতির ১১টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন।
এ ছাড়া দেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রাখা দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন হলেন ফারুক খান এবং অন্যজনের নাম আজিজ খান। এই দুই ভাইয়ের সম্মিলিত ব্যবসা সামিট গ্রুপের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। এই সামিট গ্রুপের সঙ্গে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং জয়ের গভীর যোগসূত্র ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে জ্বালানি খাতে বিশেষ আইন ২০১০ পাস করা হয়। ওই বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়ে সামিট গ্রুপ কুইক রেন্টাল চালুসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ইতিহাস তৈরি করেছিল। শুধু এই সামিট গ্রুপের সুবিধার জন্য দেশের প্রচলিত আইন পর্যন্ত পাল্টাতে দ্বিধা করেনি সরকার। বলা হতো, বিদ্যুতের মাফিয়া হলো সামিট গ্রুপ। এই মাফিয়া ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা, বিনিময়ে নিশ্চয়ই তার এবং তার বোনের পরিবারের সদস্যদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রভূত উন্নতির বিষয়টা জড়িত ছিল।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ শিরোনামে ৩৯৬ পৃষ্ঠার একটি খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বিগত শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলের চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে মন্তব্য করেছেন, ‘হাসিনা শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চামচা পুঁজিবাদ থেকে সরাসরি চোরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল।’ শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বিগত ১৫ বছরের ইতিহাসে লুটপাটের এক মহোৎসব পরিচালিত হয়েছে এবং প্রতিবছর গড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার হিসাবে গত কয়েক বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে এসব লুটেরা অসৎ গোষ্ঠীর হাত দিয়ে। শ্বেতপত্রে মোট ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, লুণ্ঠনের কারণে দেশের ব্যাংকিং, জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত কী করে ধ্বংসের শেষ সীমায় টেনে নামিয়েছে ওই লুটেরা সম্প্রদায়। এবং সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবে থাকা ব্যাংকগুলোর মদদেই মূলত টাকা পাচার হয়েছে। ‘দুবাই আনলকড’ নামের অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট এই টাকা পাচার-সংক্রান্ত একটা খবর প্রকাশ করেছে সম্প্রতি, সেখানে তারা দেখিয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২২ শুধু এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকায় দুবাই, আবুধাবিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশিদের দ্বারা অন্তত এক লাখ প্রতিষ্ঠানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া অ্যাটলাস অব অফশোর ওয়ার্ল্ড আরেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্বের ট্যাক্স হেভেন দেশগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার অফশোর সম্পদ রয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১.৩ শতাংশের মতো। এর আগের এক সময়ে প্যান্ডোরা পেপার্সেও টাকা পাচারকারীদের তালিকায় বাংলাদেশিদের নাম এসেছিল। এফবিআইয়ের মতে, ৯০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে দুবাই নগরীতে। এই পাচারকৃত টাকা দিয়ে ওই অসৎ গোষ্ঠী বিলাসবহুল অট্টালিকা কিনে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে। দুবাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি ১৩৪ ব্যক্তি মোট ৮৪৭টি ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে প্রকাশিত এক খবরে প্রকাশ, যার মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা থেকে শত কোটি টাকা পর্যন্ত। এদের মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে রয়েছে ১৩৭টি ফ্ল্যাট ও হোটেল অ্যাপার্টমেন্ট, সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পুত্রের নামে নিউইয়র্কে রয়েছে অনেকগুলো বাড়ি। দেশের শেয়ারবাজার থেকে এই লুটেরা গ্রুপের কয়েকজন কমপক্ষে ২৭ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে, এটাও লুকানো কোনো বিষয় নয়, কারণ সবকিছুই তো ঘটেছে বিগত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ছত্রচ্ছায়ায়।
চলতি জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে এই অবৈধ টাকা লেনদেনের অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিক সেক্রেটারি টিউলিপ সিদ্দিক। বাংলাদেশের পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ছোট বোনের কন্যা তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। প্রবাসী এক আওয়ামী লীগ নেতার দানকৃত বাড়িতে বসবাস করলেও তার দাবি অনুযায়ী বাড়িটি তার পিতার ক্রয়কৃত ছিল। একইভাবে তার ছোট বোনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। এমনকি তার মা শেখ রেহানা লন্ডনের অভিজাত পাড়ার যে বাসায় বাস করেন, সেই বাড়িটিও তিনি পেয়েছেন মাফিয়া-সম্রাট সালমান এফ রহমানের পুত্রের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার বংশ প্রায় শেষ হয়ে গেলেও তার রেখে যাওয়া দুই কন্যার উত্তরাধিকারীদের কারণে কবরে গিয়েও তাকে মাশুল গুনতে হচ্ছে। এতটাই দুর্ভাগ্য জাতি আমরা যে সেই কথাগুলো শুনতে হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর উপহাসমূলক কথাবার্তা থেকে। তবে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না-তার প্রমাণ হলো সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের কারণে আরও একবার কথিত জাতির জনকের কন্যাকে অপমানের মালা গলায় পরতে হবে। অনেকের হয়তো মনে আছে, বছর কয়েক আগে শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাবেক স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন টাকা পাচারের অভিযোগে দুবাইয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। সেই আটকের খবরে শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত তখন দুবাইয়ে ছুটে যেতে হয়েছিল। আসলে এসব ব্যাপারে শেখ পরিবারের সদস্যরা কেউ কারও চেয়ে কম নন। জয়ের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতাটা একটু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই অতি সম্প্রতি একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, তার মা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জয় তার মায়ের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এ ছাড়া জয়ের মালিকানাধীন বিলাসবহুল আটটি গাড়ির সন্ধান পাওয়া ছাড়াও তার নামে পাঁচটি কোম্পানির সন্ধান মিলেছে। ওইসব গাড়ির অনেকটির মূল্য মিলিয়ন ডলারের ওপরে। জয়ের ওয়াজেদ কনসালটিং ইনকরপোরেট সংস্থাটি বাংলাদেশে অনেক ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। জয়ের সাবেক স্ত্রী ক্রিস্টিনের সঙ্গে যৌথ অ্যাকাউন্টেও অনেক সন্দেহজনক লেনদেনের হিসাব পাওয়া গেছে বলে এফবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
আসলে শেখ হাসিনার হৃদয়ে কখনো দেশপ্রেম বলে কিছু ছিল না। ৭৫-পরবর্তী লন্ডনে অভিবাসী জীবনের একপর্যায়ে এসে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার পরিবারের সদস্যদের যারা খুন করেছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য এক দিনের জন্য হলেও তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে হবে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই দেশে ফেরত এসেছিলেন তিনি এবং বুঝেছিলেন ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে আর্মি ও পুলিশ প্রশাসনকে হাতে রাখতে হবে। সে উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করে গেছেন তিনি। প্রশাসনের উঁচু মহলে নিয়োগ দিয়েছেন নিজেদের নিকটাত্মীয়দের। বর্তমানে সেনাবাহিনীর প্রধান যিনি, তিনিও তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এ ছাড়া পুলিশ প্রশাসনকে তার কুড়ি বছরের শাসনামলের পুরোটা সময়জুড়ে নাকের আগায় মুলা ঝোলানোর মতো করে টোপ দিয়ে রেখেছিলেন। পুলিশের লোগো হচ্ছে নৌকা প্রতীক। এই লোগো প্রথমে ব্যবহার করেছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জিতে শেরেবাংলা এবং সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিতে যুক্তফ্রন্ট সরকার। এই নৌকা হচ্ছে আওয়ামী লীগের লোগো মার্ক। সেই ৫৪ সালের পর দেশে কতটা সরকার এল আর গেল কিন্তু পুলিশের সেই নৌকা মার্কাটার প্রতি খেয়াল দিল না কেউ। ফলে শেখ হাসিনার পুরোটা শাসনামলে পুলিশের পরিচয় আওয়ামী লীগের অধীন ‘পুলিশ লীগ’ হিসেবে। এই পরিচয় বহন করতে গিয়েই কত অনাচার আর অবিচারের জন্ম। কত বেনজীর, মতিউরের জন্ম। আসলে পৃথিবীতে কোনো কিছুই একতরফা হয় না। রবি ঠাকুরের ভাষায় : ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’, অর্থাৎ দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়েই সম্পর্ক শুধু গড়ে ওঠে না, সম্পর্কটা পাকাপোক্তও হয়। যেভাবে পুলিশের পুরো বাহিনীর ওপর শেখ হাসিনার স্নেহের হাত প্রসারিত হয়েছিল, সেই পথ ধরেই কালাকানুনের অনুপ্রবেশ। প্রথমত, সীমাহীন দুর্নীতির টোপ দিয়ে এবং পরে কাক্সিক্ষত পদায়ন, প্রমোশন ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বীরত্বসূচক পদক প্রদানের ভেতর দিয়ে সেই দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদেরকে পুলিশের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল শেখ হাসিনা সরকারের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ‘জনতার পুলিশ’ শব্দের বিপরীতে ‘আওয়ামী পুলিশ’ দেশের আপামর জনগণের জন্য এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ‘সাগর-রুনি’ হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে এই পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ স্থানে থাকা মানুষটির নাম অনেকের জানা থাকলেও উচ্চারণ করতে ভয় পেতেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচারের নামে ‘গুম’ করে দেওয়ার ভয়ে। আরেকটা শব্দ ওই আমলে খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হতো, তা ছিল ‘গায়েবি মামলা’। ওই গায়েবি মামলায় ১৫ বছরে অনেক মানুষকে দিনের পর দিন এমনকি মাস শেষে কয়েক বছর ধরে ‘আয়নাঘর’ নামক টর্চার সেলে বন্দী করে রেখে বিরুদ্ধ মতের মানুষদের ওপর অন্য ধরনের এক পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। ভাগ্য ভালো থাকলে কাউকে ছেড়ে দেওয়া হলেও অনেকের নামই শোনা যায় আজ নাইয়ের তালিকায়। ওই আয়নাঘর কেবল বাংলাদেশে ছিল না; ভারতের কয়েকটি জায়গায়ও গড়ে উঠেছিল। যেখানে বন্দীদের বন্ধ ঘরে আবদ্ধ রেখে নির্যাতন চালানো হতো। এককথায় পুলিশের রাজনীতিকরণের ইতিহাস ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরের সময়কালের অকৃত্রিম প্রচ্ছায়ায়। জানা যায়, শুধু ওই সময়কালে পুলিশ বাহিনীতে লোক নেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার। ওই ক্যাটাগরিতে আবার নিয়মবহির্ভূতভাবে কাউকে নেওয়া হয়নি। কিছু নিয়ম মেনেই ওই দেড় লাখ সদস্য বাছাই করা হয়েছিল। তার মধ্যে প্রথম শর্ত ছিল, জন্মসূত্রে বৃহত্তর ফরিদপুরের বাসিন্দা হতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, ছাত্রলীগ করেছিল ছাত্র জমানায় এমন কাউকে বাছাই করতে হবে। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে হবে। চতুর্থত, সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য, যারা আওয়ামী লীগের প্রতি দায়বদ্ধ রয়েছে এবং পঞ্চম শর্ত কূটকৌশল বাস্তবায়নে পারদর্শিতার প্রমাণ রয়েছে। এসব নিয়ম মেনে নিয়েই পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কারণ শেখ হাসিনা স্পষ্টতই প্রমাণ পেয়েছিলেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে তার বিশ্বাসী পুলিশ বাহিনীর আনুগত্য দরকার আর সে কারণে বলা হয়ে থাকে, তার আমলে যে তিনবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই তিনবারের নির্বাচনে দলীয় লোকের আনুগত্য নয়, পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতার বিষয়টাই মুখ্যত প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার দেড় যুগের শাসনামলের শেষের চার বছরে সবচেয়ে বেশি গুম আর খুনের ঘটনা ঘটেছে এই খুনিদের হাতে। হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে গুমের শিকারে পরিণত হয়ে নিহত হয়েছেন ৯ জনের মতো। সেই হিসাবে ১৬ হাজার মানুষ মারা গেছেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়ে। এমনকি ওই গুম-খুনের তালিকায় দেশের আলেম-ওলামারাও ছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে হেফাজতে ইসলাম আহূত জনসভায় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির তাণ্ডবের কথা নিশ্চয় মনে আছে অনেকেরই। সাউন্ড গ্রেনেড ছাড়াও শত শত গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে চরম এক ভীতিকর অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। কতজন মানুষ মারা গিয়েছিলেন ওই রাতে, সেই হিসাব জানা ছিল না অনেকেরই। তবে হেফাজতের দাবি ছিল অগণিত লাশ ওই রাতে পুলিশ সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঘটনাস্থল থেকে। ওই সব ঘটনায় র‌্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীরের নাম এসেছিল। বেনজীর এখন দেশের বাইরে। কিন্তু র‌্যাবের সাবেক আরেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান পুলিশের হাতে বন্দী। তাকে আদালতে তোলা হলে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম তাকে উদ্দেশ করে ‘বসনিয়ার কসাই’ বলে মন্তব্য করেন। (ক্রমশ)
কমেন্ট বক্স